পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম ভাষা কোনটি?
একবার এ ব্যাপারে রিপোর্ট প্রকাশিত হলো কলকাতার কয়েকটি পত্রিকায়। তার আগেই ফেসবুকে কথাটা ছড়িয়ে যায়। পত্রিকাগুলো সেখান থেকে রিপোর্ট করে। ইউনেস্কো বিশ্বব্যাপী জরিপ চালিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম ভাষা কোনটি তা ঘোষণা করেছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়া ২২শে এপ্রিল ২০১০-এ ফেসবুক, টুইটারের বরাত দিয়ে এ রিপোর্ট ছাপায় যে, ইউনেস্কোর জরিপে বাংলা হল পৃথিবীর মধুরতম ভাষা (The Sweetest Language in the World) এবং স্প্যানিশ হল দ্বিতীয় ও ডাচ হল তৃতীয় মধুরতম ভাষা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
তারপর ২০১০সালের ১০ই মে প্রথম আলোয় আনিসুল হকের কলামে উল্লেখ করেন, ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের একটা প্রতিবেদনে নাকি বলা হয়েছে ইউনেস্কোর জরিপে বাংলা পৃথিবীর মধুরতম ভাষা নির্বাচিত হয়েছে!!
এসব রিপোর্টের সত্যাসত্য নিরূপন করা যায় নি, তবে বাংলা যে সত্যি সুন্দর ও মনোরম ভাষা বিদেশি যারা এ ভাষা শিখেছেন তারা সবাই তা এক বাক্যে স্বীকার করেন।
আমি এতদিন বাংলা বানান ও ভাষা সম্পর্কে যা লিখেছি, তা পাঠকদেরকে হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। আসলে আমি বর্তমানে আমাদের যে সংকট চলছে তা পাঠকদের উপলব্ধিতে আনতে চেয়েছি। আজকের লেখায় আমি বাংলা ভাষার অসংখ্য ইতিবাচক দিক তুলে ধরবো।
বাংলা দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র বাংলাদেশের একমাত্র স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা। এছাড়াও ভারতীয় সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ২৩টি সরকারি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা হল বাংলা এবং আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার তিন জেলা কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে স্বীকৃত সরকারি ভাষা হল বাংলা। এছাড়াও বাংলা ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম প্রধান স্বীকৃত ভাষা। সম্প্রতি বাংলা ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পশ্চিমের দেশ সিয়েরা লিওনে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা।
বাংলা ভাষাটি বাংলাদেশের প্রধান ভাষা এবং ভারতে বাংলা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কথিত ভাষা। বাংলা ভাষাটি প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা এবং বিশ্বের বহুল প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে একটি (ভাষাভাষীর সংখ্যানুসারে এর অবস্থান চতুর্থ থেকে সপ্তমের মধ্যে)। বাংলাভাষা ভারত বর্ষের শ্রেষ্ঠ ভাষা, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। ইউরোপের বাইরে বাংলাই প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পায়। বিশ্বে সর্বাধিক মানুষ বাংলা ভাষায় জাতীয় সংগীত গায়। ভারতের এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের ভাষা বাংলা। ১৩০ কোটি মানুষ বাংলাভাষায় জাতীয় সংগীত গায়, যা বিশ্বে সর্বাধিক। চীনা ভাষায় গায় ১২৫ কোটি মানুষ এবং ইংরেজিতে গায় ৯৪ কোটি মানুষ।
বাংলা ভাষা অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। পৃথিবীর খুব কম ভাষাই এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বৈদিক সংস্কৃত হল সংশ্লেষণমূলক বা পদক্রমিক ভাষা (Syntactical language) যেমন প্রাচীন হিব্রু, আরবি। আর আধুনিক ভাষা বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি হল বিশ্লেষণমূলক ভাষা (Analytical language)। তবে বাংলা যে সম্পূর্ণভাবে বিশ্লেষণমূলক ভাষা তা মনে হয় না, বরং এতে সংশ্লেষণমূলকত্ব বা পদক্রমিকতার প্রভাবও বেশ অনুভব করা যায়। বাংলায়--‘আমি রুটি খাব’। বাক্যটিকে ‘আমি খাব রুটি’, ‘রুটি আমি খাব’, ‘রুটি খাব আমি’, ‘খাব রুটি আমি’, ‘খাব আমি রুটি’ এভাবে লিখলে অর্থের বিপর্যয় বা বাক্যগঠনে তেমন ত্রুটি হয় না। কিন্তু ইংরেজিতে--I shall eat bread. একই অর্থ বজায় রেখে বাক্যটি Shall I eat bread কিংবা Shall eat bread I, Bread shall eat I, Eat bread shall I, Bread I eat shall এভাবে লেখা অনুমোদিত নয়, অর্থের ভিন্নতা ঘটে। বাংলায় বাক্য গঠনে কিন্তু এমন অর্থ ভ্রান্তি বা ব্যাকরণ বিচ্যুতি কম ক্ষেত্রেই হয়। এতে মনে হয় যে বাংলা ভাষায় আধুনিক বিশ্লেষণমূলকত্ব বা প্রাচীন পদক্রমিকতার প্রভাব পরস্পর মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে । তাই বাংলাকে বলা যায় পদক্রমিক-বিশ্লেষণমূলক ভাষা (Synt-Analytical language)। এ রকম ভাষা পৃথিবীতে বিরল।
বাংলা বর্ণমালাও অত্যন্ত উন্নতমানের। প্রায় সবধরনের উচ্চারণই প্রকাশ করা যায় বাংলা বর্ণমালার মাধ্যমে। প্রতিবর্ণায়নে বাংলা বর্ণমালার কোন জুড়ি নেই। গত একহাজার বছরে বাংলা বর্ণমালা প্রায় আটবার আকার বদল করে বর্তমান রূপ নিয়েছে। ১৭৭৮ সালে বর্তমান বর্ণের রূপ শুরু হয়। বর্ণের সঙ্গে সঙ্গে ভাষায় পরিবর্তন এসেছে। আর এই পরিবর্তনের সময় হয়েছে বিশৃঙ্খলা। বিভিন্ন সময় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে পণ্ডিতরা তা শুধরেছেন। নানা চড়াই উৎরাই পার করে - যে ভাষা নিচু শ্রেণীর বলে অবজ্ঞা করা হতো তা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা, আমাদের গৌরবের অংশ।
বেশ কয়েকজন বিদেশি মানুষ বাংলা ভাষাকে খুব ভালোভাবে আয়ত্ত করেছেন। তাঁদের বাংলাভাষী বললেও খুব দোষের হয় না। যেমন, ফাদার দ্যতিয়েন-- ফরাসি ভাষী, তিনি এত সাবলীল বাংলা লেখেন যে বাঙালিরাও অত সাবলীল লিখতে হিমশিম খাবেন। এতই তিনি ঘরোয়া যে, তিনি যে অন্য ভাষার মানুষ একথা মনে করা কঠিন। ফাদার দ্যতিয়েন বলেছেন, "বাংলা ভাষার ধ্বনিমাধুর্য, সংগীত আমায় আকৃষ্ট করেছে। বাংলা গদ্যের সুরের মূর্ছনা আমার কানে বাজে।" (বইয়ের দেশ, জানুয়ারি-মার্চ ২০১০,পৃঃ-১১৯)
আর একজন জাপানি, কাজুও আজুমা, এমন সাবলীল বাংলা বলেন যে তাঁকে বাংলাভাষী বলা যায় অনায়াসে। খ্যাত জাপানি 'বাংলাভাষী' কাজুও আজুমা বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সভাকক্ষে, ৩০-১২-১৯৯৯ তারিখে বলেছেন, "আমি পৃথিবীর কয়েকটি ভাষা শিখেছি। বাংলাভাষা সবচেয়ে সুন্দর ও মধুর মনে করি। বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি, বাংলাভাষা তার ভাবপ্রকাশের উপযুক্ত ভাষা।"
'প্রগতি প্রকাশন' মস্কো-এর বাংলা বিভাগের প্রধান রাইসা ভালুয়েভা বলেছেন (১৯৭৫)__ "আমার ধারণা যে বাংলাভাষা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও সুরেলা ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম।"
বাংলাভাষার জাপানি শিক্ষক কিওকা নিয়োয়া বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সভাগৃহে (৩০-১২-১৯৯৯) বলেছেন- 'একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি হিন্দি এবং বাংলা পড়াই।... রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রম নন'(অর্থাৎ এমন কবি সাহিত্যিক বাংলায় আরও আছেন)।
বাংলা ভাষা শিখে অনেক গর্ব অনুভব করেন বিশিষ্ট ইংরেজ মহিলা দার্শনিক হানা টম্পসন। তিনি বলেন, "আমি বাংলাভাষার প্রেমে পড়েছি। ভাষাটি কী সুন্দর কী মিষ্টি।... বাংলা ভাষার সুর, উচ্চারণ, ছন্দ, তাল আমার কাছে খাঁটি মজা, ফুর্তি, আনন্দ।" [এরই মাঝে বাংলার প্রাণ' দেশ, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬; বই সংখ্যা, পৃঃ ১২৯]
আরও একজনের কথা তো বলতেই হয় তিনি চীনাভাষী রবীন্দ্রনাথের অনুবাদক চীনা অধ্যাপক দং ইউ চেন জানিয়েছেন, "বাংলাভাষাকে আমার গান মনে হয়। আর, গানে ডুবে গেলে ভেসে ওঠার উপায় নেই। গানের টান খুব গভীর।" [আজকাল, সংস্কৃতি, ২২/০৫/২০১০, শনিবার, পৃঃ-২]
চারুচন্দ্র ত্রিপাঠি (হিন্দি বিশ্বকোষের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাংলা বিশ্বকোষ তৈরির সেমিনারে [৩১-১০-১৯৮৭] হিন্দিতে ভাষণ দেন হিন্দিভাষী কিন্তু বাংলা বোঝেন) বলেন, "এই দেশের সমৃদ্ধতম ভাষা বাংলা।''
আজকের লেখা বিশিষ্ট ভাষা গবেষক, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ভাষাতত্ত্বের প্রিন্সিপাল ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাঙ্গালী প্রবীর দত্ত গুপ্ত-এর মন্তব্য দিয়ে শেষ করছি। তিনি বলেন,
''আমি অনেক ভাষায় গভীরে ডুব দিয়েছি। ৩০ বছর পড়িয়েছি ফরাসি ভাষা। ফরাসি ভাষার ওপর ট্রেনিং দিয়ে থাকি। কিন্তু আমি তখনই বুঝতে পারি, বাংলা ভাষাটা তখন থেকে দেখেছিলাম বলে আরেকটা ভাষায় পা রাখতে পেরেছিলাম। আবার ওটায় পা বাড়াতে গিয়ে তখন আবার বাংলায় ফিরে আসি। ........ আমার ব্যাপারটা মধুসূদনের মতোন, আগে সব শর্ষে খেয়ে এখন দেখছি বাংলাতেই সব মধু আছে।''
# # #
বিশেষ বিজ্ঞপ্তি
আমি এ লেখা আরেকটি পর্বে শেষ করতে পারি। তারপর বানান-ক্লাস নামে এ লেখার ২য় সিরিজ শুরু করবো, ইনশাআল্লাহ। এতে প্রত্যেক পর্বে বানানের কিছু নিয়ম আলোচনা করবো, শেষে অনুশীলনী থাকবে। এভাবে চর্চা করলে আশা করা যায়, বাংলা বানান সবার কাছে সহজ হয়ে যাবে এবং শুদ্ধ বানানে বাংলা লেখতে সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। আশা করবো, সামু কর্তৃপক্ষ এ লেখাগুলো স্টিকি করবে।
পূর্বের পর্বগুলো:
১ম পর্ব - আমরা বাংলা বানান কতটুকু শুদ্ধ করে লেখি? View this link
২য় পর্ব - বাংলা বানান : আসুন এক ছাতার নিচে View this link
৩য় পর্ব- বাংলা বানানে যত বিভ্রান্তি View this link
৪র্থ পর্ব : বাংলার শব্দভাণ্ডার View this link
৫ম পর্ব : বিকৃতির সয়লাবে আমার মাতৃভাষা View this link