বাংলা ভাষা কি এক সময় হারিয়ে যাবে?
আপনি হয়তো জোর গলায় বলবেন, অসম্ভব - কখনই নয়।
কিন্তু এমনটাই মনে করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কিন্তু আমাদের কবিতা, উপন্যাস শতবর্ষ কেন, পঞ্চাশ নয়, দশ বছর পরেও কেউ পড়বে না।’ কারণ কী? বলেন, ‘বাংলা কি কেউ আজকাল পড়ে নাকি? সবকিছু এখন অন্য কিছু, টেকনোলজি আর ইংরেজি এই দুটো জিনিস। এই দুটো জিনিস ছাড়া আর কিছুই টিকবে না।’
যদিও ১লা ফাল্গুনে একটি প্রতিষ্ঠিত দৈনিক পত্রিকায় ‘বাংলা এখন ৩০ কোটি মানুষের ভাষা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধে বাংলা ভাষার দ্রুত সম্প্রসারণ দেখে প্রবন্ধকার আত্মতুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি দলিল হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ‘বঙ্গমাতা’ কবিতাকে পেশ করেন। কবিতায় উল্লিখিত সাত কোটি বাঙালিকে পুঁজি ধরে বর্তমান সংখ্যাকে বিয়োগ করে সম্প্রসারণের বিশালতা দেখেছেন। উইকিপিডিয়ার জরিপে বিশ্বে বর্তমানে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ কোটি।
‘বঙ্গমাতা’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ২৬ চৈত্র ১৩০২ বাংলায়। বর্তমানে ১৪২০ বাংলা। সময়ের ব্যবধান ১১৮ বছর। জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির সর্বনিম্ন হারে হিসাব করলেও ১১৮ বছরে সাত কোটি মানুষের শুধু উত্তরাধিকারী দাঁড়ায় ৫০ কোটি। ৫০ কোটির স্থলে সারা বিশ্বে বাংলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ কোটি। পুঁজি থেকেও ২৫ কোটি ঘাটতি। এটা সন্তুষ্টির ব্যাপার নয়, অনুশোচনার ব্যাপার।
বাংলা ভাষা সম্পর্কে অনেকেই অশনি সঙ্কেত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, 'ভাষার বেলায় পিউরিফিকেশন যত দিন না হবে, ভাষার মৃত্যু ঘটতে থাকবে। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বর্তমান অবস্থা বিরাজ থাকলে আগামী ২০-২৫ বছর পরে আর টিকে থাকবে না।' এ মত প্রদানকারীদের অন্যতম হলেন বিশিষ্ট ভাষা গবেষক, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ভাষাতত্ত্বের প্রিন্সিপাল ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাঙালি প্রবীর দত্ত গুপ্ত। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মতে, ‘সমৃদ্ধির বদলে ভাষার বিকৃতি হচ্ছে কেন? ভাষা আন্দোলনের পর ৬১ বছর ধরে এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সঙ্গত কারণে ডুবেছে মাতৃভাষা। ডুবে তলিয়ে যাচ্ছে। গড়ে ওঠেনি সচেতন প্রজন্ম। গড়ে ওঠেনি মাতৃভাষার পক্ষে সুষ্ঠু পরিবেশ।’
এ জন্য মূলত নানা মুনির নানা মতসহ বাংলা ভাষার হ-য-ব-র-ল অবস্থাই দায়ী। এমন অবস্থা চলতে থাকলে লাতিন সংস্কৃতিসহ বহু ভাষার মত বাংলা ভাষাও 'কাজির গরুর মত কাগজে আছে গোয়ালে নেই' হয়ে যাবে।
বাংলা ভাষাটা আজকাল একটা অরাজকতার মধ্যে যাচ্ছে। এর মধ্যে অনেক গোঁজামিল ঢুকেছে। সেটা মূলত বানান এবং ব্যাকরণের জটিলতা। একই শব্দের বানান হরেক রকমের, এটি অন্য ভাষায় পাওয়া যাবে না।
বাংলা বানান নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রবল বাগ্যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন দেবপ্রসাদ ঘোষ। রবীন্দ্রনাথ তার জবাবও দিয়েছিলেন। তা নিয়ে পরে দেবপ্রসাদ ঘোষ একটি বই প্রকাশ করেন, 'বাঙ্গালা ভাষা ও বাণান'। এখানে দুটি শব্দের বানান লক্ষ্য করতে হবে, 'বাঙ্গালা' এবং 'বাণান'। তাঁর অভিমত ছিল বর্ণন থেকে আসার জন্য 'বাণান' লিখতে হবে।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হলেও তার অনেক দুরবস্থা ও হেনস্থা চলে আসছে। 'বাংলা' শব্দটিরই বানান ৬ প্রকার হয়, বাঙ্গালা, বাঙ্গলা, বাঙ্গ্লা, বাঙলা, বাঙ্লা, বাংলা। 'সবিশেষ' শব্দটির বানান প্রায় ২৪ প্রকার হতে পারে। যদিও এত প্রকারে সত্যিই লেখা হয় না, তবে সে ব্যবস্থা (সম্ভাবনা/আশংকা) এর মধ্যে নিহিত আছে। তাহলে অন্য নানা শব্দে তেমন বিভ্রান্তি কতই তো হতে পারে বানানে এই বিভ্রম নিয়েই আমাদের চলাচল।
বাংলায় আছে প্রায় দেড় লক্ষ শব্দ (ইংরেজিতে সাড়ে চার লক্ষ শব্দ)। বাংলার এই দেড় লক্ষ শব্দে যদি প্রতিটিতে একাধিক বানানের 'সম্ভাবনা' নিহিত থাকে তবে যে কী বিপদ তা বুঝতে কোনই অসুবিধে নেই।
একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, এক-একটি খবরের কাগজের নিজস্ব বানান রীতি আছে, প্রতিটি সাময়িক পত্রিকার নিজস্ব বানান রীতি আছে, প্রতিটি প্রকাশনা সংস্থার নিজস্ব বানান রীতি আছে, প্রতিটি অভিধানের নিজস্ব বানান রীতি আছে, প্রত্যেক পণ্ডিত ব্যক্তির নিজস্ব বানান রীতি আছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এ অবস্থাটা ব্যাপক প্রচলিত। সেখানে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বানানরীতি, আনন্দবাজার গোষ্ঠির একটা, আজকালের একটা, চলন্তিকা বিশ্বকোষের একটা-- এ রকম অসংখ্য বানান সেখানে প্রচলিত।
এ জন্যই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আজকাল বাংলা কেউ পড়ে নাকি। সত্যি কি পড়ার লোক নেই ? পড়তে গেলেই তো বিভীষিকা, এটা কি এ রকম হয় নাকি? এভাবেই তো সব আগ্রহ হারিয়ে যায়। তাতে করে কী হচ্ছে, এই ভাষাভাষির জনগোষ্ঠী আর বাড়ছে না।
অষ্টম শতকের প্রথম থেকে ফরাসি ভাষা সরকারিভাবে ফ্রান্সে চালু হয়। তার আগে লাতিন ছিল। অষ্টম শতকে কিং হেনরি আইন জারি করলেন যে, ‘এখন থেকে সরকারি সব কাজে শুধু ফরাসি ভাষাই ব্যবহার হবে, লাতিনের আধিপত্য আমরা মানছি না।' ষোড়শ শতকে সমিতি করে ফরাসি একাডেমি হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হলো, ফরাসি একাডেমির নির্দেশনা অনুযায়ী ফরাসি ভাষা চলবে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে ভাষার যে শব্দরূপ ও ধাতুরূপ ছিল তা আজ অবধি কোনো পরিবর্তন হয় নি। কিন্তু বাংলাতে দেখা যায় একই শব্দ কেউ ’ে' কার দিয়ে লেখে কেউ লেখে 'ি' কার বা ‘ে া’ কার দিয়ে। ফরাসি ভাষায় কিন্তু এরকম পাওয়া যাবে না। মূলত বাংলার সাহিত্যকর্মী, শিল্পী, অধ্যাপক, সংস্কৃতিকর্মী সবাই হয়তো বিভ্রান্ত নয়তো উদাসীন। যে যেভাবে পারছে লিখছে। রিসার্চ করার ক্ষেত্রে যদি রিসার্চ ওরিয়েন্টেট না হয় তাহলে যে যেভাবে পারে সে ভাবেই তো লিখে যাবে।
নি, না, ন-অর্থক সব কিছুই আলাদা করতে হবে। ‘করিনি বলিনি’ কী কারণে হয়? এক দল বলছে আলাদা হয়ে যাবে, অন্য দল বলছে একত্রে হবে। যারা একত্রে লিখছে ওদের ব্যাখা হচ্ছে, ‘নি’ শব্দটা পরাশ্রয়ী। এটা একা চলতে পারে না। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে শুধু ‘নি’ দিয়ে উত্তর দেওয়া যায় না। আরেক দল বলছে ‘নি’ হলো চলতি রূপ। ‘নি’ ‘নাই’-এর চলতিরূপ। যেহেতু ‘নাই’ থেকে ‘নি’ হয়েছে তাই ‘নি’টা আলাদা করে লিখতে হবে।
‘নি’-এর ব্যবহারের মতো সে রকমই কিছু ব্যাপার আছে ক্রিয়া পদের শেষে ‘ে া’ কার যোগ করে দেয়া। যেমন ‘বল’ এবং ‘বলো’-এর তফাতটা কী ? ‘দেখ’ অথবা ‘দেখো’ কোনটা শুদ্ধ? ‘আসো’, ‘এস’ নাকি ‘এসো’, তিনটিই শুদ্ধ কিন্তু প্রয়োগ ক্ষেত্রটি আলাদা। যেমন, তুমি প্রায় সময়ই তো এই এলাকায় বেড়াতে আসো, তখন আমাদের বাড়িতে তো একবারও আসো না। বর্তমান কালে যদি আদেশ অনুরোধ হয়, তখন এসো হয়। যেমন ‘তুমি আমার কাছে এসো’।
কিন্তু ওটা যদি ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা পদ হয় যেমন, ‘তুমিতো বিলেত যাচ্ছ ওমুকের সাথে দেখা করো’। যদি সাধু রূপ হয় তাহলে হবে ‘করিও’। এটা হবে ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায়।
‘এ’কদিন’ এখানে খুব গরম পড়েছে। এখানে একটা গ্যাপ দিতেই হবে। গ্যাপ না দিলে একদিন হয়ে যাবে। এই যে অসংলগ্ন এটা হয়তো ছোটবেলা থেকে শিখানো হয় নি বা প্রতিষ্ঠিত করা হয় নি।
‘কি’ এবং ‘কী’ এর ব্যবহার একেকজন একেকভাবে করছে। মুখ্য ভূমিকার ক্ষেত্রে ‘কী’ হবে গৌণ ভূমিকার ক্ষেত্রে হবে ‘কি’। যেমন- সে আমাকে অনুরোধ করেছিল, ‘এমন কি’ আমার বাড়িতে এসে টানাটানিও করেছিল, তবু আমি যাই নি। এই নিরপরাধ ছেলেটাকে এত মারধর করলে, সে ‘এমন কী’ অপরাধ করেছিল?
শব্দরূপ/ধাতুরূপ, এটা জানে না বলেই কেউ ডাকে ‘এই এদিকে আস’ আস-টা অনুজ্ঞা পদ নয়। এটা হবে এদিকে এসো। এখানে বসেন হবে না, বসুন হবে। আপনি যখন এই চেয়ারটায় সবসময় ‘বসেন’ তখন এটা অনুজ্ঞা হয় না। কিন্তু কেউ যখন কাউকে অনুরোধ করবে তখন এটা ‘বসুন’ হবে। এই যে তফাতটা এটা হয় না, কারণ শব্দরূপ ও ধাতুরূপ আমাদের দেশে সেভাবে পড়ানো হয় না; কিন্তু যখন লাতিন, ফরাসি বা স্পেনিস শিখানো হয়, তখন শব্দরূপ দিয়ে শুরু করতে হয়, এটা বাধ্যতামূলক। ফরাসি ভাষাতে বেশ কিছু ক্রিয়া পদ আছে একদম পরিবর্তন হয়ে যায় কিন্তু ইংরেজিতে সেটা হয় না। এক সময় দক্ষিণ আমেরিকায় স্পেনিস ছিল সরকারি ভাষা যা তারা ঠিকমতো বলতে পারত না। সহজ বলে আজ ইংরেজি কত সুন্দর করে বলে তারা। কারণ ইংরেজিটা সোজা বলে, ওদের ক্রিয়া পদগুলো খুবই সোজা। ফ্রেঞ্চ, স্পেনিস এবং লাতিনে কিছু ভেরিয়েশন আছে, যা জীবনের শুরুতেই তারা শিখিয়ে দেবে। সেটা সে জন্যই জীবনে কখনোই ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। বাংলাতেও এই বৈচিত্র্য এত ব্যাপক হারে নেই, যেটুকু আছে সেটুকু গোড়াতে শেখানো হয় না।
আমরা যারা বাংলায় লেখালেখি করি, তারা কতটুকু শুদ্ধ বানানে লেখি? আর অন্যরা? যারা লেখালেখির সাথে জড়িত নন, তাদের বানানের অবস্থা কেমন হবে ধারণা করা যায়? বাংলা বানান অনেকটা হ-য-ব-র-ল অবস্থায় থাকায় এখনো তার সত্যিকারের প্রমিত রূপ দেয়া সম্ভব হয় নি। বাংলা একাডেমি যা প্রকাশ করেছে, তা অনেকেই মানছে না।সবাই তার ইচ্ছে মত বানান লিখে যাচ্ছে। অথচ অন্য সমৃদ্ধ ভাষাগুলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজ যাদের মাঝে মাঝে দু চারটা ইংরেজি বাক্য লেখতে হয়, তারা কেউই পারত পক্ষে ভুল বানানে ইংরেজি লেখেন না, এক দুইটা শব্দ ভুল লেখলে হৈচৈ পড়ে যায় এবং টাইপিং-এ গেলে তা শুধরে যায়। কিন্তু বাংলা লেখায় অহরহ ভুল লেখে যাচ্ছি, সে দিকে আমাদের কারোই নজর নেই। এমন কি অনেক বিখ্যাত ব্লগার অসংখ্য ভুল বানান ও ভুল বাক্যে ব্লগ লিখে চলেছেন। শুধরাবার কেউ নেই।
আমি বাংলা বানান নিয়ে ধারাবাহিক কিছু লিখতে চাচ্ছি। উপরের আলোচনাটা ভূমিকা বলা যায়। মূলত বানানের ব্যাপারে আমার দখলতা বাড়ানোর জন্যই এ লেখা।
তথ্যসূত্র ও বিশেষ কৃতজ্ঞতা :
১. বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রাখুন : অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন
২. বাংলা বানান-- এক হউক, এক হউক, এক হউক : মনোজকুমার দ. গিরিশ
৩. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান