somewhere in... blog

১০ই মহরম বা আশুরাঃ মহান রাব্বুল আলামীনের তার সৃষ্টির সম্মুখে সর্বপ্রথম প্রভু হিসেবে আত্মপ্রকাশের দিন।

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সৃষ্টির সূচনা থেকেই মাসের সংখ্যা ১২টি। এর মধ্যে আল্লাহ্‌র কাছে ৪ টি মাস পবিত্র ও সম্মানিত। এ ব্যাপারে আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই মাস সমূহের সংখ্যা আল্লাহ্‌র কাছে ১২। আর তা সুনির্দিষ্ট রয়েছে আল্লাহ্‌র কিতাবে সেদিন থেকে, যেদিন তিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম। সুতরাং এই মাসগুলোর ব্যপারে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করোনা।” [ সূরা তওবাঃ ৩৬][ আর এই ৪ টি মাসের মধ্যে মহরম বছরের প্রথম মাস। আর এই মাস নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।"

আরবী আশারা শব্দ থেকে “আশুরা” শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ দশম। মহরম মাসের দশ তারিখকে তাই আশুরা বলা হয়। ইতিহাসের অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী এই ১০ই মহরম। তার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলোঃ
এই দিনেই হযরত আদম (আঃ) কে আল্লাহ্‌ তার প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করেন।
এই দিনেই হযরত আদম (আঃ) এর অপরাধ ক্ষমা করা হয়।
এই পবিত্র দিনেই হযরত নূহ (আঃ) এর নৌকা মহাপ্লাবন শেষে জুদী পাহাড়ের পাদদেশে এসে থেমেছিল।
এই দিনেই হযরত ইব্রাহীম (আঃ) নমরুদের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি পান।
এই দিনেই হযরত আইয়ুব (আঃ) রোগমুক্ত হন।
এই দিনেই হযরত সোলাইমান (আঃ) তার হারানো রাজত্ব ফিরে পান।
এই দিনেই হযরত ইউনুস (আঃ) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান।
এই দিনেই হযরত ইয়াকুব (আঃ) তার হারানো পুত্র ইউসুফ (আঃ) কে চল্লিশ বছর পর ফিরে পান।
এই দিনেই মুসা (আঃ) তার অনুসারীদের নিয়ে নীল নদ অতিক্রম করেন আর পক্ষান্তরে ফেরাউন তার দলবল সহ নীলনদে ডুবে মৃত্যু বরণ করে।
এই দিন হল প্রায় দুই হাজার নবী-রাসুলের শুভ জন্মদিন।

এই দিনে এত বরকতময় ঘটনা ঘটার কারণ হল এই দিন মহান রাব্বুল আলামীন এর অভিষেক অনুষ্ঠানের দিন। অর্থাৎ সৃষ্টি জগত সৃষ্টি করে এই পবিত্র দিনেই আল্লাহ্‌ তায়ালা রাব্বুল আলামীন আরশে সমাসীন হয়ে তার সৃষ্টির সামনে নিজেকে প্রভু হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ্‌ ফরমান, “আমি ছিলাম গুপ্ত ধনাগার, নিজেকে প্রকাশ করতে ভালবাসলাম, তাই সৃষ্টিজগত সৃজন করলাম।”
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্‌ এরশাদ করেন, “নিশ্চই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ্‌, যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন ছয় দিনে। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন এবং প্রতিটি বিষয় পরিচালনা (করতে শুরু) করেন।” [সূরা ইউনুসঃ ৩]
সেদিন আরশে সমাসীন হওয়ার মধ্য দিয়ে যে অভিষেক অনুষ্ঠান হয়েছিলো সেই অনুষ্ঠানে সকল আদম সন্তানের রুহু সমূহ মহান আল্লাহ্‌র সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্‌কে প্রভু হিসেবে স্বীকার করে নেয়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্‌ এরশাদ করেন, “হে রাসুল! আপনি স্মরণ করুন সেই সময়ের কথা, যখন আপনার প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করে আনলেন এবং তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিলেন তাদেরই সম্বন্ধে এবং বললেন, “আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?” তারা বলল, হ্যাঁ, আমরা সাক্ষী রইলাম।“ [সূরা আরাফঃ ১৭২]
উল্লেখ্য যে মহান রাব্বুল আলামীনের আরশে সমাসীন হওয়ার এই দিনটি ছিল ১০ই মহরম, শুক্রবার।

বর্ণীত হাদিসটি তফসীরে দূররে মানসুরের ৮ম খণ্ডে হযরত ইকরামা (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তায়ালা আসমান জমিন এই দুইয়ের মাঝে যা কিছু আছে তা সৃষ্টির সূচনে করেছেন রবিবার দিন। অতঃপর তিনি (সৃষ্টিকার্য সমাপ্ত করে) শুক্রবার দিন (আশুরার দিন) আরশে সমাসীন হয়েছেন।”
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, “আল্লাহ্‌ তায়ালা হযরত আদম (আঃ) কে শুক্রবার আসরের পর সৃষ্টি করেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন।” [মেশকাত শরীফ ও মুসলিম শরীফ]
মূলত এই দিনটি ছিল মহরম মাসের ১০ তারিখ, শুক্রবার।

গুনিয়াতুত তালিবীন কিতাবে কাদেরীয়া তরিকার ইমাম বড়পীর আব্দুল কাদের জিলহানী (রহঃ) লিখেছেন, “আল্লাহ্‌ তায়ালা রাব্বুল আলামীন আশুরার দিন আরশে সমাসীন হয়েছেন। আর এই বিশ্বজাহান ধ্বংসও হবে এ দিনে। সর্বপ্রথম বৃষ্টি ও আল্লাহ্‌র রহমত দুনিয়াতে বর্ষিত হয় এ আশুরার দিনেই।”

পবিত্র আশুরা বা ১০ই মহরম মহান রাব্বুল আলামীনের অভিষেক অনুষ্ঠানের দিন হওয়ার কারণেই এই দিনের সম্মান ও মহাত্মকে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যেমনঃ কোন রাজ্যের রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানের দিনটি সেই রাজ্যের রাজা ও প্রজাদের কাছে বিশেষ স্মরণীয় দিন। সেই দিনটি ঐ রাজ্যের প্রজাদের চাওয়া-পাওয়ার দিন। তেমনি ভাবে আশুরা হল বান্দাদের জন্য মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা রাব্বুল আলামীনের নিকট চাওয়া-পাওয়ার দিন। এজন্যই মহান রাব্বুল আলামীন তার অভিষেকের দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই তার এই সৃষ্টিজগতে অসংখ্য ঘটনার অবতারণা করেছেন।
পবিত্র আশুরার ইতিহাস সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা না থাকার জন্যই মুসলিম জাতি এ দিনটিকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করতে পারছেনা। কারবালায় ইমাম হোসেন (রাঃ) তার ৭২ জন সঙ্গী-সাথী নিয়ে যে শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন তা এই পবিত্র আশুরার দিনেই। আমাদের অনেকের ধারণা যে কারবালায় ইমাম হোসেন (রাঃ) এর বিয়োগান্তক ঘটনার কারণেই এই দিনটি মুসলিম বিশ্বে স্মরণীয় হয়ে আছে। আবার শিয়া সম্প্রদায় যেহেতু এই দিনটি শোকের সাথে পালন করে তাই অজ্ঞতার কারণে অনেকে ধারণা করে থাকেন যে এই আশুরা আসলে শিয়াদের অনুষ্ঠান।
১০ই মহরম বা আশুরা-সৃষ্টির সূচনা থেকে উদযাপিত হওয়া এক ঐতিহাসিক দিন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “আল্লাহ্‌র রাসুল (সাঃ) পবিত্র মদিনায় আগমন করে দেখলেন যে ইহুদী সম্প্রদায় আশুরার দিন রোজা রাখে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা এই দিনে কেন রোজা পালন করো?” তারা বলল, এটি এক মহান দিন। এ দিনে আল্লাহ্‌ মুসা (আঃ) কে রক্ষা করেছিলেন আর ফেরাউনের দলকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন।” সেজন্য মুসা (আঃ) আল্লাহ্‌র কাছে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এই দিনে রোজা রাখেছেন। আল্লাহ্‌র রাসুল (সাঃ) শুনে বললেন, মুসা (আঃ) এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে তোমাদের থেকে আমরাই বেশী অগ্রগামী। সুতরাং, তিনি আশুরার রোজা রাখেন এবং মুসলমানদেরও রোজা পালনের নির্দেশ দেন।” [ বোখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, বায়হাকী শরীফ, তফসীরে দূররে মানসুর-৩০তম খণ্ড ]
বর্ণীত হাদিসটি তফসীরের কিতাব তফসীরে দূররে মানসুরের ৩০ নং খণ্ডে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণনা করা হয়েছে। রাসুল (সাঃ) এরশাদ করে, “আশুরার দিনটি এমন একটি দিন যে, সমস্ত নবী-রাসুলগণ এই দিনে রোজা রাখতেন। সুতরাং, তোমরাও এই দিনে রোজা রাখো।”
বর্ণীত হাদিসটি হাদিসের কিতাব বোখারী শরীফের ২য় খণ্ডে হযরত আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণীত হয়েছে। তিনি বলেন, “পবিত্র রমজানের পূর্বে আশুরার রোজা রাখা হত। যখন রমজানের রোজা ফরজ হল, আল্লাহ্‌র রাসুল (সাঃ) ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তি আশুরার রোজা রাখতে চায় সে রাখতে পারে আর যে ঐদিন রোজা না রাখে তাতেও কোন অসুবিধা নেই।”
বর্ণীত হাদিসটি তফসীরের কিতাব তফসীরে দূররে মানসুরের ৩০ নং খণ্ডে হযরত জাবের (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্‌র রাসুল (সাঃ) এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি আশুরার দিন নিজ পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত ভালো খাবারের ব্যবস্থা করবে সে, আল্লাহ্‌ তায়ালা তার জন্য সারা বছর পর্যাপ্ত রিজিকের ব্যবস্থা করবেন।”
আমরা এই মানব জাতি, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে দয়াময় রাব্বুল আলামীনের প্রভু হিসেবে আত্মপ্রকাশের এই পবিত্র আশুরার দিনটি যদি যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন করতে সক্ষম হই তাহলে তা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অবারিত রহমত ও বরকত লাভের অসিলা হিসেবে কাজ করবে।

"আশুরার দিবসে-আল্লাহ্‌ বসেন আরশে
আশুরার উসিলায়, পাপীতাপী মুক্তি পায়,
রহমত বর্ষে দুনিয়ায়, আশুরার উসিলায়।"

(লেখাটি লেখার সময় প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে কোরানের তফসীর "তফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী" এর প্রথম খণ্ড হতে।)
৪২৫ বার পঠিত
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=চায়ের আসরে গল্প বলার দিনগুলো সেই= (চায়ের কাপে টুংটাং সুর-৮)

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৫ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:৪১



হারিয়ে গেল কালের অতলে বিকেলের চায়ের আয়োজন
গোল বৈঠক উঠোনে, চারপাশে কত প্রিয়জন
উষ্ণ চা সাথে মুড়ি
ঠোঁটে উড়তো কত কথার ফুলঝুরি।

টিভি সিরিয়াল আর ইন্টারনেট
ইনবক্স আর চ্যাট
কেড়ে নিল সুন্দর সময়গুলো
আন্তরিক সম্পর্কগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণহত্যাকারী দল জামাত শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হোক!

লিখেছেন সৈয়দ তাজুল ইসলাম, ১৫ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৫:৫০



জামাত শিবির সুযোগ পেলে আবারও প্রকাশ্যে বাঙালী গণহত্যায় যুক্ত হবে, আওয়ামিলীগের পূনর্বহালের কথা ভাবতে গেলেই এই বিশ্বাসটা দৃঢ় হয়। এই হিসেব মিলাইতে গেলে আপনার রকেট সাইন্স... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাসুদ(শাহবাজ ) তোমরা কি আর ভালো হবা না ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:২৯


বাংলাদেশপন্থীরা ভারত ও পাকিস্তানপন্থীদের হাউকাউতে অতিষ্ঠ। ভারত ও ভাদা রা মনে করে ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। অন্যথা বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। পাকিস্তান কি ভারতের ৫টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই মে, ২০২৫ রাত ৮:২৭








ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আকস্মিক সামরিক সংঘাতের চার দিন পর দুই পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলেও যুদ্ধক্ষেত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

তেমনই একটি হচ্ছে ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

শ্বশুর বাড়ীর ভূতের যাতনা: সত্য ঘটনা অবলম্বনে

লিখেছেন অপলক , ১৫ ই মে, ২০২৫ রাত ১১:৪১

নিচের ঘটনাটা দিনাজপুর, উপশহরের। ঘটনাগুলো জেনেছি আমার স্ত্রীর কাছে।



আমার শ্বশুর শহরের পাশে একটি পুরাতন টিনের বাড়ি কেনেন। বাড়ির প্রথম মালিক ছিলেন একটি হিন্দু পরিবার। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×