(১)
ছেলেটি ছোট, মেয়েটিও ছিল ছোট। থাকতো পাশাপাশি বাড়িতে। অনেক ছোটবেলা থেকেই তাদের বন্ধুত্ব। ভালবাসার মানে বোঝার মত বয়স হয়নি। কিন্তু তবুও ছেলেটির মেয়েটির প্রতি এক অদ্ভুত ধরনের আকর্ষণবোধ ছিল। না বুঝেই তাকে অনেক ভালবাসতো। মেয়েটি পাশে থাকলে নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হতো ছেলেটির। তাকে না দেখলে মনে হতো কি যেন নেই, কি যেন নেই। সব সময় তার পাশাপাশি থাকতে চাইতো। তাদের মাঝে বোঝাপড়াটা ছিল অসাধারণ। দুজনের মাঝে প্রায়ই খুনসুটি লাগতো, মারামারি, খামচি দেয়া চলতো। মেয়েটি মাঝে মাঝে রাগ করে গাল ফোলাতো। তখন নানা রকম কৌশল করে তার রাগ ভাঙাতো ছেলেটি। আবার একসাথে খেলা শুরু করতে দেরী হতো না।
মাঝে মাঝে অসুস্থ থাকলে মেয়েটি খেলতে বের হতো না। তখন বেশিন থাকতে না পেরে ছেলেটি নিজেই মেয়েটির বাসায় চলে যেত। লেগো, পুতুল, বল নিয়ে খেলতো, তাকে সঙ্গ দিত। মেয়েটির বাসায় তার অবাধ যাতায়াত ছিল। বাসায় মেয়েটির সমবয়সী কেউ ছিলনা। তা ছাড়া মেয়েটির আম্মুও ছেিেনজের ছেলের মতই দেখতেন। তাদেও পরিবারটিও ছিল অসাধারন। আধুনিক ও রুচিসম্পন্ন।
কখনো খেলতে ইচ্ছে না থাকলে তারা কয়েকজন একসাথে ঘুরতে বের হত। ছেলেটি ছিল একটু দুরন্ত প্রকৃতির, পাড়ার সমস্ত ঝোপঝাড় ছিল তার নখদর্র্পণে। সে ঘুরিয়ে দেখাত কোথায় পাখির বাসা, পাখির ডিম, বুনো ফুল। ফুল বড় ভালবাসতো মেয়েটি। বিভিন্ন জায়গা থেকে মেয়েটির জন্য ফুলের গাছ নিয়ে আসতো। নতুন কোন গাছ পেলে আনন্দের সীমা থাকতোনা। তার আনন্দ দেখে খূশী হত ছেলেটি।
ছেলেটি যেমন মেয়েটিকে পছন্দ করতো, মেয়েটিও করতো। দুজনের মাঝে বোঝাপড়াটা ছিল অসাধারণ। এভাবেই একসাথে ঘোরা, একসাথে খেলা করতে করতে সময় কাটতে থাকে। বাড়তে থাকে ভালবাসার ছোট্ট চারাগাছ।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে ছেলেটি ভালবাসার বর্ণমালা শিখতে থাকে। ছেলেটি জানে সে মেয়েটিকে অনেক ভালবাসে, এও বোঝে মেয়েটি তাকে পছন্দ করে। কিন্তু সেটা কি ভালবাসা নাকি শুধুই পছন্দ, এটা সে কখনোই বুঝতে পারেনি।
ছেলেটি রাত জেগে অনেকবার পরিকল্পনা করেছে মেয়েটির কাছে নিজের ভালবাসার ডালা মেলে ধরবে; কিন্তু অজানা কোন এক ভয়ে বলতে পারেনি কখনও। জানাতে পারেনি মেয়েটি চলে যাবার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত। হয়তো বয়স কম ছিল।
মেয়েটি কাশ সিক্স বা সেভেন-এ থাকাকালীন সময়ে মেয়েটির বাবা-র কর্মত্রে ঢাকা শহরে বদলী হয়। ফলে মেয়েটি সপরিবারে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হয়।
ছেলেটি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল খবরটি শুনে। সেদিন আর তার খেলা হয়নি। অদ্ভূত বিষন্নতায় ঢাকা পড়েছিল তার মনের আকাশটা। নির্দিষ্ট দিনে সকল খেলার সাথি-দের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্যত্র চলে যায় মেয়েটি। চলে যায় ছেলেটির হৃদয়ের একটা অংশ। ভাঙা মন নিয়ে পড়ে থাকে ছেলেটি। দুপূরে বেরাতে যাওয়ার উৎসাহ পায়না, বুনো ফুল গুলো নির্ভয়ে বংশবিস্তার করে, পাখির ডিম চুরি হয়ে যায়। ছেলেটি বোঝে মেয়েটি তার কাছে কি ছিল। প্রতিণে তার অভাব অনুভব করে। মন কেঁদে যায়; নিজেও কাঁদে লুকিয়ে লুকিয়ে। পড়ায় মন বসেনা, বইয়ের পাতায় পাতায় মেয়েটির ছবি ভেসে উঠে। ঘুরতে ভাল লাগেনা, খেলতে ভাল লাগেনা। তার উৎসাহ চলে গেছে অনেক দূর। কিন্তু ছেলেটি বাইরের কাউকে বুঝতে দেয়নি তার মনের অবস্থা। সবার সাথে মিশেছে আগের মতই। কথা বলেছে, দূষ্টুমি করেছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে চৈত্রের শূষ্কতা বয়ে বেড়িয়েছে দিন-রাত।
পরবর্তী দুই বছর দেখা হয়না তাদের। দু’বছর পর একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখে মেয়েটি আর তার আম্মু এসেছে। অনেকন আগেই এসেছে, এখন চলে যাচ্ছে। মেয়েটিকে দেখে বুকে মোচড় দিয়ে উঠে তার। চোখে পানি চলে আসে। কিছু বলবে, হায়, তাদের যে এখন যাবার বেলা। কিছুই বলা হলনা। মেয়েটির চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে, পারেনা। ছেলেটির বুকে ঝড় বইয়ে দিয়ে আবার তারা ফিরে যায়।
এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। ছেলেটি পার হয়েছে কলেজের আঁঙিনা। আঁকতে শিখেছে ভালবাসার মানচিত্র। তার সাথে নিজেকে মিলিয়ে অবাক হয়, সে কত ভালবাসে মেয়েটিকে! প্রতিদিনই কিছু সময় স্মৃতির গভীরে হারিয়ে যায় সে। অনুভব করে সেই ছোট্ট মেয়েটির হাতের স্পর্শ। ভূলতে পারেনা একটি দিনের জন্যও। আহ্ মেয়েটি যদি জানতো! মেয়েটি যদি দেখতো তার ভালবাসার সেই ছোট্ট চারাগাছ আজ কত বড় মহীরূহে পরিণত হয়েছে। স্বশব্দে বুকের গভীর থেকে দীর্ঘনিঃশ্বাস উঠে আসে।।
.......................................................
( লেখাটা বছর খানেক আগের, ছেলেটি কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। এই সময় সে মেয়েটির বর্তমান ঠিকানা আবিষ্কার করে ফেলে। কিন্তু হঠাৎ করে গিয়ে দেখা করার মত সুযোগ পায়না। বিধাতাই নিজ হাতে তার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। মেয়েটি যেখানে থাকে সেই এলাকায়ই ছেলেটির এক খালার বিয়ে হয়। সুযোগ টা হাতছাড়া করেনা ছেলেিিট। বিয়ে চলাকালীন সময়েই একদিন হঠাৎ করে মেয়েটির বাসায় চলে যায়। তাকে রিসিভ করে মেয়েটির বড় ভাই। ছেলেটিকে দেখে আন্টি (মেয়েটির মা) অনেক খুশি হন। মেয়েটিকে দেখার জন্যে ছেলেটির মনে যেন জ্বলোচ্ছাস বইতে শুরু করে। তার বুকের ঝড় আরও বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি ঘরে ঢোকে। ঘরে ঢুকেই মেয়েটি ছোটখাট একটা চিৎকার দিয়ে ফেলে তার নাম ধরে। ছেলেটির মনে ীণ আশার দোলা জাগে মেয়েটি কি তাকে পছন্দ করতো ! তাকে দেখে ছেলেটির চোখ যেন সরেনা। শেষবারের চাইতে ঢের বেশী সুন্দরী হয়েছে সে। চোখ ফেরানো মুশকিল। বাইরে অবশ্য কিছুই বুঝতে দেয়নি ছেলেটি। অনেকদিন পর দেখা, সেদিন অনেক কথা হয় তাদের সবার সাথে। কিন্তু সময় অফুরন্ত নয়। বিদায় নিতেই হয়। মেয়েটিকে চোখের আড়াল করতে একটুও মন চায়না ছেলেটির, আবার আসবে কথা দিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে সে। সেদিনও তার গোপন কথা গোপনই থাকে।
তার দেয়া কথামত ছেলেটি এর পরেও কয়েকবার মেয়েটির বাসায় যায়। কিন্তু কোনবারই সে তার ভালবাসার কথা মেয়েটিকে জানাতে পারেনি। কোন কারণে মেয়েটি যদি তাকে প্রত্যাখ্যান করে তবে তার কি হবে তা সে ভাবতে চায়না। মেয়েটিকে তো চিরদিনের জন্য হারাবেই উপরন্তু মেয়েটির পরিবারের সকলের ভালবাসা ও স্বহৃদ্যতা হারাবে। তাই সাহস করে বলা হয়নি। আজও নিরবেই বংশবিস্তার করে চলেছে তার ভালবাসার ছোট্ট চারাগাছ।)
...................
পরবর্তি পর্ব গুলো
(২) ..:: ভালবাসার চারাগাছ - না বলা কথাগুলো (১) ::..
(৩) ..:: ভালবাসার চারাগাছ - না বলা কথাগুলো (২) ::..
(৪)
..:: ভালবাসার চারাগাছ - অপেক্ষার মধ্যরাত ::..
(৫)
..:: ভালবাসার চারাগাছ - কষ্ট প্রহর ::..