somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প । গুপ্তপ্রণয়

১১ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


যৌবন লুপ্ত আলমাসের সামনে ভিড় করা জরাগ্রস্ত বেশ্যাদের জটলা পেরিয়ে সার্কিট হাউজের দেয়াল ঘেঁষা ফুটপাতে উঠে এলাম। জনশূন্য ফুটপাত, শুধু কিছু বৃহৎ গোল বাদাম পাতা পড়ে আছে আর কয়েকটা মধ্যবয়সী কালো কুকুর। মৃদুমন্দ নরম বাতাস শরীরে কাঁপন সৃষ্টি করছে সুখদ। মাঝরাতের শব্দহীন তুলতুলে বাতাস যেন বঙ্গোপসাগরের বুকে চুপচাপ শুয়ে থাকা নিভৃত কুকরি মুকরির কৌমুদীস্নাত হাওয়া, নির্লিপ্ত, শান্ত আর দূঃখ ভারাক্রান্ত, অথবা মৌন। বেশ্যাদের প্রভাহীন মুখ আর অনুচ্চ হাসি ছাপিয়ে আমার মনে পড়লো জিয়ার কথা, সার্কিট হাউজের পাশ দিয়ে হাঁটলেই এই হতভাগ্য প্রেসিডেন্টের কথা মনে পড়ে আমার। যদিও এটা নতুন, জিয়ার রক্ত লেগে থাকা ব্রিটিশদের বানানো পুরনো সার্কিট হাউজটা এখন জাদুঘর আর এটার পিছনেই দাড়িয়ে আছে সৌম্য অবয়ব নিয়ে শাদা।

জাদুঘরটা এককালে ছিল জৌলুশপূর্ণ আর পরিনত হয়েছিল তীর্থস্থানে। সাধারণ বা দামি লোকজনে গমগম করতো সারাদিন। সাজসজ্জা কিংবা অন্যান্য ব্যবস্থা, সবই ছিল উন্নত, চাকচিক্যময়। এখন কিছুই অবশিষ্ট নাই, ভেতর আর বাহির, সবই বিবর্ণ-নিষ্প্রভ-সকরুণ, পরিত্যক্তা সেই স্ত্রীলোকের মতোই, যে একদিন বীর্যবান বা নির্বীর্য বহু পুরুষলোকের হৃদয়রন্জনে ছিল সক্ষম, সবল, উদগ্র।
কিছুদিন আগে একবার ঢুকেছিলাম সেখানে, নির্জন, সুনসান, প্রায় তমস্বী। দোতলার একটা কক্ষের কোণায় উন্মত্ত এক জোড়া তরুন তরুণী চুমু খাচ্ছিলো পরস্পরের ঠোট, গাল, গ্রীবায় আর একে অপরের স্তনে চাপ দিচ্ছিলো অবিশ্রান্ত। তাদের পাশেই দেয়ালে ঝুলছিল আর্মির ইউনিফর্ম পরা জিয়ার ভাবলেশহীন মুখের বিশাল আকৃতির চিত্রিত মূর্তি।

মধ্য এখন রাত। গাড়ীর হেডলাইটের লম্বা আলোগুলো কমতে কমতে প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। শুধু সোডিয়াম বাতির নম্র জ্যোতি রাস্তাগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে আর কিছু অল্পদামি বেশ্যার অল্পজ্জ্বল চোখ। গভীর রাতের মসৃণ ফাঁকা সড়ক চিত হয়ে শুয়ে থাকা ষোড়শীর মেদহীন অনাবৃত শরীরের মতোই বিহবল, মূঢ় বা মুগ্ধকর।
বেশ অনেকদিন পর রাতের রাস্তায় বেরুলাম, বিষণ্ণ, নিস্তব্ধ এবং আলাদা নয়। সব রাতই একইরকম বা দিনগুলো, যতক্ষণ না অন্যরকম কিছু ঘটছে। ত্রিশে মের রাত, কি সাধারণ আর বৈশিষ্ট্যহীন ছিল বুলেট কিংবা রক্ত ঝরার আগ মুহূর্তেও। অন্য রাতের মতোই সূর্য ছিল অন্তর্হিত। একটা ছিন্ন পোশাকের উন্মাদ কথা বলছিল সঙ্গী লাল কুকুরটার সঙ্গে আর চট্টগ্রামের আকাশ সেদিন ছিল মেঘে ভরা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিলো দিনভর এবং মাঝ রাতে যা পরিণত হয়েছিল মুষলধারায়। মৃত্যু একদম অকস্মাৎ হানা দিতে পারে, যেটা আপনার কল্পনাকেও হার মানাবে। মৃত্যু হলো ভাইপারের মতো বিষাক্ত সরীসৃপ, নিঃশব্দে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে এসে আপনাকে দংশন করবে পলকে অথবা আচমকা, বিন্দুমাত্র ভাবনারও সুযোগ না দিয়ে।
হাঁটতে হাঁটতে সার্কিট হাউজের দূর্ভেদ্য লোহার গরাদ আর বাচ্চাদের পার্কের কিম্ভূত উচু দ্বার পেছনে ফেলে স্টেডিয়ামের কাছাকাছি চলে এলাম। বিকাল থেকে অনেকটা রাত পর্যন্ত এখানকার খাবারের দোকানগুলো পয়সাওয়ালা লোকেদের ভিড়ে মুখর থাকে। এখন অবশ্য এক জোড়া মানুষেরও চিহ্ন নাই বা গন্ধ।

লোকটার বয়স ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না যদিও তার কিছু চুল শাদা মনে হচ্ছে আর গাল ভাঙা, শরীর শীর্ণকায়। সে স্টেডিয়ামের পেছনের দিকে গ্যালারির নিচের খোলা জায়গায় মাদুর বিছিয়ে শুয়ে আছে, সিগারেট টানছে, পা দুটো পাশের সস্তা গালিচার স্তূপের উপর তুলে দিয়ে। আমি এগিয়ে গেলাম নিশ্চিত হতে, লোকটা সে কিনা যাকে আমি খুঁজছি বহুদিন ধরে বা বহুরাত।
লোকটা একদমই ভণিতা বিবর্জিত বা অকৌশলী, অথবা বলা যায় মার্জিত নয়। কোনরকম ভূমিকা ছাড়াই বললো আমি একজন বেশ্যার দালাল ছাড়া আর কিছুই না। আমার কাছে কিছুই পাবেন না, কোন খবরই না, গল্পতো নয়ই। আপনি বরং কালো পর্দাটা সরিয়ে ভিতরে গিয়ে খুঁজে দেখতে পারেন। সেখানে ডিউটিতে থাকা এক হাবিলদার কাপড় চোপড় সব খুলে রতিক্রিয়ায় আকণ্ঠ নিমগ্ন অল্পবয়সী একটা বেশ্যার সাথে। এই হারামজাদা আজ বিকালেও কমবয়সী সুন্দরী বউ, প্রস্ফুটিত কুচ আর পরিণত বাহুসমৃদ্ধ শ্যালিকা নিয়ে সামনের দোকানে পোড়া মুরগীর ঠ্যাং খেতে এসেছিলো। সে আমার এখানেও আসে প্রায়ই আর একটা টাকাও না দিয়ে চলে যায়।

আমি একটা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে লোকটার হাতে দিলাম। লোকটার মুখে বিনয়ের লাজুক হাসি ফুটে উঠলো। তার মেজাজ কিছুটা শীতল হলো বোধহয়। - কিন্তু সবারই তো গোপন প্রেমিক থাকে অথবা প্রেমিকা। যাদের সঙ্গে তারা মূলত সঙ্গমে লিপ্ত হতে চায়। যদিও তারা দাবী করে একে অপরকে ভালোবাসে। ব্যাপারটা তো মিথ্যে নয়, হয়তো তারা অস্বীকার করে এবং এটা স্বাভাবিক।
একটু থামলাম আমি যাতে অল্প দম নেয়া যায় আর বেশ্যার দালাল লোকটার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে পারি। লোকটা ততক্ষণে শোয়া থেকে উঠে বসেছে। সিগারেটে লম্বা টান দেয়ার ফাঁকে সে ডান হাতের তর্জনী আচমকা প্রবেশ করালো বাম পাশের নাকের মধ্যে, আর খুব দ্রুত একটা মোচড় দিয়ে ময়লামিশ্রিত আঙ্গুলটা বের করে আনলো সাথে সাথেই। ক্ষণিকের জন্য তার চোখ বন্ধ হতে দেখলাম আরামে। চোখ খুলতেই সহসা আমার উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হলো সে। ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়লো, এরপর স্থির হয়ে গেল সটান। তার চেহারার লঘু ভাবটা উধাও হলো মুহূর্তে। কিন্তু আমি বুঝতে ব্যর্থ হলাম কিছুক্ষণ আগে আমার বলা কথাগুলো তার হৃদয়ঙ্গম হয়েছে কিনা। আমি দৃশ্যটার সমাপ্তি টানতে বাকি সংলাপগুলো আওড়ালাম যথাসম্ভব দূর্বোধ্যতা এড়িয়ে। - আমি এমন কাউকে দেখি নি যে কেবল একজনেই সন্তুষ্ট ছিল অথবা তৃতীয় কাউকে কামনা করে না। আসলে পৃথিবীতে কোন প্রেম নাই, সব স্বকপোলকল্পিত আর মেকি বা কপট।
লোকটা শুনলো অধৈর্যসহ, মৃদু চঞ্চলতার ভাব লক্ষ্য করলাম তার মধ্যে। - আপনি লেখক মানুষ, চরিত্রহীন, হৃদয়হীনও অথবা আপনার দৃষ্টিশক্তি একটু বেশিই ভালো হয়তো।
- আপনি কি আমাকে ব্যঙ্গ করলেন! দেখেন আপনার ব্যবসায় টিকতো না যদি ব্যাপারটা ভিত্তিহীন হতো।

লোকটা, যার কাজ বেশ্যাদের আয়ে ভাগ বসানো এবং সামনের দাত দুটো যার কোদালের মতো চওড়া ও বাঁকানো, সিগারেটে শেষ টানটা দিলো সে, তারপর পোড়া অবশিষ্টাংশ ছুড়ে মারলো অন্ধকারে। একটা জোনাক পোকা যেন উড়লো কিছুক্ষণ এরপর ভূপাতিত হলো অনিচ্ছা সত্বেও।
একদম নিঝুম চারপাশ, সুনসান। শুধু কালো পর্দাটার ওপাশ থেকে নর-নারীর মিলনের ফলে সৃষ্ট মন্থিত সংগীতের চাপা ধ্বনি কানে আসছে অস্পষ্টভাবে। আমি লোকটার দিকে চোখ ফেরালাম, সে দুটো হাত একত্রে করে ঝাড়ার ভঙ্গি করলো, গলা খাঁকারি দিলো মৃদু। এরপর এমন কিছু বললো যা মনে হতে পারে অপহ্নব অথবা অপলাপ।
- আমি আমার বউ ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে শুই নি গত সাতাশ বছরে আর আমার চেয়ে বেশি সুযোগ কার পক্ষে পাওয়া সম্ভব বলে আপনার মনেহয়? আপনি সবাইকে নিজের মতো ভাবতে পারেন না।
আমি অবাক হলাম স্পষ্টতই, কিন্তু লোকটা বোধহয় সত্যই বলেছে, তার চোখ তেমনই সাক্ষ্য দিচ্ছিলো।

লোকটা সাধারণ না অথবা অস্বাভাবিক। যাইই হোক সে, তার বৌয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু মহিলার খোঁজ বোধহয় কখনোই পাবো না আমি। সে হয়তো এই মৃদু হাওয়া ভেসে বেড়ানো আরামপূর্ণ রাতে স্বামীর অনুপস্থিতিতে হাঁটুর বয়সী কারো হাঁটুর মাঝে মুখ গুজে আছে, অথবা স্মৃতি রোমন্থন করছে সেই দিনের, যেদিন প্রথম কোন পরপুরুষের স্পর্শে তার শরীর কেঁপে উঠেছিল কিংবা গন্ধমৃগে। সেরকম কিছু হলেই বরং খুশি হবো আমি, লোকটা একটা অদ্ভুত সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই না।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১৭ রাত ৯:৪৭
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×