অথচ আমি এখন বৃদ্ধ, হাড় জিরজিরে আর রুগ্ন, কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, কি যুবকই ছিলাম আমি। পেশিবহুল আর পেটানো শরীর, সারাদিন স্টীল মিলে কাজ করতাম আর সারা রাত অনবরত মিলিত হতাম কোন বেশ্যার সাথে।
জীবন কত বিচিত্র আর অবিশ্বাস্য ঘটনায় ভরা। আমি ছিলাম অশিক্ষিত, নির্বোধ, একঘুয়ে, বন্ধুহীন, নাস্তিক। আমার কেউ ছিল না, কেউ না। আমি কাউকে মনে করতে পারি না, যে আমাকে বুকের দুধ খাইয়েছিল, যাকে মাতৃস্নেহ বলে সবাই, অথবা চকোলেট কিনে দিতো আমাকে।
ছেলেবেলার ধূসর স্মৃতি আমার চোখে ভাসে প্রায়ই। রেল স্টেশন, ইন্জিন আর ভেপুর বিকট শব্দ, নোংরা ড্রেন, চটের বস্তার ঘর আর দূর্গন্ধময় ডাস্টবিন, সাথে মানুষের অসহ্য কুৎসিত ব্যবহার। রেল স্টেশন আর বস্তিতে বোধহয় ধর্ম পৌছাতে পারে নি এখনো। অবশ্য অভিজাত এলাকায়ও ভালো মানুষ আমি পাই নি খুব, তবে চাকচিক্যময় ধর্ম পেয়েছি। আলিশান সুরম্য মসজিদ আর মন্দিরে ভরা অভিজাত এলাকা, অথচ মানুষগুলো নোংরা, জীর্ন। ভাল মানুষরা বোধহয় রূপকথার গল্পেই থাকে, বাস্তবে আপনি তাদের দেখা পাবেন কদাচিৎ ।
বহুবছর রেললাইনের পাশে থাকা চায়ের দোকানগুলোতে কাজ করে একদিন আবিষ্কার করি আমার কোন সঞ্চয় নেই, স্বাধীনতাও না। অদম্য যুবা আমি তখন, উনিশ বছর বয়স। সারাদিন দোকানে কাজ করি আর দোকান মালিকের বৌয়ের শরীর টিপে দেই মাঝে মধ্যে। স্তন-গ্রীবা-উরু-নিতম্ব, অবশ্য আর কিছুই নয়, প্রবল ইচ্ছা থাকলেও।
মহিলার সারা শরীরে নাকি প্রচন্ড ব্যথা হতো। চা বানানোর সাথে শরীর বানানো ছিল আমার বাড়তি কাজ, এবং আমি কাজটা করতাম আগ্রহ নিয়ে, উন্মূখ হয়ে। কিন্তু এটাই কাল হলো, মালিক দেখে ফেললো একদিন। মেরে বের করে দিলো এলাকা থেকে। যদিও ব্যাপারটা শাপে বর হয়েছিল আমার জন্য। আমি স্বাধীনতা পেলাম, পৃথিবীটা বেশ বড় মনে হলো।
বড় কিছু একই সঙ্গে আনন্দের আবার বিপদজনকও হতে পারে। এতোদিন আমার পৃথিবী ছোট ছিল, তবে তাতে মাথা গোজার ছোট ঠাইও ছিল, কিন্তু এখন কেবলই ধবনীল আকাশ, উজ্জল তারকারাজি, আর কিছুই না।
কয়েকদিন এভাবেই কাটলো, ফুটপাত আর স্টেশনে, খেয়ে না খেয়ে। এদিক ওদিক যেতাম, কাজ খুজতাম, পেতাম না, কেবল সস্তা ভাতের হোটেলের বয়ের কাজ ছাড়া। অথচ কাজটাকে স্রেফ ঘৃণা করি তখন।
একদিন শহর ছেড়ে অনেকটা বাইরে চলে এলাম হেটে হেটে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিপুল সাইজের কারখানা তৈরি হচ্ছিল সেখানে। অনেক লোক নাকি নেওয়া হচ্ছে কারখানাগুলোতে। আমি একটার দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
স্টীল কারখানা। একটা কাজ ওরা দিলো। পুরনো আর জং ধরা স্টিলের পাত বয়ে নিয়ে যেত হতো নির্দিষ্ট জায়গায়, যেখানে ওগুলোকে গলানো হতো প্রচন্ড উত্তাপে। অমানুষিক পরিশ্রম হলেও কাজটা আমি ছেড়ে দেই নি। বেতন ভালোই ছিল, আর্থিক নিশ্চয়তা বড় বিষয়।
একটা ঘর ভাড়া পেলাম ফ্যাক্টরীর কাছেই একটা বস্তিতে, একটা বেশ্যাখানার পাশে। শুধুই ঘর, আর কিছু নয়। মাটিতে ঘুমাতাম চটের বস্তা দিয়ে তৈরি তোশকের উপর।
ভালই কাটছিল দিনগুলি, অর্থ ছিল, স্বাধীনতা ছিল, অসংখ্য মেয়ে ছিল, যখন যাকে ইচ্ছা ঘরে নিয়ে আসতাম। বিনোদন আর আনন্দ বলতে যৌনতাই ছিল। এটা বোধহয় স্বর্গীয় সুধার চেয়েও তৃপ্তিকর, আমি এখনো অনুভব করি তা। যদিও এ বয়সে প্রমীলা সংসর্গ আর সম্ভব না আমার পক্ষে ।
আমার কোন বন্ধু ছিল না, আসলে বন্ধু কিভাবে হয় জানতাম না আমি । এমনকি ভাঙাচোরা ঘরটাতেও একাই থাকতাম, নিঃসঙ্গ, বান্ধবহীন। তবে এই অপার একাকীত্বের অবসান হয় একরাতে অকস্মাৎই ।
সেই রাতে ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে এসে দেখি একটা মেয়ে, শুয়ে আছে আমার বিছানায়। এলোমেলো জামাকাপড়, ভাল দৈহিক গড়ন, মেদহীন সুডৌল, ঘুমাচ্ছে। কোন বেশ্যা নিশ্চয়, কিন্তু আগে দেখি নি কখনো, কামনা জাগলো না, বিরক্ত হলাম। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর বিছানায় গা এলিয়ে বিশ্রাম চাইছিল। কিন্তু মেয়েটাকে তুলে দিতেও মন সায় দিল না। অগত্যা মেয়েটার পাশেই শুয়ে পড়লাম পাশ ফিরে।
গভীর রাতে প্রচন্ড ক্ষুধায় যখন ঘুম ভাঙল দেখি মেয়েটা নেই বিছানায়। ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়ল, জরাজীর্ণ রঙ উঠে যাওয়া শাদা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। ইলেকট্রিক বাতির হলদে আলোয় ওর মুখটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো, ম্লান হাসির আভা দেখতে পেলাম ওর চোখে মুখে। আমার দিকে একটা প্যাকেট ছুড়ে দিলো, তাতে কয়েক খন্ড বাসি রুটি। রাতে খাওয়া হয় নি, তৃপ্তি নিয়ে খেলাম রুটিগুলো। অনুভব করলাম একদম ভিন্ন কিছু। আমাকে এভাবে খাবার দেয় নি কেউ এর আগে, কখনো না। এমন শান্ত আর কোমল চাহনীও পাই নি কখনো। ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরি, নিবিড় আর গভীর আলিঙ্গন যেমন হয়, এটাই বোধহয় শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার মিশেল।
আমি ভালোবাসা-স্নেহ ইত্যাকার বিষয়ের সাথে পরিচিত ছিলাম না। ভালোবাসার দৃশ্যগুলো আমাকে ক্রুদ্ধ করতো, আহত অথবা নিরাশ। আমি পথে ঘাটে দেখতাম ভালোবাসা, বাবা-মা-সন্তানদের, স্রেফ অসহ্য ছিল সেসব। কেবলই অর্থহীন মনে হতো সৃষ্টিকে আর সৃষ্টিকর্তাকে।
মেয়েটা মুখ খুললো অবশেষে, "ওরা আমাকে বের করে দিয়েছে, আমাকে নাকি সব খদ্দেররা পেতে চায়। কিন্তু এটা কি আমার ত্রুটি!" মেয়েটার গলায় মেয়েলী অনুযোগ বেশ কাতর আর অসহায় শোনালো।
"আমি তোমার সাথে থাকতে চাই এ ঘরে, যদি তুমি রাজি হও, বিনিময়ে তুমি যা চাও তাই পাবে।" চাঁচাছোলা প্রস্তাব আমাকে যুগপৎ অবাক আর আনন্দিত করলো। আমি বিনা শর্তেই তাকে থাকতে দিতে রাজী হতাম, কিছু চাওয়ার প্রশ্নই উঠে না, কেবল সেই শান্ত-স্নিগ্ধ আর নিষ্পাপ চাহনি ছাড়া।
আমরা এক ঘরেই থাকা শুরু করলাম, অবশ্যই আলাদা বিছানায়, বরং আমাদের দেখা হতো খুব কমই। আমি সকালে কাজে চলে যেতাম আর ফিরতাম সন্ধ্যায়, নুরিয়া সন্ধ্যায় বেরুতো ফিরতো ঊষায়। তবে ছুটির দিনে আমি ঘরেই থাকতাম, রাতেও। অবাক হয়ে একদিন টের পেলাম, আমি যেদিন কাজে যাই না সেদিন নুরিয়াও বের হয় না। ওই দিনগুলোতে আমি সাধারণত পাশের গণিকালয়ে যেতাম, কিন্তু দিনে দিনে ওদের প্রতি আমার আগ্রহ কমে এলো। ইচ্ছে হতো ঘরেই থাকি, নুরিয়ার কাছাকাছি, ওর গন্ধ শুষে নেই ঘরের বদ্ধ বাতাস থেকে।
এটা হয়তো অদ্ভুত, নুরি আমাকে বলেছিল যে কোন শর্তেই সে আমার সাথে থাকতে চায়। কিন্তু আমি কোনদিনই ওকে আমার বিছানায় ডাকি নি। উপকারের প্রতিদান নিতে আমি সংকোচ বোধ করেছি আজীবন, যদিও অনেকবারই ইচ্ছে হয়েছিল নুরির শরীর দেখতে, ওর ঈষৎ ঝুলে পরা ঢাউস স্তনের ভাজে মুখ গুজতে, কিন্তু পারি নি। আমি কখনোই প্রতিদান চাই নি, চাই না।
নুরি আমাকে নিয়ে কি ভাবছে স্বভাবতই তা ছিল অজানা। তবে ওর গল্প শুনতাম আগ্রহ নিয়ে। এটা নিছকই ভাব জমানোর ফন্দি, আমি বোধহয় মেয়েটার প্রেমে পরে গেছি। এটা কামের চেয়েও অধিক কিছু, দুর্দমনীয়, বিস্ফোরক।
তীব্র মনস্তাপে ভুগছি, নুরির পেশা আমাকে বিপর্যস্ত করে তুললো। অথচ সেটা বলার কোন অধিকার আমার নেই। কিন্তু বিষয়টা আমার মানসিক অবস্থাকে পর্যুদস্ত করে তুলল। নুরি অন্য কোন পুরুষের বাহুবন্দী হচ্ছে, ভাবলেই নিজের ভেতর ভয়ংকর অসহ্য অনুভূতি তৈরি হতো।
অবশেষে একদিন নুরির পথ আগলে দাঁড়ালাম, জাপটে ধরে চুমু খেলাম ওর ঠোঁটে। ফিস ফিস করে কানে কানে কিছু বললাম ওকে। নুরি বেশ খুশি হলো, দুর্লভ কিছু পাওয়ার আনন্দ ওর চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল সেদিন। শপথ করলাম পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবো আমরা।
এর কিছুদিন পরই বস্তির ঘরটা ছেড়ে দিলাম আমরা। অপেক্ষাকৃত ভাল একটা বস্তিতে ঘর ভাড়া নিলাম। ততোদিনে আমার বেতনও বেড়েছে কিছুটা। সুখের দিনগুলো কাটছিলো তুমুল প্রেম আর স্বপ্নের মাঝে। কাম কেবল তখনই স্বর্গীয় অনুভূতি দিতে পারে যখন তাতে প্রেম থাকে পুরোমাত্রায়।
দিনগুলি সোনায় মোড়ানো ছিল, তাতে কেবল কমতি ছিল নিরানন্দের। অথচ হায়! একদিন কারখানা থেকে ফিরে শুনি নুরি মারা গেছে। মেরে ফেলেছে কেউ, আরো কিছু। নুরির পেটে তখন আমার অনাগত সন্তানের ভ্রূন।
আমি নিঃশব্দে চলে এলাম, পেছনে পরে রইলো নুরি, আমার অনাগত সন্তান, যার নাম আমরা ঠিক করেছিলাম জরি। নুরির মৃত মুখ দেখি নি আমি। দেখার ইচ্ছাই হয় নি এতটুকু।
সেদিনের রাতের ট্রেনটা একটু বেশিই গতিতে চলছিলো বোধহয়। ট্রেনের ছাদে বসে আছি একা, নুরিকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি বহু দূরে। পাতলা জামা ফুঁড়ে ঠাণ্ডা বাতাস কাঁপিয়ে দিচ্ছে, অসাড় করে দিচ্ছে শরীর। নির্নিমেষ চাঁদ দেখছি। মৃত্যু কি আকস্মিক, প্রলয়ের মতো, পলকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব, ভালোবাসা-প্রেম-স্বপ্ন, নিস্পাপ হাসি, অদৃশ্য ব্যথা, সব।
তখন আমার বয়স কেবল বাইশ, আর আজ বাহাত্তর। টেরও পাই নি, বেচে থাকার তীব্র চেষ্টা-আকুলতা কখন মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে এসেছে আমাকে। অথচ নুরি! এখনো সেই তরুণীই রয়ে গেল। উনিশ বছর বয়স, শ্যামল মুখের সোনালী হাসি ছড়িয়ে উকি দিয়ে যায়, আজও।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১৭ রাত ১০:৩৫