আপনি মৃত্যু দেখেছেন কখনো ,ভয়ংকর অথবা করুন মৃত্যু ?ঝট করে মাথাটা ঘুরালাম আমি ।শীতল গলায় বললাম , না ।তবে মৃত্যু আমি অনুভব করি ।এটা বিশ্রী ,কুৎসিত একটা ব্যাপার ।যদিও আমি এখনো তাকে দেখি নি কাছ থেকে ,দেখতে চাইও না ।এরপর একটু থেমে বললাম ,এ মুহূর্তে ভাবতেও না ।স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ আমার চোখে-মুখে ,কপাল কুঁচকে উঠলো ,তবু মেয়েটা পিছিয়ে গেল মনে হলো না ।তাই আমিই মুখ ঘুরিয়ে বসলাম ।
রোদটা বেশ ঝাঝালো নয় ,কিছু বাতাসও আছে ।ঝিরঝিরে হাওয়ায় হৃদয়ের কোথায় যেন হু হু করে উঠলো ।আমি মাথা উচু করে দেখতে চাইলাম আদিগন্ত ।শান্ত সাগর ,জলও ।কয়েকটা মাছ ধরা ট্রলার ভাসছে বিক্ষিপ্তভাবে ।পাটাতনে রোদে পোড়া তামাটে বর্নের জেলেরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে ,গালাগালি করছে উচ্চস্বরে ,খিস্তি করছে ,হাসছে গলা ফাটিয়ে ,রসালো কৌতুক করছে হয়তো ।নীচু পেশার অশিক্ষিত লোকজনের কাছাকাছি আমি প্রায়ই যাই ,এরা বেশিরভাগ সময়েই সহজ ,শান্ত ,দিলখোলা ,বেশ রসবোধসম্পন্ন ।স্থুল হলেও তাদের কৌতুক হয় প্রানবন্ত ,প্রানখোলা ।একটা নির্দোষ সরলতা থাকে তাতে ।
জাহাজের ছাদে বসে আছি ,আরো দুয়েক জনও ।জাহাজটা বোধহয় সেন্ট মার্টিন যাবে ।সেরকমই কথা ।মেয়েটার ওপর চোখ পড়লো আবার ।শঙ্কা হলো অল্প ।একে সাধারন মেয়ে বলা যায় না কোনভাবেই ।সংশয়হীন কথা বলার ভঙ্গি ,ব্যক্তিত্বময় চাহনি-পদচারনা ,সহজেই চোখে পড়ার মতো ।বিশেষ করে আমার চোখে ।পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর বুদ্ধি নিয়ে মনে মনে বেশ গর্বই বোধ করি আমি ।আমার পর্যবেক্ষণ আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে মেয়েটা নির্ঘাত পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের জুনিয়র অফিসার ।পুলিশে ইদানীং কিছু মেয়ে অফিসার নেয়া হচ্ছে ।এরা দৈহিকভাবেও বেশ আকর্ষনীয় ,অবশ্য আমি যাদের দেখেছি ,এই অফিসারটাও ।যদিও জিন্স আর টপস পড়ে আছে ,তবু ওকে চিনতে পেরেছি আমি ।ঢাকা থেকেই পিছে লেগে আছে ।খুব রাগ হচ্ছে এ মুহূর্তে ।সুযোগ থাকলে হয়তো ওকে এখনিই মেরে ফেলে দিতাম সাগরের নীল জলে ।হাঙরের খাবার হতো ,খুনের কোন চিহ্নই থাকতো না ।যদিও তা বেশ কঠিন ।
আমার স্ত্রীকে খুন করার আগেও প্রচুর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম ,পড়াশোনা করেছিলাম ।এলান পো পড়েছি ,শার্লক সিরিজ শেষ করেছি আবার ছেলেবেলার মতো ,হিচকক দেখেছি ,আরো অনেক ।তবু কিভাবে যেনো সবাই টের পেয়ে গেল ,সন্দেহ করতে থাকলো আমাকেই ।যদিও তা এখন পর্যন্ত অপ্রমানিত ।তবে ওরা যে আমাকেই খুনী ভাবছে তার প্রমান পুলিশের অফিসারটা ।যদিও কেউ নিশ্চিত নয় আমি কেন সেন্ট মার্টিন যাচ্ছি ।হয়তো ভাবছে পালাবো ।সেটা হাস্যকর ভাবনা হবে ।পালানোর জন্য বহু সহজ ছিদ্র পুরো বাংলাদেশ জুড়ে রয়েছে ।
আমি পুলিশ অফিসার মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম ।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সে ।বললাম ,
- মৃত্যু সর্ম্পকে তখন আমি মিথ্যে বলেছিলাম আপনাকে ।আমি মৃত্যু দেখেছি ।ভয়াবহ-বিভৎস মৃত্যু ।যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু ।মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো ,- সব মৃত্যুই যন্ত্রনাদায়ক ।অতি চালাক ,ধুরন্ধর অথবা মহামানবদেরও ।
স্পষ্ট ইঙ্গিত ।তবে রাগ হলো না ,কৌতুক বোধ করলাম ।এই নবীন পুলিশ অফিসার খুব শীঘ্রই ধাক্কা খাবে ,বিষম বিস্মিত হবে ।কাউকে বিস্মিত করতে পারলে বেশ আনন্দ অনুভব করি আমি ,একেবারে ছেলেমানুষি অনুভূতি ।তবে দূঃখ হচ্ছে এবারের আনন্দটা উপভোগ করা হবে না আমার ।মেয়েটাকে আর বলার সুযোগ না দিয়েই নিচে নেমে এলাম ।
জাহাজটা নতুন ,আধুনিক সুযোগ সুবিধাও আছে পর্যাপ্ত ,বেশ আরামদায়ক ব্যবস্থা ।প্রায় আসনই পূর্ণ ।আমি পিছনের দিকে ফাঁকা কয়েকটা সিটের মাঝে গিয়ে বসলাম ।সামনের সারিতে অষ্টাদশী কয়েক তরুনী সেলুলার ফোনে নীল ছবি দেখছে আর হাসাহাসি করছে ।এক পলক মাত্র দেখলাম ,টের পেয়ে তরুনীরা একটু অপ্রতিভ হলেও খুব গুরুত্ব দিলো না আমাকে ।এটা ভাল ,অহেতুক অন্যদের গুরুত্ব দিয়ে নিজের স্বকীয়তা হারানো নিরর্থক ,নির্বুদ্ধিতা ।সব কিছুর আগে নিজের সত্ত্বাকেই গুরুত্ব দেয়া উচিৎ ।
আমি জানালার বাইরে চোখ রাখলাম ।কয়েকটা কাক উড়াউড়ি করে চলছে জাহাজের সাথে সাথে ।ওদের অনবরত তীক্ষ্ণ আর কর্কষ চিৎকার অল্পক্ষণেই মনটা বিষিয়ে দিতে সক্ষম ।আমি ভালোবাসি মসৃন সুর ,কোমল অথবা হৃদয়গ্রাহী ।ইরা অসাধারণ ভালো গান করতো ,অদ্ভুত সুরেলা ,মায়াময় একটা গলা ছিল ওর ।
আমি ওকে ভালোবেসেছিলাম ,অসংখ্য গুনের অধিকারী ছিল সে ,গানও অন্যতম ।বহু উদ্ভাসিত জোছনা ভরা রাত আমি কাটিয়েছি নির্ঘুম ,ইরার গান শুনে আর ওর কোলে মাথা রেখে ।পূর্নিমার আলোয় পুরো পৃথিবীকে মনে হতো স্বর্গ উদ্যান ।চাঁদটাকে মনে হতো দেবী ,দ্যুতিময় কোন নিষ্পাপ অপ্সরা ।নিশ্চুপ দাড়িয়ে থাকা শিরিষ গাছের সারিকে মনে হতো স্বর্গের প্রবেশ দ্বারের অতন্দ্র প্রহরী ।আমি আচমকাই ইরার গালে ছো মেরে চুমু খেতাম ,ও বিরক্তির কৃত্রিম ভান করতো ,ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইতো ।আমি ওর কোমর জড়িয়ে ধরতাম আরো শক্ত করে ।কি অকৃত্রিম ,সীমাহীন ভালোবাসাবাসি করেছি দুজনে ।অথচ আশ্চর্য কি !আমি ওকে খুন করেছি ,সুপরিকল্পিতভাবে,ঠান্ডা মাথায় ,অতঃপর এখন... ।
মেয়ে পুলিশ অফিসারটার জন্যে মায়া হলো ,সে কোনরুপ সফলতাই দেখাতে পারবে না ,পুরস্কার দূরে থাক ।অবশ্য কিছু শিক্ষা পেতে পারে ,যদি সে নির্বোধ না হয় অন্য অনেকের মতোই ।
চোখ সরাতেই ডাঙার মতো দেখতে পেলাম ।তাল গাছের ন্যায় উচু উচু নারকেল গাছের সারি চোখে পড়লো ।এটাই সেন্ট মার্টিন ।একেবারে অপরিচিত নয় জায়গাটা ।ইরা আর আমি কয়েকবার এসেছিলাম এখানে ,বিয়ের আগেও ।বেশ মজার অভিজ্ঞতা ছিল তা ।আমরা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া দুই তরুন-তরুনী স্বামী-স্ত্রীর কাঁচা অভিনয় করতাম ।সবাই বুঝতো ব্যাপারটা ,হয়তো কৌতুকও বোধ করতো ।
ইরা সমুদ্র ভালোবাসতো ,বিশেষত ছেঁড়া দ্বীপের অপার্থিব নির্জনতা ।প্রকৃতির অনিঃশেষ নিবিড়তা ওকে টানতো খুব ।ও জড়িয়ে ধরতে চাইতো স্ফটিকের ন্যায় নীল জল ।বলতো এমন স্বচ্ছ আর নীল জল বাংলাদেশের অন্য কোথাও নেই ।সেই নীলে বিলীন হতে চাইতো সে ।
এটা সত্যি ,আমার ভালোবাসায় বিন্দু পরিমান খাদও ছিল না ।ইরারও কি ?তবে ইরা ডিভোর্স কেন চেয়েছিল ,আমি হয়তো নপুংসক ছিলাম ,শরীরী ভালোবাসার ক্ষমতা হয়তো একপর্যায়ে আমি হারিয়ে ফেলেছি ,কিন্তু হৃদয়ের কি কোন মূল্য নেই ?এতোগুলো বছর একসঙ্গে থাকার পর মানুষ কিভাবে একজন অন্যকে ছুড়ে ফেলে নির্দ্বিধায় !
অবশেষে সেন্ট মার্টিনের শুভ্র বালিতে পা রাখলাম ।একটা সূক্ষ্ম বেদনাবোধ আমাকে গ্রাস করলো ।কয়েকটা মাঝবয়সী সিগাল অবিরাম মাথার উপর বৃত্তাকারে উড়ছে আর উচ্চস্বরে চিৎকার করছে ,ওরা কি টের পেয়েছে আমি শীঘ্রই ইরার প্রিয় ছেড়াদ্বীপের স্ফটিকের ন্যায় নীল জলে বিলীন হতে চলেছি ।ওদের উচিৎ হবে বিষয়টা চেপে যাওয়া ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০২১ দুপুর ১২:৪৬