আমার বিয়ে হয়েছিলো মাঘ মাসের উনিশ তারিখে আমি প্রতিদিনের মতনই স্কুলে গিয়েছিলাম ক্লাস নিতে। পড়াশোনা ইন্টারের পর আর হয়নি অভাব অনটনে আর বখাটেদের উৎপাতে সেটা ছেড়ে দিয়েছিলাম তখন প্রায় পাঁচ বছর।
আমি ছিলাম একটি প্রাইমেরি স্কুলের শিক্ষিকা অন্যান্য সহকর্মীদের থেকে কম শিক্ষিত ও কম অভিজ্ঞ, এইকারনে আমার বেতন ছিল অন্য সব সহকর্মীর তুলনায় কম আর সব শিক্ষক শিক্ষিকাদের বেতন প্রদান শেষ হলে পরেই কতৃপক্ষ কর্তৃক মাসের মাঝামাঝি এসে আমার বেতন পরিশোধ হতো, আমি বরাবরই ছিলাম ভাগ্যহীন।
ঘটনার দিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর মা বাবা ও ছোট ভাইবোনের মুখে শুনলাম যে ওই দিনই আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে, বর পক্ষ ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছেন উনারা সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাবেন বলে বাবা আশা করে আছেন।
বাবা এও ভাবলেন যে ছেলে শহরে থাকেন ও নিজের ফ্যাক্টরি সহ চারতলা বাড়ি আছে কাজেই ছেলে যথেষ্ট ভালো ও মহামূল্যবান, এমন পাত্র বোকারাও হাতছাড়া করেন না।
মেয়েরা নিম্নবিত্ত পরিবারের এমনই এক বোঝা যে এদের যে করেই হোক বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারাটাই সব থেকে জরুরী মনেহয় অভিভাবকদের, তারপর সেই মেয়ে মরুক বাঁচুক পরিবারের সদস্যদের তাতে কিছুতেই কিছু যায় আসে না।
আমি একটু মিন মিন করে এভাবে না জেনে ছেলের ও তার পরিবারের খোঁজ খবর না নিয়ে বিয়ে করা ঠিক নয় বলে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মায়ের অসহায় দুঃখী চেহারাটা আমায় নিতান্তই বাধ্য করেছিলো সব রকম অন্যায় মেনে নেয়ার জন্যে অন্ধ ও বধির হয়ে যেতে।
বিয়ের রাতে দেখলাম যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে উনি মোটেও ছেলে নয় বয়স পঞ্চাশ তো হবেই। ভাসা ভাসা এও কানে এলো আগে আরও দুইটা বিয়ে হয়েছিলো, তার মায়ের মতে উনারা খারাপ মেয়েমানুষ ছিলেন কাজেই তার ছেলের মতন এরকম দেবতার ভাত নষ্ট মেয়েলোকেরা খেতে পারেন নাই, কোন ছেলেমেয়েও তাদের হয়নাই সম্ভবত উনারা বন্ধ্যা মেয়েলোক ছিলেন।
কথাগুলো শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো, আমিও কি উনার মতে নষ্ট মেয়েলোক হবো কোন একদিন, কী ভয়ংকর!
ঐ রাত থেকে আমি চোখ মুখ বুজে সমাজের নিয়মের সাথে; তাদের সাথে; তাল মিলিয়ে চলতে চেষ্টা করলাম।
বিয়ের তিন দিনের মাথায় বর প্রথম গায়ে হাত তুললেন, ব্যাপারটা কি হচ্ছে বুঝতে অনেকক্ষন সময় লাগলো, মাথার মধ্যে দুই তিনটা লাথি আর পিঠে ঘুষিতে ঘুম ভাঙলো, এত বেলা পর্যন্ত কেন ঘুমাচ্ছি এই অপরাধে, বাসায় তার আত্মীয়-স্বজন এসেছিলেন, রান্নাবান্না করে সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে ধুয়ে মুছে সব পরিষ্কার করে আগের রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে ভোর রাত হয়ে গিয়েছিল কিনা! ঘটনার আকস্মিকতায় থরথর করে কাঁপছিলাম ঘুম আমার তখনও কাটেনি, আসলে অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিলো, সকালের নাস্তা কারো হয়নি তখনো এটা নিশ্চয়ই লাথি খাওয়ার মতন অপরাধই হয়েছে আমি মেনে নিয়েছি।
এইভাবে আমি আমার নতুন অসহায় জীবনের সাথেই দিন দেখি রাত দেখি বাইরে বের হই আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাই। হেসে হেসে কথা বলি।
এইরকম ভাবে বছর দুই কেটে গেলো, আমার কোল আলো করে এলো আমার প্রথম সন্তান, ভাবলাম বন্ধ্যা নামটা ঘুচেছে বুঝি। কিন্তু বাবু মেয়ে বলে স্বামী শশুর শাশুড়ির কাছ থেকে প্রতিদিন শুনতে হতো গালি কখনো কখোনো চড় থাপ্পর। কেননা তাদের বংশের প্রদীপ দেয়ার জন্য ছেলে সন্তান দরকার। মেয়ে কোন মানুষের পর্যায়ে পড়ে নাকি!! ঐভাবে আরও একটা বছর কেটে গেলো। আমার গর্ভে আর সন্তান কেন এখনও আসছেনা তাই অত্যাচারের আরেক কারন বেড়ে গেল।
আমি কেবল দাঁত মুখ চেপে সহ্য করতে থাকলাম যন্ত্রনা।
এমনি এক দুঃসময়ে একদিন এক অদ্ভুত
মেয়েকে দেখলাম। মেয়েটিকে আমি একবার দেখলে হয়ত অত মাথা ঘামাতাম না। কিন্তু পরপর অনেকবার দেখা হওয়ায় ব্যাপারটা আমায় ভাবাচ্ছিলো।
আমি মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিলাম শপিংমলে সে হেসে হেসে ২টা মেয়ের সাথে খুব জমিয়ে গল্প করছিলো, কেউ বলে না দিলেও বোঝা যায় ওর কথার উপরে একটা কথা বলার সাহস মনে হয় না অন্য কারো কখনো হয়েছে, এমন মেয়ে হয় পৃথিবীতে! আমি বিস্মিত।
মেয়েটিকে রূপবতী বললে ভুল বলা হবে তবে অদ্ভুতও, আর তুলনারও উর্ধে, ওর স্বচ্ছ কাঁচের মতন ত্বক অদ্ভুত তেজী চোখ স্বাভাবিক ভাবেই ভীষণ রকম আলাদা করে ফেলে সব মানুষ থেকে।
আমি একটা মেয়ে হয়েও বার বার ঘুরে ঘুরে মেয়েটিকে দেখছিলাম কারন, হয়তো কখনো নিজেকে ওর মতন এই রকম একটা মেয়ে হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম।
মেয়েটা আমার দিকে একবারও তাকায়নি তবু যতবার আমি ওর দিকে তাকাচ্ছিলাম একটু অজানা অস্বস্তিতে চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছিলাম, কেনোনা আমার ভীষণ রকম মনে হচ্ছিলো মেয়েটি এত দূর থেকেও আমার ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারছে সে আমাকে জানে, জানে আমার প্রতিদিনের লজ্জিত ব্যথিত জীবন।
ওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওকি আমার দিকে চেয়ে ঈষৎ হাসলো!! কি জানি!
আমার সাথে আমার দিগুন বয়সের কুৎসিত স্বামী বিকট শব্দ করে নাক দিয়ে গোৎ গোৎ শব্দ করতে করতে আমার পিঠে হাত রাখতে রাখতে বলল খানকী মাগী এদিক ওইদিক কি দেখোস আরো বিয়া বসার শখ হইছে নাকি? জামাই খুঁজোস? আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম! আশেপাশের মানুষ কি শুনতে পেয়েছে কিছু!!!
মেয়েটিকে আরেকদিন দেখলাম বাসে, গাড়িতে উঠেই দেখি সে সামনের দুই সারি পরেই বসা, সাথে ওই মেয়ে দুইটিও, একই রকম মেয়েটি আমার দিকে তাকাচ্ছে না, যদিও মনে হচ্ছিলো ও আমাকে দেখছে, আমার স্বামী জানালার পাশে বসেছিলো বাসে উঠলেই সে বাঁধ ভাঙ্গা বানের জলের মত হরহর করে বমি করে, এত বমি কি করে আসে কে জানে! সেদিনও একই ঘটনা, বাসে উঠেই সে তার কুৎসিত বমি শুরু করলো, মেয়েটি আমাকে দেখছে না কিন্তু আমার কেন মনে হচ্ছে যে ও আমার দিকেই চেয়ে আছে!! এবং এই যে আমি যন্ত্রনায় লজ্জায় একদম মরে যাচ্ছি ও যেন তা বইয়ের পাতার মত পড়ে ফেলতে পারছে।
আমার দিগুন বয়সের স্বামী বমি করেই যাচ্ছে দুই এক সেকেন্ডের জন্য আমার দিকে ফিরে কুৎসিত হাসি হাসছে, একবার বলল মাগী পানি দে পানি নিয়া আসোস নাই!! আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো বাসের জানালা দিয়ে বাইরে ঝাঁপিয়ে পরে পালিয়ে যেতে। আমার বাচ্চা মেয়েটি সেদিনই আমাদের সাথে প্রথম বাসে চড়েছে , সে তার বাবার এই রুপের সাথে পরিচিত নয়, বার বার আমাকে বলছে মা মা বাবা বোধহয় মরে যাচ্ছে। বাবা বোধহয় মরে যাচ্ছে।
সত্যি সত্যি যদি মরে যেত!!
মেয়েটিকে তৃতীয়বার দেখেছিলাম গুলশান লেকের পাড়ে। সাথে ওই দুই বান্ধবী। প্রথমে তাকে চিনতে পারছিলাম না, সে দিনের আলোয় আরও ঐশ্বরিক ঝকঝক করছিলো। কাঁচের মেয়ে; মনে মনে বললাম।
আমার স্বামী গেছে সামনের এক ঝোপে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে, রাস্তায় বের হলেই ঘন ঘন প্রকৃতি তাকে ডাকে। আমার ধারনা তার ডায়াবেটিস আছে। ঝোপ থেকে বের হয়ে এসে বলল বেশ্যা নিয়া সংসার করি কোথাও গেলে কত যে জ্বালা! এসব নিয়ে রাস্তা ঘাটে চলা যায়! লজ্জায় ঘৃণায় আমার চোখ ভরে এলো জলে, টপ টপ করে পড়লো গাল বেয়ে, সারাক্ষন এসবই শুনতে হয় তবু কেন যে এত কষ্ট লাগে!
আমি মেয়েটিকে চতুর্থ বারের মত দেখেছিলাম! অবশ্য ওটা ছিল চতুর্থ এবং শেষবার। এরপর মেয়েটিকে আর কখনো দেখিনি। যদিও আমি মনে প্রানে চাই মেয়েটির সাথে আমার আর একবার দেখা হোক। ওকে একটু জড়িয়ে ধরে কাঁদার জন্য হলেও আর একবার দেখা হোক।
সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত, আকাশে রূপালী রঙের ঝকমকে চাঁদ উঠেছে। দিনের আলোর মত স্বচ্ছ সব। আমি আমার শ্বশুর বাড়ির চারতলার ছাঁদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম। সব কিছু এত পরিস্কার!! আমার শ্বশুর বাড়ির সামনে দিয়ে যে মেঠো পথ এঁকেবেঁকে একবারে নালায় যেয়ে মিশেছে সেই পর্যন্ত সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো, এমনি কোন এক সময় উনারা এলো ঠিক আমার পেছনে, আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে যাব এমন সময় তাদের একজন পেছন থেকে আমার চুলের মুঠি খামচে ধরলো, চুলের মুঠি সম্ভবত আমার স্বামী ধরেছিলো কেনোনা পেছন থেকেও আমি তার মুখের কড়া গ্যাসটিকের পঁচা গন্ধ পাচ্ছিলাম।
আমি ধরে নিয়েছিলাম ওটা আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত। আজ কিছু একটা যে হবে আগেই অনুমান করেছিলাম তার মায়ের মুখের উপড় জবাব দিয়েছি কিন্তু প্রানে মেরে ফেলতে চাইবে ভাবিনি।
মার কথা মনে পড়ছে, আমার মা! কই আমার মা! আমার এত বিপদে সে কই! সে কি কিচ্ছু টের পাচ্ছে না!! কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই হাত মুখ বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে পেছন থেকে উঁচু করে খুব দ্রুতগতিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো আমাকে।
আমি নীচে পড়ে গেলাম না। পড়ে যেতে যেতে অনুভব করেছিলাম আমি স্থির হয়ে আছি, বাতাসের উপর ভাসছি। আগুনেও পুড়ছি না আগুনটা আরামদায়ক আর ঠান্ডা।
খুব মমতা নিয়ে সেই কাঁচের মেয়ে আর তার দুই সাথী আমার মুখের দিকে ঝুঁকে আছে।
হায় তাদের দুই চোখ দিয়ে কি কাচের জল গড়িয়ে পড়ছে। কি অদ্ভুত দৃশ্য! এত রাতে এখানে এলো কি করে!
এরপর কত কিছু হয়ে গেলো! সেসব আর কিছুই মনে পড়েনা।
আমি আমার মেয়েটিকে নিয়ে এখনও বেঁচে আছি, সে এবার একুশ বছরে পা দিবে। মাঝে মাঝে তার চেহারা কাঁচের মত ঝকমক করে ওঠে আর আমি ভেতরে ভেতরে ভীষণ চমকে যাই।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:০৯