ছবিঃ ছেড়া দ্বীপ
আমার জীবনের প্রথম ভ্রমন। সমুদ্র ভ্রমন। (পর্ব-১)
আমার জীবনের প্রথম ভ্রমন। সমুদ্র ভ্রমন। (পর্বঃ ২)
আমার জীবনের প্রথম ভ্রমন। সমুদ্র ভ্রমন। (পর্বঃ ৩)
রুমে ফিরে ইরা আপু তার শপিং গোছাতে বসলো, ম্যাডাম নামাযে, চিফ ফিনান্সিয়াল স্যারের পিচ্চি মেয়েটা এসেছে গল্প শুনতে চায়, ছন্দা লো ভলিউমে গল্প শুনাচ্ছে ওকে, আমি বালিসে গা এলিয়ে নেটে ঢুকে টাইম পাস করছি। নেট দেখলাম খুবই ভালো বুঝলাম না সবাই কেন নেটওয়ার্কের বাইরে বাইরে করে এখানে এলেই! নেটওয়ার্ক তো ঠিকই আছে!!
রুমের দরজায় কেউ একজন নক করলো, দরজা খুলে দিতেই আমাদের কলিগ মাহমুদ ভাইয়ের বউ ঢুকল রুমে, ওষুধ চাইলো তার নাকি মাথা ব্যথা করছে আর ভাইয়ার গ্যসট্রিক সমস্যা! কে নাকি বলেছে আমাদের রুম ওষুধের গোডাউন!
আমি মাথা ব্যথার বাম আর টাফনিল দিলাম, সারজেল দিলাম, ইরা আপু ইমোটিল আর এলাট্রল দিলো, ছন্দা নাম মনে নেই আরও একটা মাথা ব্যথার ওষুধ দিলো। ভাবী নানারকম ওষুধ নিয়ে খুশিতে ডগমগ করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
আমরা রোজ কি পরিমান পরিশ্রম করি তার উদাহরণ হল এই ওষুধ! কর্পোরেট লাইফ এমনই এক যান্ত্রিক জীবন যেখানে অসুস্থ হওয়াকে শরীরের কষ্টের চাইতে ঝামেলা মনে হয়, sick হওয়া মানে Leave নেয়া। Leave নেয়া মানে Pending work. Pending work মানে অনেকের কাজ আটকে যাওয়া (Accounts ডিপার্টমেন্টের কাজ একটার সাথে আরেকটা রিলেটেড থাকেই) অনেকের আটকে যাওয়া মানে অনেককে বিপদে ফেলা, অনেককে বিপদে ফেলা মানে বসের ঝারি খাওয়া, বসের ঝারি শুধু মাত্র মেনটাল টর্চার, আর কোন বাড়তি উপকার নেই এর।
এত সব কিছুর পর জমে যাওয়া ৩/৪/৫ দিনের কাজ না খেয়ে, সীট থেকে না উঠে, ডানে বামে না তাকিয়ে, ঘাড় ব্যথা রোগ বানিয়ে, মুখ একবারের জন্য ও না খুলে(কথা বলার জন্য) একদিনে কিংবা ৪/৫ ঘণ্টার মধ্যে শেষ করা।
এই ঠ্যালা সামলানোর ভয়েই আমাদের প্রত্যেকের এই মেডিসিন প্রোটেকশন! কাজ বিষয়ে আমার নিজের তৈরি এক কৌতুক আছে সেটা হচ্ছে’’একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে অফিসে ঢুকে কাজ করতে করতে টের পাবো আমি হাত দিয়ে কিছু ধরতে পারছিনা।
ধরবো কীভাবে! বডি তো পড়ে আছে বাড়িতে, কাজের প্রেসার আর টেনশনে খেয়ালই নাই যে মরে গেছি।‘’
যারা চাকরী চাকরী করে চাকরী পায়না তারা ভাগ্যবান! যারা কয়েকদিন পর পর চাকরী পাল্টায় তারা আরও ভাগ্যবান! সব চেয়ে ভাগ্যবান তারা যারা চাকরীই করেনা স্বাধীন বিজনেস করছে অথবা ভিন্ন কিছু।
হোটেল অবকাশের রাতে ফিরে আসি এখানে মনে হচ্ছে সি বীচ থেকে ফেরার পর থেকেই সবার মন অতিরিক্ত উতলা হয়ে গেছে! ঠিকই হচ্ছে না! বিশেষ করে ইরা আপুর মন অতিরিক্ত উতলা।
ছবিঃ ইরা আপু
স্যার এর মেয়েটা ছন্দাকে বেশ চাপাচাপি করছে, ছন্দা আর গল্প খুঁজে পাচ্ছে না, ওকে ভোলাতে এলোমেলো কথা বলছে গল্পের মত করে!
তাই ছন্দা কে নিতান্তই উপকারের জন্য গল্প বলার দায়িত্ব আমি নিলাম।
আমি পর পর ৩টা একি ধরনের কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির অভিজ্ঞতার গল্পকে একসাথে বললাম, তিন গল্পের গল্পকারদের একজন হলো হুমায়ন আহমেদ আরেকজন ভুত এফ,এম,এ গ্রাম থেকে আগত যুবক, আরেকজন হল সম্ভবত ইউকে বসবাসরত এক প্রবাসী যে কিনা ওখানকার এক স্থানীয় পুলিশের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে। (হুমায়ন আহমেদের অভিজ্ঞতাটি হল তার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা ''কিছু শৈশব'' নামের বইয়ে ৬৯ পৃষ্ঠায় বড়মামা এবং সুবর্ণরেখা শিরোনামে লেখা।
যাই হোক তিনজন আলাদা আলাদা ব্যক্তির একিরকম অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতা হল তারা প্রত্যেকে সদ্য কাটা কবরের ভেতর লাশ নামানোর আগে তারা নেমে শুয়ে পরেছিল নিতান্ত কিউরিসিটির জন্য, ফলাফল তিন জনেরই একই, তারা অবশ এবং ভারসাম্যহীন দোদুল্যমান দৃশ্য অদৃশ্য জগতে হারিয়ে যেতে যেতে অনুধাবন করছিলেন অদ্ভুত চেতন অচেতন সমস্ত জীবন এবং তলিয়ে যাচ্ছিলেন গভীর অন্ধকারে। সেটি শব্দহীন অন্ধকার অন্য একটি জগৎ। বর্ণনা শুনে সবাই তাজ্জব এবং বাকরুদ্ধ হয়ে রইলো একেকজন।
অনেক সময় রুম চুপচাপ। কেউ যেন কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না, অবশেষে নিরাবতা ভেঙ্গে ম্যাডাম বলল ইতি তো অদ্ভুত সুন্দর করে গল্প বলতে পারো। তারপর বিরবির করলো; হুমায়ন আহমেদ লিখলে মিথ্যা লিখবেনা সত্যিই সত্যিই এমনটাই ঘটেছে!আশ্চর্য!
তারপর ম্যাডাম শুরু করলো তার সেন্সেটিভ লাইফ হিস্ট্রি। ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ৩টা।
ভোর ৫টা কিংবা তার কিছু আগে বুঝলাম ম্যাডাম সহ ইরা আপু আর ছন্দা কোথাও যাচ্ছে আমি ঘুমের মধ্যে ব্যাপারটা টের পেয়ে বললাম আমিও যাবতো তোমাদের সাথে!
ম্যাডাম বলল আমরা কোথাও যাই নাতো বাবু তুমি ঘুমাও!সে আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিতে দিতে বলতে থাকলো আহারে বাচ্চাটা বাচ্চাটা বাচ্চাটা! সে কতবার বাচ্চা বাচ্চা করছে!!
রুমে কত বাচ্চা!? এরপর তেমন কিছু শুনতে পেলাম না ফিঁসফাঁস টুকটাক আওয়াজ করে তারা কই যেন চলে গেলো! ঘর নিরব হতেই ঘুমাতে ঘুমাতে মাথায় এলো গতকালের বাচ্চাটা কি তবে আমাদের রুমে ছিল!এখনো কি আছে! কই! আমার খাটে না পাশেরটায়??!
নাহ এত টেনশন নিয়ে আর চোখ বন্ধ করে রাখা যাচ্ছে না!
চোখের পাতা খোলাই যাচ্ছেনা এমনি অবস্থা নিয়ে জোর করে তাকালাম, রুম খালি কোন বাচ্চা কাচ্চা নেই! ওয়াশ রুম খোলা সেখানে ঘন অন্ধকার, আকাশে রক্তিম আভা, পুরা রুম খালি। লাফ দিয়ে উঠে বাইরে বেরোলাম বাইরে কেউ নেই সেখানে লম্বা বারান্দা শুনশান ফাঁকা, ভেতরে অন্ধকার কারেন্ট নেই, সূর্যের আলো নেই! শুধু আকাশ জুড়ে রক্তিম আভা।
ছবিঃ আকাশ জুড়ে রক্তিম আভা।
তিরিশ মিনিট সময় কাটলো রুমে ঢুকে আর বের হয়ে, এক সময় দূর থেকে দেখলাম তারা আসছে, তারা সি বীচে নামাজ পড়তে গিয়েছিল!
হায়রে ঢঙ!!
সকালে নাস্তা সেরে ছেড়া দীপের উদ্দেশে স্প্রিড বোর্ডে রওয়ানা হলাম! বিশাল বিশাল নীল জলের ঢেউ কেটে অল্প সময়েই ছেড়া দ্বিপ পৌঁছে গেলাম।
ছবিঃ দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ছেড়া দ্বীপ
ছবিঃ নীল জল ঢেউ
ছবিঃ দ্বিপে উড়ছে জাতীয় পতাকা
তীরে যেতে আলাদা নৌকা ব্যাবহার করতে হল, তারপর ৪০/৫০ গজ প্রবালের উপর হাঁটার পর সব শেষে দ্বীপের মাঝামাঝি অংশে বালি। পুরা প্রসেসিংটাই বিপদজ্জনক, যে কোন বিপদ হতেই পারে; যে কোনখানে, এখন বুঝতে পারছি প্রতি বছর এখানে মানুষ বেড়াতে এসে কিভাবে মরে যায় ১! অজ্ঞতা ২! প্রিপারেশন ছাড়া আসা! ৩! অপার সমুদ্রের তীব্র উচ্ছাস আর টান।
দ্বীপে প্রবাল আর নারকেল গাছ এবং অনেকখানি স্থান জুড়ে কেয়া গাছের ছড়াছড়ি! মানুষের বসতি সেখানে নেই।
ছবিঃ ছেড়া দ্বীপের ধারালো সব প্রবাল, এগুলো হেঁটে পার হয়েই সমান্তরাল স্থানে যেতে হয়।
বেড়ার ছাদ দিয়ে এক স্থানে প্লাস্টিকের কিছু চেয়ার দিয়ে বসার স্থান, সেখানে চা, সিগারেট, কোল্ড ড্রিংকস, পানি এবং অন্যান্য হাল্কা খাবার পাওয়া যায়। প্রচুর ডাব নিয়ে একজনই ডাবওয়ালা তার হাত খুবই দ্রুত, একের পর এক ডাব কেটেই যাচ্ছে খুবই অল্প সময়ে।
ছবিঃ খাবার স্থানে বেড়ার ছাদের সামান্য অংশ
ছবিঃ আয়েশ করে ডাবের দোকানে বসে চা পান করছে আমাদের গ্রুপের কলিগ ভাইয়া
সেখানে আমরা উপভোগ করলাম তীব্র রোদ! চোখ ঝলসে যাওয়ার মত আলো।
(ওখানে যাওয়ার সময় সানগ্লাস এবং ছাতা অবশ্যই অবশ্যই নিয়ে যাওয়া আবশ্যক)কেয়া গাছ, কখনো দেখিনি এরকম ফল, রুক্ষ পা কেটে যায় এমন হাজারো প্রবাল, প্রচুর লবণাক্ত ঘন নীল পানির নীচে সাঁতার কাঁটা মাছ, কাঁকড়া, জোয়ার ভাটা ইত্যাদি
ছেড়া দ্বীপ হচ্ছে চারদিকে স্বচ্ছ কাঁচের মত নীল পানি আর প্রবালে তৈরি এক খণ্ড ভিন্ন জগৎ।
ছবিঃ অচেনা ফল
ছবিঃ দ্বীপের কাঁকড়া
আমরা দুই ঘণ্টা ছেড়া দ্বীপে কাটিয়ে ফিরে এসে তিনটার দিকে হোটেল অবকাশের পাট চুকিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। জাহাজ ভিড়লো টেকনাফ পোর্টে।
ওখানে আমাদের বাস অপেক্ষা করছে হোটেল কক্স টুডে নিয়ে যাবার জন্য। ব্যাগ লাগেজ নিয়ে আর সবার সাথে হেঁটে হেঁটে বাসের দিকে যাচ্ছিলাম চোখ পড়লো একজন মধ্যবয়সী মহিলার দিকে, দ্বিধাগ্রস্ত আর বিপদ যুক্ত চেহারা, তিনি এদিক ওদিক ঘন ঘন তাকাচ্ছে! যেতে যেতেই তাকে বললাম কি হয়েছে! বলল ছেলে মেয়ে নাতি নাত্নির সাথে এখানে বেড়াতে আসছে, কিন্তু জাহাজ থেকে বের হয়ে আর কাউকে খুঁজে পাচ্ছেনা এক সাথেই ছিল!
বললাম ফোন করেন, তার মোবাইল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল ফোন তো যায় না একটু দেখোনা কি হইছে, দেখলাম তার ফোনে এয়ারপ্লেইন মুড দেয়া কীভাবে হয়েছে বলতে পারেনা, এয়ারপ্লেইন মুড কি তাও সে বোঝেনা।
এয়ারপ্লেইন মুড অফ করে তার হাতে মোবাইল দিতেই সাথে সাথে ফোন করে তার ছেলেকে সে পেয়ে গেলো। কাছাকাছিই ছিল সবাই কিন্তু লোকজনের ভীরে দেখতে পায়নি। আমায় ধন্যবাদ দিলো ওরা, হ্যাপি ফ্যামিলি।
ব্যাপারটা উপভোগ করতে না করতে আমার ফোন বেজে উঠলো! প্রশ্ন আমি কোথায়! সবাই বাসে উঠে গেছে আমার জন্য টেনশন করছে।
দৌড়ে বাসে উঠে দেখি চারদিকে রাগ রাগ আর রাগ। বেশি রাগ করলো আমার ডিপার্টমেণ্টের স্যার আর তার সমবয়সী অন্য ডিপার্টমেণ্টের স্যার। তাদের দুইজনেরই বয়স সত্তুর ছুঁই ছুঁই। টেনশনে তারা এত রাগ করছে, খানিকটা মন খারাপ হল!
চুপ করে সীটে বসতেই স্যারের কোলের উপর থেকে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিলো, প্রচুর বিরক্ত হয়ে বললাম কি এটা! ইরা আপু সাইড থেকে বলল ইউনাইটেড ল্যান্ডপোর্টে ফেলে আসা তোমার জুতা! ওরা দিয়ে গেছে!
বিস্মিত হলাম! স্যার আমার জুতা হাতে নিয়ে বসে ছিল আমাকে দেবে বলে! কি আশ্চর্য! !বাসে অনেক জায়গা যে কোনখানে ফেলে রাখলেও আমি সেটি পেতাম! তবু সে সেটা ধরে রেখেছে! যদি আবার হারিয়ে যায় সেই ভয়ে!!
আমি লুকিয়ে আবার একটু স্যারকে দেখলাম তার প্রসন্ন মুখমণ্ডলে বাবার ছায়া!!!।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৬