আমার জীবনের প্রথম ভ্রমন। সমুদ্র ভ্রমন। (পর্বঃ ২)
বিকেলের দিকে জীবনে প্রথমবারের মত সি বীচ দেখলাম। অদ্ভুত গর্জনের সাথে বিশাল বিশাল নীল জল ঢেউ দেখে কয়েক মিনিটের জন্য স্তম্ভিত হয়ে ছিলাম! প্রকৃতি এত সুন্দর!! বিধাতার কি অসাধারণ সৃষ্টি! প্রথমে সি বীচ থেকে দূরে দূরে হাঁটলাম। ছন্দা আর ইরা আপু বাচ্চাদের মত ছোটাছুটি করতে লাগলো, ম্যাডাম এলোমেলো হাঁটতে লাগলো, ছেলেরা সি বীচে বল খেলায় মগ্ন হলো, কেউ কেউ সাইকেল দিয়ে পুরো এরিয়া ঘুরতে লাগলো।
ছবিঃ সি বীচে খেলাধুলায় মগ্ন আমাদের গ্রুপের ছেলে কলিগরা।
কি রকম অনুভুতি! কি পরিমান উচ্ছাস! জমে থাকা সমস্ত গাম্ভীর্য সব যেন বাতাসে মিলিয়ে গেলো সবার!গ্রুপের অনেকের ছবি তুলে দিলাম। তারপর সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে থাকলাম, কাছাকাছি ইরা ছন্দা কলিগ ভাইদের বউরা ও ছিল।
নিঃসন্দেহে দিনটি ছিল আমার জীবনের অন্যতম সুন্দর একটি দিন।
ছবিঃ আনমনে হেঁটে বেড়াচ্ছে ছন্দা
একা একা হাঁটছি একটুক্ষণ পর দেখলাম তিনটা ছোট মেয়ে আমার পিছু নিয়েছে, কথা বললো, হাসলো, গল্প করলো কি কি গল্প করলো আমি মনে করতে পারছিনা এখন, আমি ওদের বললাম আমি এই প্রথম সমুদ্র দেখছি এখন কথা বলোনা। দূরে যাও, আমাকে একটু একা থাকতে দাও বাচ্চা পার্টি।
ছবিঃ বীচের সেই তিনটা মেয়ে ।
ওরা সরে গেলো, আমি অনেকটা একলা হয়ে গেলাম জুতা খুলে ঢেউয়ের কাছে গেলাম, প্রথম ঢেউ আমার পা ছুয়ে গেলো।
ভীষণ অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য ছিল সময়টা! খানিকটা এগিয়ে গেলাম সমুদ্রের কাছে, বাহ! অসাধারণ! অসাধারণ!! তার কথা মনে পড়ছে! অতিরিক্ত মনে পড়ছে, খুব খুব মনে পড়ছে! আমি তার মায়াজালে আক্রান্ত অনন্তকাল!
সে কোথায়!
কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি! সামনে কিছু নেই দূর দূর পর্যন্ত গর্জন, নীল বিশাল ঢেউ আর ঝকঝকে আকাশে আমার হৃদয় সম্পূর্ণ একা আর দুঃখ ভারাক্রান্ত!
প্রতিটা ঢেউ আমার পা ছুয়ে যাচ্ছে আর বালি সরিয়ে নিচ্ছে পায়ের তলা থেকে।
ঢেউয়ে ঢেউয়ে এগিয়ে যাচ্ছি সামনে। চোখ বন্ধ করলাম। চারপাশে রাশি রাশি ঢেউ, ঢেউয়ের গর্জন!
কিচ্ছু যেন অনুভব করতে পারছিনা শুধু সমুদ্র ছাড়া!
খুব বেশি সময় যে ওরকম ছিলাম তা নয় তবু এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো টের পাচ্ছি আমার পায়ে আর ঢেউয়ের জল লাগছে না!
আশ্চর্য! চোখ মেলে দেখি ঢেউ সরে গেছে দূরে!
এখন শুধু বালি ভেজা যেখানটায় কিছুক্ষন আগেও আমায় ভিজিয়ে দিচ্ছিলো, এখন সেখানে জলশূন্য! একে ভাটা বলে!সমুদ্র রহস্যময়!!
মজা পেলাম যেখানে সমুদ্রের জল ছিল ভাটার জন্য সেখানে অনেকখানেই এখন প্রবাল জেগে উঠেছে।
ছবিঃ বীচে প্রবাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবখানেই।
প্রবাল ভীষণ পিচ্ছিল পা ফসকে পড়ে যেতে যেতেও পড়লাম না, পা কেটে গেলো। এগুলো একেকটা অনেক ধারালো, অনেক গুলো আবার সরে যায়, কাটা কুটার ভয়ে প্রবালের উপর থেকে সরে এলাম, এটা সুবিধাজনক মনে হলনা।
আরেকটু এগিয়ে গেলাম, এখানে ঢেউ বেশি, এখানে পা খুব দ্রুতই যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে সামনের বিশাল সমুদ্রে, পিচ্চিগুলা দৌড়ে এসে বললো আপু সামনে যাইয়েন না এখান দিয়ে চোরা বালি! কে বলছে!?
কেউ বলেনাই আমরা জানি! আরেকটা ঢেউ এলো! বাপ্রে বাপ পা এর তলা থেকে সব বালি যেন একসাথে সরে গেলো প্রায় পড়তে পড়তে উঠে এলাম। সমুদ্র অদ্ভুত!
ওদের একজন বললো আপু আপনে আমাদের বাড়ি যাবেন? বললাম কেন? আমার আপু শ্বশুর বাড়ি থেকে বেড়াতে আসছে তাকে আপনাকে দেখাবো। আমাকে দেখাবে কেন? আপনাকে আমার ভাললাগছে তাই।
ওদের সাথে সি বীচে অনেকটা সময় কাটালাম।
ছবিঃ সমুদ্র কন্যা
ফিরে আসার মুহূর্তে ওরা মোবাইল নাম্বার চাইলো!বললাম তোমাদের বাসার কারো মোবাইল আছে সেই নাম্বার দাও! মাঝে মাঝে আমি বোকা হয়ে যাই ব্যাপারটা মাথায়ই আসেনি এরা ঢাকার বাচ্চা না যে হড়বড় করে বাবা মা এর ফোন নাম্বার মুখস্ত বলবে! কিংবা হয়তো ওদের বাড়িতেও কোন মোবাইল নেই। কথাগুলো লিখতে লিখতে মন খারাপ লাগছে যে আমি ওদের সাথে যোগাযোগ করার কোন পথই রাখিনি নিতান্তই সহজ সরল আর অভাবী বাচ্চাগুলা আহা!!
ওদের হাতে যত ঝিনুক ছিল যে গুলো ওরা বিক্রির জন্য সি বীচে নিয়ে ঘুরছিল সে গুলো সব আমাকে উপহার দিলো আমি টাকা সাধলাম টাকা নেবেনা, অথচ বোঝাই যাচ্ছে ওদের টাকা কত প্রয়োজন ততক্ষনে সন্ধ্যা নেমে গেছে ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকা অবস্থায় ছন্দাকে বললাম ওদের ম্যানেজ করুন কিছু টাকা জোর করে হলেও দিয়ে দিন, সে জানতে চাইলো কেন আমি তাকে ওদের দেয়া ঝিনুকগুলো দেখালাম, ওরা টাকা না নেয়ার জন্য দৌড় দিলো ছন্দা ও পেছনে পেছনে দৌড় দিলো আমি হাসতে হাসতে ছবি তোলায় মন দিতে দিতে ছোট্ট একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললাম ''তুমি কোথায়!'' আমাকে ভীষণ রকম তুমি রোগ পেয়ে বসেছে দেখছি! ধুর।
ছবিঃ অদ্ভুত সুন্দর সমুদ্র!
সারা সন্ধ্যা পার করলাম বীচে ছোট ছোট দোকান গুলো থেকে কেনাকাটা করে, ম্যাডাম সহ দলের অনেকেই আমার সাথে ছিল পুরা সময়। ডিনারের পর আবার বীচে গেলাম তখন রাত সাড়ে এগারোটা। বীচে যেয়ে দেখলাম প্রায় ১০০ গজ লম্বা প্রবালের রাস্তা হয়ে গেছে সমুদ্রের ভেতর! পানি ও অনেক দূরে সরে গেছে! কি অদ্ভুত দৃশ্য! হায় সমুদ্র! অপরুপ সমুদ্র! মন ভোলানো সমুদ্র!।
সমুদ্রের কাছে এলে মানুষের মন শুধুই কি সমুদ্রের মত বিশাল হয়ে যায়? নাকি সব কিছু মনে করিয়ে দেয়!আমার তো মনে হয় অতীত আয়নার মত সামনে এনে দাড় করিয়ে দেয় সমুদ্র! মনের ভেতর কেমন যেন কষ্ট ছড়িয়ে পড়ে!
ছবিঃ মন ভোলানো সমুদ্র!
একটু দূরে ইরা আপু দাঁড়িয়ে! কি ভাবছে সে অমন একাকী হয়ে! কাছে যেতেই বলল ইতি তোমার ভাললাগছে তাই না? হেসে বললাম হ্যাঁ। আপু বলল চল আমরা ডাব আর মাছ ভাজা খাই।
আমি ছন্ধা ইরা আপু ম্যাডাম কলিগ ভাই এবং তাদের বউরা এসে জয়েন করলো! সুন্দর কাটলো সময়টা।
রুমে ফিরে এলাম ঘুমাবো, কারেন্ট ইতিমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে, এখানে মুলত জেনারেটর দিয়েই সন্ধ্যাটুকু কারেন্টের সাপ্লাই দেয়। ম্যাডাম রুমে ঢুকেই এতক্ষন আমার টাকায় যে শপিং করেছেন তা সব নিখুত ভাবে শোধ করে দিলেন। টাকা হাতে নিয়ে গম্ভীর আর বিরক্ত স্বরে বললাম এত কম টাকার শপিং তো করেননি! আমি তো আরও টাকা পাই! আপনি কি ভুলে গেছেন! এখন কি হবে আমার এতগুলা টাকার!
সে কয়েক মুহূর্ত দ্বিধায় থাকলো তারপর কিছু একটা আঁচ করে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলল দুষ্ট! আমার সাথে দুষ্টামি হচ্ছে না! মার খাবে! তারপর দুপুরে রুমে ঢোকার ঘটনার জন্য সরি বলল।
আমি তার স্পর্শে; তার ভেতর তীব্র বেদনা টের পেলাম, কিছু বললাম না। মানুষের জীবন অদ্ভুত।
বিঃদ্রঃ ছবি কম হয়ে গেছে যারা বলেন তাদের বলি এটা তো ছবি ব্লগ না
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৭