ছবিঃ স্নিগ্ধ গাঙচিল
আগের পর্বঃ আমার জীবনের প্রথম ভ্রমন। সমুদ্র ভ্রমন। (পর্ব-১)
সেন্টমার্টিন পৌঁছে জাহাজ পোর্ট থেকে অনেকটা পথ হেঁটে তারপর ছোট ভ্যানে চড়ে হোটেল অবকাশের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম আমরা। ভ্যান ছোট হওয়া সত্ত্বেও ব্যাগ লাগেজ সহ ৫/৬ জন মানুষ কি করে যেন ঠিক ঠাক বসা যায়।
ভ্যানওয়ালা কিশোর ছেলেটি অনায়াসেই সেটা চালিয়ে নিচ্ছিলো উঁচু নিচু পাকা কাঁচা ছোট, চিকন আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এবং দ্রুত গতিতে।
এখন পর্যন্ত এখানকার মানুষকে যতটুকু দেখেছি মনে হয়েছে বেশ সৎ এবং কর্মঠ।
ছবিঃ সেন্টমার্টিনের একমাত্র যানবাহন ভ্যান।
চারপাশে নানারকম দোকান চোখে পড়লো, রেস্টুরেন্ট চোখে পড়লো, বেশি চোখে পড়লো নানা রকম সুন্দর সুন্দর নামের রিসোর্ট যেমন রোজ মেরী, ব্লু মেরীন , ডলফিন, প্রাসাদ প্যারাডাইজ, সী আইল্যান্ড, সী ব্লু, প্রিন্স আলবাহার, ঊশান ভিউ, সমুদ্র বিলাস, স্বপ্নপুরী, স্বপ্ন বিলাশ, সাগর বিলাস, জলপরী, নীল দিগন্ত, কোরাল ভিউ, সীমানা পেড়িয়ে, সুগন্ধা, সেইলর মুন, বিচ ক্যাম্প, মেরিন পার্ক, স্বপ্ন প্রবাল ইত্যাদি। বাড়ি ঘর দুই একটা যা দেখলাম তাতে খুব কমই লোকজন চোখে পড়লো।
একটা দুইতলা ভবন দেখলাম শ্যাওলা জমা পরিত্যক্ত, ব্যাপারটা বলতেই একজন বললো ওটা সরকারী কোন কার্যালয় কিন্তু এই বৈরি পরিবেশে এসে কেউ থাকতে সম্ভবত রাজি হয়না! কিংবা রাজি হলেও খুব বেশিদিন টিকতে পারেনা। বৈরি পরিবেশ কেন জিজ্ঞেস করতেই ম্যাডাম বলল দেখো গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, এটা সেটা আরও কত প্রবলেম এই পরিবেশে শহরের কেউই এসে টিকতে পারবেনা এই যে তুমি এসেছো সব কিছু দেখে ওয়াও ওয়াও করছো এই তুমিই তিনদিনের বেশি থাকতে চাইবেনা। আমি ভেতরে ভেতরে বিরক্ত ও দ্বিমত হলাম মাত্র ৩ দিনেই আমি এখান থেকে চলে যেতে চাইবো এটা একদম ভুল কথা।
ছবিঃ কোন এক বাড়ির টিনের ছাদে বসা কবুতর।
এই সিনিয়র ম্যাডামকে শুরু থেকেই ট্যুরে আমাদের সাথে আসার ব্যাপারটা ভালো লাগেনি। উনি অতিরিক্ত সূচিবায়ুগ্রস্ত একঘরে নাক সিটকানো মানুষ। সে অফিসে জয়েন করার পর আমাদের ফ্লোরের ক্লিনার; ওমেন ওয়াশরুমে টাওয়াল কেন জায়গা মত রাখেনি, কেন বিনের ময়লা টাইম মত চেঞ্জ করেনি কেন এয়ার ফ্রেশনার দেয়নি কেন ওয়াসরুমের প্রতিটা কমোড ঝক ঝক করছেনা কেন বেসিন গুলোর চারপাশে ছিটানো পানি থাকে এসব কারনে বের করে দিয়েছে। এই অতিরিক্ত সুচিবায়ুগ্রস্ত মানুষের সাথে এক ঘরে কিভাবে রাত কাটাবো, (ইরা আপু, আমি, ছন্দা আর এই ম্যাডামকে একই ঘরে এখানে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে বলে শুনেছি) ভেবে ব্যথিত হলাম।
ভ্যানওয়ালা একটা ৪ তলা নতুন পুরানো মিক্সড বিল্ডিঙের ছোট্ট গেটের পাশে ভ্যান থামালো, সেখানেই এই সড়কের শেষ প্রান্ত। গেট দিয়ে আমরা হোটেল অবকাশের এরিয়ায় ঢুকলাম, ছোট চিকন পায়ে হাঁটার পথের উপর একটা জাল দিয়ে বানানো দোলনা তাতে আগত অতিথিদের ছেলে মেয়েরা ঝুলাঝুলি করছে।
আমাদের জানিয়ে দেয়া হলো অপেক্ষা করতে হবে কেননা আগের অতিথি এখনো বের হয়নি, তারা ঘর ছেড়ে বের হলেই আমরা ভেতরে এন্ট্রি করতে পারবো। এতটা লম্বা জার্নির পর ব্যাগ লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকাটা ভীষণ ক্লান্তিকর।
এক সময় আমাদের গ্রুপের এক ভাইয়া এগিয়ে এলো যার যার রুমের চাবি বুঝিয়ে দিতে। আমাদের রুম পড়লো ৩ তলায় ৩১২ নাম্বার রুম।
চাবি হাতে পেয়ে ব্যাগ লাগেজ নিয়ে টেনে টুনে(লাগেজ ধরার লোক খোঁজাখুঁজি করেও পাইনি) অনেক কষ্ট সহ্য করে করে উপরে উঠলাম।
উপরে গিয়ে দেখি তখনো আমাদের রুমের গেস্ট বের হয়নি।
আমরা বাইরে দাড়িয়ে রইলাম। ভেতরে দেখা যাচ্ছে দুইটা বেড, দুইটা ওয়্যারড্রোপ, একটা টেবিল, ছোপা; সব নোংরা।
সাথে চিকনা, টেকো, বাদামি রঙের জ্যাকেট পরা লম্বা হাতওয়ালা ঘোড়া টাইপ চেহারার একলোক হেঁটে বেড়াচ্ছে। উনিই আমাদের রুমের পূর্বের গেস্ট। তার অনেক ব্যস্ততা। একবার ওয়্যারড্রোপের ড্রয়ার খুলছে আবার বন্ধ করছে, আবার খুললো বন্ধ করলো, ওয়াশ রুমে ঢুকলো, পরনের উঁচু ধুপ ধুপ শব্দ হয় এমন জুতা পরে খানিকক্ষণ পায়চারী করলো, ছোপায় বসলো, লাগেজ খুললো, লাগেজ বন্ধ করলো, শব্দ করে চেইন আটকালো, উঠে দাঁড়ালো, জানালার দিকে কি যেন দেখলো!! এই ভাবে লম্বা লম্বা পা ফেলে পুরা ঘরে বার বার সে বিচরন করতে করতে তার মহা মূল্যবান অতিরিক্ত ব্যস্ত সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে থাকলো।
আমি অতিরিক্ত বিরক্ত হলে মাথা ব্যথা রোগে ভুগি। প্রথমে চিন চিনে ব্যথা পড়ে বাড়তে থাকে। ওষুধ না খেলে কিংবা মাথা ব্যথার বাম টাম না দিলে তা বাড়তে বাড়তে আরও খারাপ দিকে গড়ায়।
আমার বিরক্ত রোগের লক্ষন টের পেতে শুরু করেছি, এখন চিন চিন দিয়ে শুরু হয়েছে একটু পর হাতুড়ি পেটাবে!
শেষ পর্যন্ত কমপ্লেইন করার পর অনেক বক বক করার পর এবং বহু বহু অপেক্ষার পর লোকটা বড় বড় পা ফেলে ধুপ ধাপ শব্দ করে আমাদের দিকে না তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
সে বের হয়ে যাওয়ার পর ঘরে ক্লিনার ঢুকল, সে আয়েশ করে দরজা বন্ধ করে বেড কাভার চেঞ্জ করা বাদে বাকী সব কাজ করলো, ম্যাডাম ধমকা ধমকি করার পর বেড কাভার ও চেঞ্জ করলো। এতে অনেক লম্বা সময় গড়িয়ে গেলো বেলা প্রায় দুইটা। সকাল সাড়ে এগারোটায় এসে পৌঁছেছি অথচ আমরা তখনো বাইরে দাঁড়ানো, অসহায় ক্লান্ত আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারপাশটায় চোখ বুলালাম, বিল্ডিং এর সামনে একটা জলাশয় আর কিছু নারকেল গাছ, সমুদ্র দেখতে পেলাম না, দোলনার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম সেটায় ঘোড়া লোকটা তার ব্যাগ লাগেজ কোলের উপর নিয়ে পুরো শরীরটা জালের মধ্যে তুলে দিয়ে শুয়ে দুলে দুলে আয়েশ করে ফোনে কথা বলছে।
আহা ইটস এ বিউটিফুল ডে!!
ছবিঃ একে সম্ভবত কেয়া গাছ বলে, সেন্টমার্টিনে আর ছেড়া দ্বিপে এই গাছই বেশি চোখে পড়ে।
ক্লিনার সব ওকে বলে বেরিয়ে আসার পর ম্যাডাম ইরা আপুকে পাঠালো ওয়াশ রুমের কি অবস্থা দেখতে, মনে হচ্ছে এই ক্লিনের ড্রামা এক যুগ চলবে আমরা সমুদ্র দেখতে না, আসলে তো এসেছি ক্লিনার দিয়ে হোটেলের রুম পরিস্কার করতে!) ইরা আপু নাক কুঁচকে বেরিয়ে এলো, আবার ক্লিনার পাঠানো হলো।
আমার মাথার চিন চিন ব্যথা হাতুড়ি পেটানোর দিকে এগোচ্ছে।
তারপর যখন সেই শুভক্ষণ এলো ঘরে যাবার! ম্যাডাম সবার আগে ভেতরে পা রাখলেন এবং শুভক্ষণের রুলস জারি করলেন আমরা মেয়েরা কেউ যেন বাইরে পরা জুতা নিয়ে ভেতরে না ঢুকি, ভেতরে সবাইকে ঢুকতে হবে খালি পায়ে।
উনার কথা শুনে আমার কলিজা শুকিয়ে এলো কেননা এই নোংরা ফ্লোরে একটু আগে ক্লিনার গেস্ট ওয়াসরুম সহ সবখানে হাটাহাটি করেছে জুতা পড়ে সেই ফ্লোরে কি করে খালি পায়ে হাঁটবো!!!
আমার ঘরে পরার জুতাও টেকনাফ আমাদের ল্যান্ড পোর্টে ফেলে রেখে এসেছি! হতভম্ব আমি বাইরে থেকেই যুক্তি সহকারে তার সাথে তর্ক করলাম। কাজ হলনা, সে রাগ দমিয়ে রাখতে রাখতেই তা প্রকাশ হয়ে যেতে লাগলো, আমার সাথের বাকী মেয়ে দুজন কম্প্রোমাইজ করতে খালি পায়ে ভেতরে ঢুকল! আমি ওদের কাছে আমার টাকার ব্যাগ চাইলাম কেননা ব্যাগ লাগেজ ক্লিনার ছেলেটি ইতিমধ্যেই ভেতরে রেখে দিয়েছে। বললা্ম এক্ষুনি মার্কেটে যাবো ঘরে পরার জুতা কিনে নিয়ে আসবো আমার পক্ষে খালি পায়ে হাটা সম্ভব না। উনি চুপ, আমার মাথা ব্যথা বাড়তে থাকলো, নিরব যুদ্ধ চললো, আমি বাইরে উনি ভেতরে, উনি জিতলো আমি হারলাম।
ইরা আপু আমার টাকার ব্যাগ এগিয়ে দিতে দিতে পেছন পেছন এলো রিনরিনে মিষ্টি গলায় বলতে লাগলো ইতি ইতি দাঁড়াও একা একা যেওনা তুমি তো এখানের কিছু চেনোনা তুমি না কত লক্ষ্মী মেয়ে শোনো প্লিজ একটু শান্ত হও আমি থামলাম না, বললাম দেখো আপু চামচামি করা অথবা অন্যায় মেনে নেয়ার মেয়ে আমি না, হতে পারে উনি অফিসের সিনিয়র তাই বলে আমি উনার বাড়ির বুয়া তো না!
ইরা আপু মজা পেলো হাসতে হাসতে গরিয়ে পড়লো, আমার সাথে সাথে থাকলো।
যেতে যেতে আমাদের গ্রুপের আরও দু তিনজন যুক্ত হল হয়ত আমার সেফটির জন্য।
বাজারে গেলাম জুতা কিনলাম চারজোড়া, একজোড়া আমার, বাকী তিনজোড়া ইরা আপুর, ছন্দার, আর ওয়াশ রুমের জন্য।
রুমে ঢোকার পর ম্যাডাম জুতাগুলা হাতে নিয়ে বলতে লাগলো আরে এত সুন্দর জুতা, সে ও কিনবে! তার ভাগ্নির জন্য নিজের জন্য! কণ্ঠে ভয়াবহ রকম আহ্লাদ এনে বললো ইতি! শুনছো? এই দুষ্ট বাচ্চাটা? শোন আমাকে কিন্তু নিয়ে যাবে যে দোকান থেকে কিনেছো সেখানে ঠিকাছে!? আর আমার কাছে তো ভাংতি টাকা নেই আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবেনা ধার!?(কি ঢঙ্গী আর ন্যাকা ন্যাকা কথা!!) উনি চাইলে যে কাউকে বলে দিলেই উনার সামনে হাজির হয়ে যাবে! অথচ আমার কাছে কি মিনতি! এসব হিন্দি নাটক চলছে তার কিছুক্ষন আগের ড্রামা ঢাকার জন্য।
আমি মাথা ব্যথার বাম লাগিয়ে (টুকটাক প্রয়োজনীয় মেডিসিন ঢাকা থেকেই সাথে নিয়ে এসেছি) একটা টাফনিল আর একটা সারজেল খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।
মিস ইউ মা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:৩৭