ঢাকার বাইরে খুব একটা যাওয়া হয়নাই আমার, গেলেও কাছাকাছি জায়গাগুলোতে গিয়ে ছবি টবি তুলে দিনে দিনে ফিরে এসেছি। তাই ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাওয়া রাতে নিজের রুমের বাইরে অন্য কোথাও থাকা, অন্য মেয়ের সাথে রুম শেয়ার করা আমার জীবনে এই ভ্রমনে প্রথমবারের মত ঘটলো।
যেদিন অফিসে এসে শুনলাম সবাই মিলে এইবার সেন্টমার্টিন যাবে, ছেড়া দ্বীপ যাবে, কক্সবাজার যাবে আমি রীতিমত ঈর্ষান্বিত বোধ করতে লাগলাম কারন বাড়ি থেকে তো অনুমতি মিলবেই না জানা কথা।
এ যাবৎকালে যতবার এইরকম সুযোগ আসছে বাসায় জানালেই আমাকে কড়া ভাবে জানিয়ে দেয়া হত যত ঘোরাঘুরি বিয়ের পর জামাই নিয়া করবা। একলা একলা ঘোরাঘুরি করার দরকার নাই, আম্মু কি বলতে চাইতো আমি সবসময় বুঝতে পারতাম অতএব আমার এই চাওয়াটাকে অন্যায় আবদার হিসেবেই আমি গণ্য করে চুপ হয়ে যেতাম।
কিন্তু এইবার সবার সমুদ্র যাত্রার কথা শুনে নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না কেননা সমুদ্র দেখা আমার জীবনের বেশ কিছু সুন্দর স্বপ্নের ভেতর একটি।
আমি বহুদিন মনে মনে এই স্বপ্ন লালন করে ভেতরে ভেতরে শান্তি পেয়েছি যে আমি একদিন বিশাল নীল সমুদ্রের কাছে গিয়ে দাঁড়াবো, যেমনটা অতি আপনজনের কাছে গিয়ে মানুষ দাঁড়ায়! এভাবে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, সমুদ্রের বিশাল ঢেউ এসে আমায় ছুয়ে যেতে যেতে, এক সময় আমার জীবনের সকল বেদনা আমার শরীর থেকে সমুদ্রের জলে বিলীন হয়ে নির্ভার হয়ে যাবো।
সেদিন বাড়ি ফিরে টস করার মত করে মাকে বিষয়টা বললাম সমুদ্র দেখতে যেতে চাই আমি।
আমাদের অফিসের এক মেয়ে এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে পড়ে আছে কষ্ট পাচ্ছে, তার স্মৃতি শক্তি হারিয়েছে এসব আমার মাকে ভীষণ দুঃখ ভারাক্রান্ত করেছে, এখনো করছে, বিধায় আমি সেই উদাহরন টেনে আনলাম কয়দিন বাঁচবো এরকম যে আমার বেলায় হবেনা তার নিশ্চয়তা কি!
কথাটা মাকে প্রচণ্ড প্রভাবিত করলো এবং সে আমায় অবাক করে দিয়ে অনুমতি দিলো। আমি প্রচণ্ড খুশি লুকিয়ে রেখে বললাম আমার জন্য একদম চিন্তা করোনা আমরা প্রায় ৪০ জন যাচ্ছি, আমার ডিপার্টমেন্টের স্যার সহ সব ভাইয়ারা তাদের বউ বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে যাবে, আমার মত আরও চারটি মেয়ে যাবে একজন সিনিয়র ম্যাডাম যাবে, তাছাড়া আমি একদম পানিতে নামবোনা, খুব ইচ্ছে হলে একটু পা ডুবাবো।
আম্মু ততোক্ষণে কিচেনে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন সে সব ফেলেই তেড়ে এসে বললেন পা ও ডুবানো চলবেনা, সমুদ্র দেখতে যাচ্ছো দূর থেকে দেখে টেখে চলে এসো, পানিতে পা ডুবাডুবির প্রয়োজন নেই। আমি মিন মিন করে ঠিকাছে বলে চিন্তিত হতে হতেও হলাম না, ওইখানে গিয়া সমুদ্রে নামলেও বা কি সে তো আর জানবেনা।
তবু মনটা একটু বিষণ্ণ হল, আমার মা আমায় কি কখনো বড় হতে দেবেনা!।
এই টুরে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকের খরচ শুরুতে জন প্রতি ১২ হাজার ধরা হলেও আমাদের প্রথম দিনের নাস্তা আমাদের অফিসের টেকনাফের রিসোর্টে হওয়ায় এবং অন্যান্য খরচ কমিয়ে আনায় কিংবা সিনিয়রদের কেউ হয়ত বেশি টাকা দেয়ায় আমাদের জন প্রতি খরচ কমিয়ে এনে ৯ হাজার করা হল।
একরাত সেন্টমার্টিন হোটেল অবকাশে এবং দুই রাত কক্সবাজার হোটেল দি কক্স টুডেতে থাকার ব্যবস্থা হলো।
সেন্টমার্টিন ট্রাভেলস নামের একটা বাস রিজার্ভ করা হলো। প্রায় সবাই তাদের ফ্যামিলি নিয়ে নিলো সাথে।
সারারাত বাসে কীভাবে কাটবে কি করে মন প্রান স্থির করে আমি ১০/১২ ঘণ্টা বাসে বসে থাকবো এই ভাবনা মাথায় বহুবার এলো যেহেতু প্রথম জার্নি, লম্বা জার্নি তাই এসব মাথায় আসাই স্বাভাবিক।
বাস আরামবাগ থেকে ছাড়ল রাত ৮টায়। রাতের রাস্তাঘাট হাইওয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার পাশে বসা কলিগ ইরা আপু দেশের বড় সিমেন্ট কারখানাগুলো আমায় দেখাতে লাগলো সাথে সেসবের হিস্ট্রি বলতে লাগলো হিস্ট্রি বলতে কীভাবে মানুষ এইখানে কাজ করে জীবনের রিস্ক নিয়া, অনেক সময় কাজ করতে করতে মেশিনের ভেতরে বডি ঢুকে গেলে আর বাহির করে আনা সম্ভব হয়না লাশ সিমেন্টের ভেতর পঁচে গেলে সিমেন্ট হয়ে যায়, এসব জায়গায় খুন খারাবী করলেও কেউ দেখেনা, মানুষ মেরে ফেলে সিমেন্টের মধ্যে ফেলে দেয়া তো কমন ঘটনা। কেউ টের ও পায় না আবার ওই সিমেন্ট দিয়াই ঘরবাড়ির কাজ কারবার করা হয়।
নারায়নগঞ্জ ক্রস করার সময় সাত খুনের হত্যাকাণ্ড ইরা আপু সুন্দর করে বর্ণনা করতে লাগলেন, গুণ্ডারা কীভাবে মানুষগুলোর পেটে ছুড়ি ঢুকালেন কীভাবে জ্যান্ত অবস্থায় কারো কারো চামড়া তুললেন কীভাবে উকিল লোকটা বিনা দোষে খুন হলেন কীভাবে তাদের অর্ধজীবিত অবস্থায় বস্তায় ভরলেন, কীভাবে সেগুলো নদীতে ডুবালেন কিন্তু কোন বোকামিতে সেগুলো ভেসে উঠলো এবং নদীর কোন কিনার দিয়া তাদের লাশের বস্তা গুলো ভেসে উঠলো সেই স্পট দেখালেন।
ইরা আপু অন্য ডিপার্টমেন্ট এবং অন্য ফ্লোরের বলে মেশার কিংবা কথা বলার সুযোগ তেমন হয়ে ওঠেনি। সম্প্রতি উনার ডিভোর্স হয়েছে বলে শুনেছি, স্বভাবতই গভীর বিষাদে উনার মাথা সামান্য এলোমেলো তাই নিতান্ত আপনা মানুষ হিসেবে সে এরকম সুন্দর সুন্দর গল্প আমার কাছে করতেই থাকলেন।
সারাদিন অফিস করে ক্লান্তিকর শরীরে ইরা আপুর ভয়াবহ গল্প শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গেছে, সেটা সীট থেকে পা ফস্কে যাওয়ার জন্য, এসির ঠাণ্ডা বাতাসের জন্য, পাশে বসা ইরা আপুর গায়ে মাথা হেলে পড়ার জন্য, আর মাঝে মাঝে এর ওর কথার আওয়াজ কানে আসার জন্য।
রাত দেড়টার দিকে দেখলাম সিনিয়র ম্যাডাম বলছে(সে আমার ঠিক সামনের সীটে বসেছে) আরে এত জলদি চিটাগাং পৌঁছে গেছি কয়েকজন ভাইয়া বলছে তাইতো তাইতো সবাইকে তুলি, সবাইকে তুলি, ম্যাডাম বলল না না কাউকে তুলো না সবাই ঘুমুচ্ছে ঘুমটা নষ্ট হবে। এইসব শুনতে শুনতে ভাবতে লাগলাম আজ রাত প্রথম আমি বাড়ির বাইরে! আজ আমার জীবনের প্রথম রাত আমার রুম খালি, আম্মু কি ঘুমাতে পারছে, ভাবলাম বাড়িতে একটু ফোন করি ভাবতে ভাবতে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
ভোর ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত এসির ঠাণ্ডায় বাস হিম ঘরে পরিনত হলো, বাস থেকে আমাদের ছোট্ট তোয়ালের মত কম্বল দেয়া হইয়েছিল যেটায় পুরা শরীর ভালো মত ঢাকে না, আমি শীতের চোটে ইরা আপুর গা ঘেঁষে কম্বল পেঁচিয়ে পড়ে রইলাম।
আমার ঠিক পেছনেই গ্রুপ চিফ ফিনান্সিয়াল স্যার বসেছে তার মেয়েকে নিয়ে আর ঠিক পাশের সীটেই উনার ওয়াইফ ও আরেক মেয়ে বসা, যাই হোক সে ঘুমন্ত অবস্থায় শীতের চোটে জমে যাওয়া গলায় বলতে লাগলেন ড্রাইভার সাহেব এসিটা বন্ধ করে দিন,
কথাগুলো বেশ কয়েকবার বললেন শুনালো এই এই রকম ড্রাআআইভাআর সাআহেএএব এসিই টাআআ বন্ধওও করেএএ দিন ড্রাআআইভাআর সাআহেএব এসিইইই টাআ বন্ধওও করেএএ দিন।
সুরে সুরে বলা কথাগুলো আমার কানে বাজতে লাগলো গানের মত আমি গান শুনতে শুনতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
৫টার দিয়ে ইরা আপু বলল ইতি ইতি দেখ কি সুন্দর সকাল ইতি প্লিজ একটু দেখই না সকালটা কত্ত সুন্দর ইতি ইতি ইতি একটু তাকাও একটু দেখোনা আমি একচোখে একটু জানালার দিকে তাকিয়ে লাল আকাশ দেখে হুম বলে শেষবারের মত আরেকটু ঘুমাবার জন্য চোখ বন্ধ করলাম! এত প্রকৃতি প্রেমীদের জ্বালায় কে ঘুমাবে!!
আমি আজ এই প্রথম বাড়ি থেকে অনেক দূরে বসে প্রচণ্ড মন খারাপ অনুভব করলাম আমার রুমের জন্য রুমের বিছানার জন্য আমার ফুলের ছাপাখোপাওয়ালা লাল কম্বলটার জন্য, আপনজনদের জন্য।
তার কয়েক ঘণ্টা পর আমাদের কোম্পানির ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্টে পৌছালাম।
সেখানে আমাদের নাস্তার ব্যাবস্থা করা হয়েছে, নাস্তা করে একটু হাল্কা এদিক সেদিক ঘুরে ছবি তুলে আমরা সেখান থেকে রওয়ানা দিলাম সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে, জাহাজে চড়ে বসলাম। সময়টা ছিল ক্লান্তিকর, অনেক রোদ উঠেছিল, আশেপাশে গরম ছিল, জাহাজ বার বার দুলছিল।
আমার লম্বা জার্নির ক্লান্তি ছিল, বাড়ি থেকে দূরে থাকার দুঃখবোধ ছিল, প্রথম সমুদ্র দেখার মুহূর্ত ছিল।
আমি জাহাজের রেলিঙে এসে দাঁড়ালাম ফটোগ্রাফার মানুষ প্রথম সমুদ্র দেখছি দুই একটা দৃশ্য না তুললে হয়!!
ছোট্ট জাহাজের রেলিঙে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি এরকম এক মুহূর্তে পাশের একজন বলল ওইখানে তোলেন ওইটা পাহাড়ের সাইড দিয়ে কাঁটা সড়ক আর পাশেই কোন বাংলো ওই ছবিটা ভালো হবে, ওইখানে তোলেন ওইটা মিয়ানমার। এইটা তোলেন এইটা নাফ নদী, এইপাশে আসেন এইখান দিয়ে ভালো কেপচার করতে পারবেন, ওই নৌকার ছবি তোলেন দেখেন চারপাশে কত ঢেউ, আরে ওই যে একটা সিগাল ওইটার ছবি তোলেন সুন্দর আসবে।
আমি তার কথা মত ছবি তুলতে তুলতে জানলাম উনার নাম ফারুক, কুমিল্লা থেকে এসেছে সেন্টমার্টিন থাকবেনা ঘুরাঘুরি করে আজই ফিরে যাবে, একটা ব্যাংকে কাজ করে। ছবি তোলা শেষ করে আমি তার দিকে তালাকাম বললাম ভেতরে যাই রোদ আর সহ্য হচ্ছেনা, পড়ে দেখা হবে ভাইয়া। জবাবে সে কিছু একটা বলতে চেয়ে শেষ পর্যন্ত সাহস করতে না পেরে মলিন ভাবে হাসলো।
যদিও আমি জানতাম তার সাথে আর দেখা হবেনা, এরকম বাসে চলতে ফিরতে কত অচেনা মানুষের সাথে দেখা হয় তারপর আর দেখা হয়না কিংবা হয়ত দেখা হয় চেহারা ভুলে যাই চিনতে পারিনা এটা ভীষণ বিচিত্র একটা ব্যাপার।
আমাদের পুরো জীবনটাই বিচিত্র। আমাদের চারপাশের প্রকৃতি বিচিত্র আমাদের দৈনন্দিন সমস্ত কিছুই বিচিত্র।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:৪১