আমি আসলে লিখাটা কোথায় লিখব সেইটা নিয়ে বেশ দ্বিধায় ছিলাম, লেখাটা কি মিডিয়ামে ইংরেজি লিখব কিনা সেইটাও ভাবছিলাম। পরে দেখলাম মিডিয়ামে আমার চেয়ে ভালো করে ইংরেজিতে পদার্থিবিজ্ঞানের চোখ দিয়ে টেনেট মুভিকে দেখা হয়েছে। আর ব্লগিং করে টাকা পয়সাও আসে না, এইটা কোন পত্রিকায় দিব কিনা সেইটাও ভাবছিলাম, ইংরেজি বাংলা দুভাবেই লেখা যেত। কিন্তু ছাপানোর সময় নিয়ে অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছিল না। ফলে এই সামু ব্লগেই লিখে ফেললাম। তো শুরু করা যাক।
প্রথমেই শুরু করতে চাই গত সপ্তাহে ইতালির বিখ্যাত পদার্থবিদ্যার গবেষণার তীর্থস্থান, আইসিটিপি তে একটা ওয়ার্কশপ হল, যেখানে প্রধান আকর্ষণ ছিলে এইবারে পদার্থবিদ্যায় নোবেল জয়ী রজার পেনরোজ। তো ওয়ার্কশপের প্রথম দুইটা টক ই ছিল এই টাইম রিভার্সাল। খুব আগ্রহ ভরে টক দুইটা শুনলাম। মজা পেলাম। প্রথম বক্তা জোয়ান ভাচ্চারো উনার গবেষণার বিশাল একটা অংশ সময় ব্যয় করেছেন এই টাইম রিভার্সালের উপর। উনার রিসার্চগেটের প্রোফাইলে কেউ ঘুরে আসলে এই সম্পর্কিত বেশ ভাল ভাল গবেষণা পাওয়া যাবে। এখন একটু শুরু করা যাক এই টাইম রিভার্সাল ব্যাপারখানা কি? তার আগে আমাদের যেই প্রশ্নের উত্তর খুজতে হবে তা হচ্ছে সময় কে কেন আমরা একমুখী দেখি? মনে হয় যেন সময় শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে চলছে। চলুন একটা থট এক্সপেরিমেন্ট বা মনন পরীক্ষা শুরু করা যাক। আপনি এক জাদুকর, আপনার সামনে বেশ কিছু দর্শক আপনার জাদু দেখার জন্য বসে আছে, তো আপনি কি করলেন- একটা সাদা স্বচ্ছ পাত্রে কিছু গ্যাস বা বায়বীয় কণিকা রেখে দিলেন, এবং গ্যাস গুলোকে পাত্রের চারপাশে ছড়াতে কিছু সময় দিলেন। তারপর যদি দর্শকদের জিজ্ঞেশ করেন, যে এই গ্যাস গুলো এখন কোন অবস্থায় আছে। আমি একটি চিত্র দিয়ে আরও সহজ ভাবে বুঝানো চেষ্টা করি।
উপরের চিত্রটি দেখুন আমি যখন গ্যাস গুলো বেশ ভালো পরিমান পাত্রের চারদিকে ছড়াবে তখন যদি জিজ্ঞেশ করি যে এখন গ্যাস গুলো কি সময়ের সম্মুখ দিকে প্রবাহিত হবে নাকি সময়ের বিপরীত দিকে প্রবাহিত হবে? যদি কোন রকম কোন ঘড়ি, তেজস্ক্রিয়তা, অর্থাৎ দিক বা বেগ পরিমাপের কোন ব্যবস্থা না থাকে তাহলে আপনিও দর্শকের মত বলতে পারবেন না কোনদিকে সময় প্রবাহিত হচ্ছে, অর্থাৎ আপনিও বলতে পারবেন না, গ্যাসের কণা গুলো কোনদিকে যাবে, কারণ দুই দিকের যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তার মানে আমি যদি সময়ের বিপরীত দিকে যাই তাহলে দেখা যাবে গ্যাসগুলো এখনো ব্যাপিত হচ্ছে না। এই ব্যাপারটাই হচ্ছে টাইম রিভার্সাল। দেখুন আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছি, যে আপনি তখনই বলতে পারবেন না যখন আপনার কাছে কোন সাপেক্ষ অর্থাৎ রেফারেন্স থাকবে না। রেফারেন্স থাকলে আপনি বলে দিতে পারবেন যে কোন দিকে যাচ্ছে। ঠিক এই কারণেই আমরা আমাদের চারপাশের জগতে সময় কে মনে হয় যেন সামনের দিকে চলছে। এই চারপাশের জগত হচ্ছে ম্যাক্রস্কোপিক জগত। এই ম্যাক্রোস্কপিক জগতে তাই সময়ের দিক সবসময় মনে হয় সামনের দিকে। এতক্ষন ঘটনাটা আমরা বুঝলাম হচ্ছে একটা চিন্তার পরীক্ষা দ্বারা। চলেন পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বুঝার চেষ্টা করি কেন ম্যাক্রোস্কোপিক জগতে আমাদের কাছে মনে হয় সময় সামনের দিকে এগিয়ে চলছে?
কারণটা খুব সহজ। একমাত্র থার্মোডায়নামিক্সের দ্বিতীয় সুত্রের কারণে মনে হয় যেন সময় সামনে এগিয়ে চলছে। তো এই থার্মোডায়নামিক্সের সুত্র কি বলে? এইটা বলে যে এনট্রপি সর্বদা বাড়বে। এখন এনট্রপি বলতে আমরা বুঝি যে বস্তুর বিশৃঙ্খল অবস্থা বাড়ছে। এখন বিশৃঙ্খল অবস্থা বলতে বুঝানো হচ্ছে, যে তাপমাত্রার প্রবাহ উচ্চ থেকে নিম্ন দিকে যেতে থাকবে। একটা বস্তু গড়ায়ে গড়ায়ে উচ্চ বিভব থেকে নিম্ন বিভবের দিকে পড়তে থাকবে। এইটা নিউটনিয়ান পদার্থবিদ্যা দিয়ে বেশ ভালো ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, যে এইটাই স্বাভাবিক যে একটা বস্তু সর্বদা স্থিতিশীল অবস্থায় থাকতে চাইবে। এইবার আরেকটা থট এক্সপেরিমেন্ট করি, একটা বল গড়ায়ে পড়ছে, এখন আমি যদি বলের এমন কোন চিহ্ন না রাখি যে বলটা গড়ায়ে কোন দিকে পড়ছে, যেমন বলের আকৃতি এমন করলাম যে এর গতির দিক বুঝা যাবে না তখন কিন্তু কোনাভাবেই বলা যাবে না বলটা কোন দিকে পড়ছে। তার মানে কি? তার মানে নিউটনিয়ান পদার্থবিজ্ঞান সময়ের সম্মুখ আর পশ্চাৎ প্রবাহ, দুই প্রবাহ নিয়েই একটা ধারনা দেয়। ঠিক এই কারনেই একটা বস্তু মহাকর্ষ বলের কারণে যেমন একই পথে উপরে উঠে আবার একই পথে নিচে নামে, ধ্রুপদী পদার্থবিজ্ঞানে এই ধরনের ঘটনা হচ্ছে সংরক্ষনশীলতা। কিন্তু ম্যাক্রোস্কোপিক জগতে এই ঘটনা ঘটবেই না কারণ হচ্ছে ই এনট্রপি, এন্ট্রপির কারণে আমরা বুঝতে পারি যে এই প্রবাহ সর্বদা একমুখী। ঠিক এই এন্ট্রপির কারণেই মনে হয় যে সময় ও এন্ট্রপির মত একমুখী। ফলে আমাদের মনে হয় যে সময়ের সম্মুখ প্রবাহের কারণে এনট্রপি বাড়ছে। এখন আরেকটা থট এক্সপেরিমেন্ট করি চলেন। একটা পাত্রে গ্যাসের কণিকা ছড়াচ্ছে সময়ের সাথে সাথে অর্থাৎ এনট্রপি বাড়ছে। এখন যদি কোনভাবে আমরা সময়ের বিপরীত দিকে চলে যেতে পারি এবং গ্যাসের কণিকা ছড়ানোর ব্যবস্থা করা হয় তাহলে দেখা যাবে এনট্রপি বাড়ছে। অর্থাৎ এনট্রপি বাড়বেই সময়ের প্রবাহ যেই দিকেই হোক না কেন।
উপরের চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে এনট্রপি আসলে সময়ের যেই দিকেই যাওয়াও হোক না কেন বাড়বেই। তারমানে আমরা যদি কোনভাবে বিপরীত প্রবাহ পাই সময়ের তাহলেও সেইখানে দেখা যাবে ধ্রুপদী পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম গুলো ঠিক মত মেনে চলছে। এই কারণে টেনেট মুভি তে দেখবেন যখনই সময়ের পশ্চাৎ প্রবাহ হয়েছে সেইখানে গুলি গুলো আসলে ঠিক সামনে দিয়েই বের হচ্ছে কারণ পুরো হিসাব হচ্ছে তখন সময়ের বিপরীত প্রবাহের জগত থেকে। এখন কেউ যদি সময়ের সামনের প্রবাহের জগত থেকে ঘটনা টা দেখে তখন তার মনে হবে বন্দুকের গুলি সামনে বের না হয়ে পিছনে বের হচ্ছে। এই কারণে টেনেট মুভিতে যেই কয়বার এই রকম সময়ের পিছনের ঘটনা পাওয়া গেছে, যখন পর্যবেক্ষক সময়ের সামনের প্রবাহের তখন সে দেখছে সব কিছু কিভাবে পিছনে যাচ্ছে, গাড়ীগুলো পিছনে চলে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর এক তত্ত্ব খাটানো হয়েছে এইখানে। এখন বেশ স্বাভাবিক প্রশ্ন আসা উচিত, আমি যে বল্ললাম এই ঘটনা ম্যাক্রোস্কোপিক জগতে দেখা যায় না, তাহলে কি এই ঘটনা মাইক্রোস্কোপিক জগতে দেখা যায়?
অবশ্যই মাইক্রোস্কোপিক জগতে এই ঘটনা দেখা যায়, যেমন ম্যাটারে বিপরীত হচ্ছে অ্যান্টিম্যাটার। এই এন্টিম্যাটার গুলো সময়ের বিপরীতে চলে। এখন আমি একটু বলি, এই যে বললাম এন্টি ম্যাটার সময়ের বিপরীতে চলে, এইটা আসলে সরল ভুল এবং সত্যি কথা। ভুল কথা হচ্ছে এই কারণে আসলে ইলেকট্রনের প্রতিকনা পজিট্রন সময়ের ঠিক বিপরিতে যায় না তবে, এর আচার আচরন ব্যাখ্যার জন্য সময়ের বিপরীত দিকের প্রবাহ ভাবা হয়। এই ধারনা টা প্রতিষ্ঠা করেন রিচার্ড ফাইম্যান এবং তার সুপারভাইজার জন হুইলার। ২০২০ সালের বই মেলায় আমার " ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম" নামে একটা বই বের হয়েছে সেইখানে আমি বলেছি কিভাবে ফাইনম্যান এই সময়ের ব্যাপারটা বেশ সুন্দর ভাবে উনি উনার কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্সে নিয়ে আসছেন। আমি শুধু একটা ছোট্ট উদাহরন দিয়ে ব্যাপারটা বুঝাব। ইলেক্ট্রন আর পজিট্রনের দেখা হলে কি হবে বলতে পারবেন? একে অপর কে নাকচ করে দিবে। এখন কিভাবে নাকচ করে এইটা কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রো ডায়নামিক্সে প্রবাবিলিটি এমপ্লিচিউড দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। এখন ইলেকট্রনের প্রবাবিলিটি এমপ্লিচিউড যদি সম্মুখ হয় তাহলে পজিট্রনের প্রবাবিলিটি এমপ্লিচিউড হবে বিপরীত মুখী। এই সম্মুখ আর বিপরীত মুখী যুদ্ধে একে অপরের সাথে নাকচ হয়ে যায়।
আমি আমার বইয়ে বেশ সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছি কিভাবে এই ঘটনা হয়। এখন এই কনা প্রতি কনার কাহিনী এইখানে নিয়ে আসা হল এই কারণে যে বাস্তবিক অর্থে জোয়ান ভাচ্চারো মেসন কনা দিয়ে এই ব্যাপারটা প্রমান করেন, এবং আরও একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার প্রমান করেন যে আমরা খুব সাদাসিধে ভাবনায় যেইভাবে বললাম সময়ের সম্মুখ আর পশ্চাৎ প্রবাহে একই ঘটনা ঘটবে আসলে তা না, এইখানে সময়ের বেশ হেরফের হয়। অর্থাৎ ইলেক্ট্রন যদি ফোটন কনা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পজিট্রনে পরিণত হতে যে সময় নিবে দেখা যাবে যে, পজিট্রন ঠিক একইভাবে ফোটন কনা শোষণ প্রাপ্ত হয়ে ইলেক্ট্রনে পরিণত হতে আরেকটু বেশি সময় নিবে। এইটার নামে হচ্ছে সময়ের অসাম্যতা। এবং এই অসাম্যতা দেখিয়ে জোয়ান বলেছেন আসলে এইখানেও এনট্রপি বাড়ছে।
ঠিক এই ব্যাপারটাই টেনেটে দেখবেন যে, কোনভাবেই সময়ের বিপরীতের চরিত্র সমস্যা ঠিকমত সমাধান করতে পারছে না। এনট্রপি একটু বাড়ায়ে দিয়ে চলে আসছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১২:৩৪