গত তিন চারদিন যাবত আমার মনের মধ্যে একটা চিন্তা কাজ করছে, সেইটা হচ্ছে আমার অস্তিত্ব নিয়ে। আমি একটু বলে রাখি চিন্তা টা কিভাবে মাথায় আসল। যারা কম্পিউটার বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেন তারা একটু আধটূ কমপ্লেক্সিটি থিওরি এর সাথে পরিচিত। আমি শুধু মাত্র অল্প একটু জানি এইটার, যা হচ্ছে এমন কিছু প্রবলেম সেট যেগুলো এক্সিটিং রিসোর্স দিয়ে পলিনোমিয়াল সময়ের মধ্যে সমাধান করা যাবে। যেমনঃ সকল সংখ্য্যার যোগফল অথবা গুনফল একটা P-set problem. আবার এমন কতগুলো প্রবলেম আছে যেইগুলো নন ডিটারমিনেস্টিক, এই টাইপ প্রবলেম সেট গুলো কে বলা হয় NP- set problem. এখন এই কমপ্লেক্সিটি থিওরির একটা বিখ্যাত তর্ক হচ্ছে P=NP কিনা? এখন গবেষকরা যদি এইটা প্রমান করতে পারেন তাহলে এইটার একটা দার্শনিক মানে হবে এমন, একটা রোবট কে যোগ বিয়োগ করতে বলা যেই কথা আর রোবট কে দিয়ে রবি ঠাকুরের কবিতা লিখতে বলা এক কথা। তার মানে এই সমস্যা সমাধান করতে পারলে একটা মানুষ আর একটা রোবোটের মধ্যে সৃজনশীলতার মধ্যে যে তফাত টুকু থাকে সেইটাও থাকবে না। শিহাব ভাই আমাদের নিয়মিত পাঠচক্রে এই কথা বলার পরপরই আমি একটা মন্তব্য করে বসলাম, ঠিক আছে, আমি বিশ বছর পর ব্যাপারটা দেখতেছি। তখন শিহাব ভাই বললেন, বিল গ্যাসার্চ নামে এক রিসার্চার আছেন যিন বেশ কয়েক বছর পর পর কমপ্লেক্সিটি তত্ত্বের গবেষকদের মধ্যে একটা জরিপ চালান এবং তাদের কাছ থেকে জানতে চান কবে নাগাদ এইটা গানিতিক ভাবে সমাধান করা যাবে? এবং সেই জরিপে বলা হচ্ছে হয়ত ১২০ বছরের মধ্যে আমরা এইটার সমাধান জানতে পারব। এই ১২০ বছর শব্ধটা আমার মধ্যে একটা বিশাল আলোড়ন সৃস্টি করল।
আলোড়ন সৃষ্টি করার কারণটা আমি একটু বলি। এখন ২০২০ সাল, ১২০ বছর পর ২১৪০। ২১৪০ সাল আমার কাছে মনে হচ্ছে খুব দূরে এবং খুব কাছে। একটা মিশ্র অনুভুতি। এই মিশ্র অনুভুতির কারণ হচ্ছে, আমার কেন যেন মনে হয় এই মানব সভ্যতা এই শতাব্দীতে ধ্বংস হয়ে যাবে। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে জলবায়ু। যারা একটা আধটু আশেপাশের পরিবেশ নিয়ে খোজ খবর রাখেন তারা হয়ত জানেন যে, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা শহরটা আসতে আসতে মাটির নিছে ডেবে যাচ্ছে, এবং যে হারে ডেবে যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ২০৪০ পার করতে পারবে কিনা সন্দেহ। খুব কাছেই কিন্তু ২০৪০। আমার আবার একটা অনুভুতি হচ্ছে ১৪৯০ সালের আগ পর্যন্ত মানুষ জানতই না যে, আমেরিকা নামের একটা মহাদেশ আছে। শুধুমাত্র ভেবে দেখুন মাত্র ৬০০ বছরে সভ্যতা কোথায় চলে আসছে। সাড়া দুনিয়ার মানুষ এখন একে অপরের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারে। এমনকি গত শতাব্ধির শুরুর দিকেও যোগাযোগ এত দ্রুত ছিল না। অথচ একশ বছরে কত দ্রুত পরিবর্তন হল। এইসব কারনেই আমার মনে হচ্ছে ২১৪০ সাল পর্যন্ত যদি সভ্যতা টিকে যায়, আমি জানি না কি হবে। এই যখন আমার মাথায় আসল আমি জানি না কি হবে, তখন আরেকটা ব্যাপার মাথায় চলে আসল, আমি তো বাচব না, অতদিন। তার মানে কি?
তার মানে হচ্ছে আমি এই মহাকাল একটা ছোট্ট একটা অংশ ধার করে নিয়ে এসেছি। আমি আমার অনুভুতিটা একটু বুঝানোর চেষ্টা করি, আমি আমার জন্মের মুহুর্ত থেকে আজ পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে সব ২০-৩০ মিনিটে বলে শেষ করা যাবে, অথচ আমার বয়স ২৪ বছর। একইভাবে ১৪০০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সকল ঘটনা কিন্তু বেশি ৩-৪ দিনে টানা বলে শেষ করা যাবে। আমি আরও স্পেসিফাইভাবে বলি, ডিয়াগো ম্যারাডোনা মারা যাওয়ার পর সবাই ওকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, আমি ভিডিও গুলো দেখার পর মনে হল, এই মানুষটা কি মৃত্যুর মুহুর্ত টা জানত। ব্যাপারটা এইভাবে ভাবা যায়, ১৯৮৬ সালের ফাইনালে ঠিক মাঠে নামার আগ পর্যন্ত কি ও জানত যে ও চ্যাম্পিওন হবে। আরও স্পেসিফাইভাবে বললে ও কি মুহুর্তগুলো আগে থেকেই আচ করতে পেরেছিল। না পারে নাই। ও যে ঠিক এই এই ভাবে গোল করবে, ও জানত না। আবার মুহুর্তগুলো যখন সে অতিক্রম করছিল তখন যদি ওকে জিজ্ঞ্যেস করা হয় ও তোমার মাথায় তখন কি ভাবনা চলছিল। ও খুব বেশিক্ষন সময় নিয়ে বলতে পারবে না। আমি ঠিক জানি না আমার অনুভুতিটা বুঝাতে পারছি কিনা, কিন্তু আমি আরেকটা ঘটনা দিয়ে বলার চেষ্টা করি। ছোটবেলায় বার্ষিক পরিক্ষায় অথবা অন্য যেকোন পরিক্ষায় আমি সমাজ, ধর্ম, বাংলা তারপর এইটাইপ বিষয় গুলো খুব ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যেতাম না, অনেকটা ৫০-৫০ সম্ভাবনায় পরীক্ষার হলে যেতাম। যখন নৈর্বক্তিক আসত তখন দেখতাম আমি বইয়ের এই অংশটা বাদ দিয়েছি, তখন মনে হত ইশ যদি এইটা পড়ে আসতাম, তাহলে উত্তর দিতে পারতাম প্রশ্নে। আমি এই উদাহরন দিয়ে এই কথাতাই বলতে চাচ্ছি কোনভাবে যদি আমাকে ২ ঘণ্টা আগে ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকতো তাহলে হয়ত আমি ঠিক ঠাক উত্তর দিতে পারতাম। আমার কাছে মনে হয় পুরো জীবন টা এমনি। আমি একটা একটা করে মুহুর্ত হারাচ্ছি। আর আমার অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে একটু একটু করে। আর আমি যে আছি সেইটাও আমার কাছে ঠিক বোধগম্য মনে হচ্ছে না। কিভাবে মনে হচ্ছে না আমি একটু বলি।
আমি যে বাংলাদেশেই জন্ম নিব, এইটাই কে নির্ধারন করে দিল। এইটার উপর কি আমার কোন হাত ছিল? ছিল না। আমি যে ঢাকা থেকে সিলেট যেয়ে পড়াশুনা শেষ করে আসব সেইটাও তো আমি জানতাম না। আমার ক্লাসের ৪০ জন বন্ধু হবে, ওরাই যে আমার সহপাঠি হবে আমি কি জানতাম? আমি কথা বলার আগ পর্যন্ত আমি কাউকেই চিনতাম না। এর চেয়ে ভয়ংকর ভাবনা আমার কাছে মনে হয়, আমরা পরিবারে ৫ জন সদস্য। এই মুহুর্তে আমার মা কি ভাবছে আমি জানি না, আমার বাবা কি ভাবছে জানি না। আমার মা রান্নাঘরে ঠিক কোন কোন উপাদান মিশায়ে রান্না করছে আমি জানি না। আমি যে এই লিখাটা লিখচি এইটা ফেসবুক অথবা ব্লগে দেয়ার আগ পর্যন্ত কেউ জানবে না, এমনকি আমি যদি লেখাটা প্রকাশ না করি তাহলেও কেউ জানবে না, যে আমি এই লেখাটা লিখেছি। আপনি এই পৃথিবীতে আছেন অথচ আপনি আপনার খুব কাছের মানুষের অনুভুতি জানেন না। তার মানে আমি ঠিক থেকেও নাই। আমি থেকেও একা। আমি আরেকটা ব্যাপার বলে আমার অনুভুতিটা বুঝাতে সাহায্য করি, আমি যখন বাসে চড়ে সিলেট ঢাকা আসা যাওয়া করতাম তখম আমি দুপুরে দেখতাম মাঠে কোন শিশু দৌড়াচ্ছে, কোন কিশোরের দল ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলছে, অথবা কোন চাষী মাঠে কাজ করছে। আমার মাথায় সবসময় যেই অনুভুতি কাজ করত, আমার বাসটা যদি ঠিক ওই মুহুর্তে ওই মাঠটা অতিক্রম না করত,আর অই শিশু, কিশোর অথবা চাষী যদি অই মুহুর্তে ওই মাঠে না আসত তাহলে আমি এই ঘটনার স্বাক্ষি হতে পারতাম না। আচ্ছা আমার জন্ম তো আরও আগেও হতে পারত, এইট কে ঠিক করে দিচ্ছে, এমনকি কিছুদিন পর হয়ত আমি কোন শিশুর বাবা, আমি কি অই শিশুর চেহারা কল্পনা করতে পারি? পারি না। আমি ঠিক যে মুহুর্তে শিশুটাকে দেখব অই মুহুর্ত থেকে শিশুটার চেহারা আমার মাথায় গেথে যাবে। আমি যখন মাইনরিটি রিপোর্ট মুভিটা দেখি তখন আমার প্রচন্ড ভয় পাইছি, কারণ এইটা আমার ভাবনা ছিল, আমি ঠিক এইভাবেই ভাবি। এইটাও আমার কাছে একটা গানিতিক সমস্যা মনে হয়। কোনভাবে যদি অসংখ্য চলক একসাথে বিবেচনা করে, এই মুহুর্তে এই মানুষটা এই কাজ করতে পারে বের করা যেত। আমি আমার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে এই গানিতিক সমস্যা সমাধান করার ইচ্ছে পোষন করেছি।
এইসব ভাবনার কারনেই মনে হয় ১২০ বছর পর আমি বাচব না, তাহলে আমি কোথায় যাব? জামিলূর রেজা স্যার মারা গেলেন, ইরফান খান মারা গেলেন, আলী জাকের মারা গেলেন, ম্যারাডোনা মারা গেলেন। এরা যাচ্ছে কোথায়, মৃত্যু মুহুর্তে এদের অনুভুতি কি খুব জানতে ইচ্ছে করতেছে। আমি জানি আমি কখনই জানতে পারবনা। আমি একবার এক জুম্মার বয়ানে শুনেছিলাম, কোন এক লোক মৃত্যুর সময় আজরাইল কে দেখে বলেছিলেন, যে তুমি একটু আগেভাগে বলে আসলে ভাল হত, আমি কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম। আজরাইলের উত্তর ছিল, তোমাকে বারবার সংকেত দেয়া হচ্চিল- তুমি যখন যৌবনে আসলে সেইটা একটা সংকেত ছিল তোমার আয়ু ফুরাচ্ছে, তোমার সন্তান জন্ম আরেকটা সংকেত ছিল, তোমার ওর জন্য জায়গা ছাড়তে হবে, তোমার নাতি-নাতনী হওয়া আরও বড় সংকেত ছিল। আর কিভাবে তোমাকে সংকেত দিব যে তোমাকে জায়গা ছাড়তে হবে।
সুতরাং যত বেশিদিন পারেন সুস্থভাবে বেচে থাকার চেষ্টা করেন। পেলের বয়স ৮০, এখন বেচে আছে, মাহাথির মোহাম্মদ ৯৫ বছর। আর বিশ্বাস করেন, আমার আপনার দৃষ্টির বাইরে কেউ একজন আছে। জাফর ইকবাল স্যারের ক্যাম্প গল্পের শেষ কয়টা বেশ মনে পড়ছে- আমি মারা যাব কিন্তু আমার উপর বৃষ্টির ফোটা পড়লে আমি সেই অনুভুতি পাব না। অথবা রবি ঠাকুরের কবিতা- মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দর ভুবনে। জীবনান্দ দাশের মত যদি আপনি ফিরে ফিরে এই বাংলায় আসতে চান, এই মুহুর্ত, এই কাল এই সময় এই আত্মীয় আপনি পাবেন না। সেইটা আরেক কাল হবে। সুতরাং ধর্মে বিশ্বাস থাকাটা খুব জরুরি। কারণ আপনি অস্তিত্বহীন সবসময় এবং একা। আমি জাতীয় ঈদগাহে ঈদের নামাজে বয়ানে মাওলানা সালাউদ্দিনের একটা কথা খুব মনে পড়ছে- হযরত আলী (রা) বলছেন, যদি মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে কিছু না থাকে তাহলে তো সবাই বেচে গেলাম, কিন্তু যদি থাকে তাহলে আমার সেই জীবন নিয়ে খুব ভয় হয়, কারণ আমি জানি না কেমন হবে সেই জীবন। এই কারনেই আমার কেন যেন মনে হয় রাজকুমার সিদ্ধার্থ যৌবনে ঘর ছেড়েছেন, হযরত মুহাম্মদ (স) হেরা গুহায় বসে বসে অনেক সময় কাটাইছেন। আমি জানি না তাদের মাথায় কোন অনুভুতি কাজ করত, কিন্তু গত কয়েকদিন যখন আমি এইসব ভাবছি তখন আমার মনে হচ্ছে সবাই এই অনিশ্চিত পথের পথযাত্রী । সুস্থভাবে বেচে থাকুন, আর বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মাথা কম ঘামান। আমি মাথা ঘামায়ে কিছুদিন আগ পর্যন্ত মারামারি করে বাঝে ব্যবহার করতাম, সেই বাঝে ব্যবহারে জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী। আমার প্রচণ্ড মৃত্যু ভয় হচ্ছে, ভয় হচ্ছে আমার পরিবার কে, বিশেষ করে বাবা মা কে নিয়ে এরা এত কষ্ট করল আজীবন অথচ আমি এদের আজীবন কাছে পাব না। এরা ভালো থাকবে তো মৃত্যু পরবর্তী জীবনে। ভালো থাকুন, ভালো ভাবে বাচুন। আর কেউ একজন এই মহাকাল টা আসলে নিয়ন্ত্রণ করেন, আমার ধর্মে সেইটা আল্লাহ তার প্রার্থনা করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:৪১