বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার এক সহপাঠী ছিল মোসাদ্দেক। ওর সাথে আমার পরিচয় প্রথম বর্ষে। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞ্যেস করে, এমন একটা লোক দেখাও যাকে দেখলে ইসলামের কিছু আদর্শ মাথায় ঘুরপাক খাবে, আমি মোসাদ্দেক কেই দেখাব। ওর ধর্মচর্চার ব্যাপার এমন পর্যায়ে ছিল যে ও তৃতীয় বর্ষের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ফেলছে। ওর কিছু ঘটনা বলি, যেগুলো আমার সাথে ঘটছে।
১/২ তে পদার্থবিজ্ঞান ল্যাবের সময় খুব সম্ভবত নাহার ম্যাডাম ওর উপর সেই বিরক্ত হইছিল। বিরক্ত হওয়ার কারন ছিল ল্যাবের কাজ দেখানর সময় ও ম্যাডাম দিকে তাকায়ে কথা বলছি না আর এমন একটা অস্বস্তি প্রকাশ করছে যা ম্যাডামের খুবই চোখে পড়ছে। এই অস্বস্তির কারন হয়ত পর্দা ছিল যা মোসাদ্দেক কে কখনো জিজ্ঞ্যেস করা হয় নাই। কারন ম্যাডাম সেই বকাজকা করছিল। এবং আমি বেশ বিরক্ত হইছিলাম ঘটনায় ওর উপর। কারন এই রকম হলে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কি দরকার? কিন্তু পরে যখন ওর সাথে একটু পরিচিত হওয়ার সু্যোগ ঘটে তখন বুঝছি ও আসলে দুই দিক থেকে বিব্রত ছিল, এক শিক্ষককে অর মনে হইছে যথাযথ সম্মান দিতে পারে নাই, দুই ও ইসলামিক নিয়ম কানুন মানতে পারছে না। এবং এই দ্বন্দে ছিল ও পুরো বিশ্ববিদ্যালয়, অন্তত আমার কাছে তাই মনে হইছে। ঐ ঘটনার পর আমার মনে হল ওরে কিছু ঝাড়ি অথবা বুলি করা উচিত। এবং তারপরে যা করছি সেইটার জন্য বেশ পাপবোধ কাজ করে। কিন্তু ও আমাকে একটা জিনিস শিখাইছে অই দিন, যা আমি মেনে চলার চেষ্টা করি।
আমি আর শোভন হয় মেসে যাচ্ছিলাম অথবা সেন্ট্রাল মসজিদে যাচ্ছিলাম। মোসাদ্দেক আর তরিকুল যোহর নামাজ শেষে বের হচ্ছে, ফলে আই সি টি বিল্ডিং এর বের হওয়ার মুখে দেখা। মোসাদ্দেক তরিকুল আমাদের সালাম দিল, আমি এর উত্তর দিয়েছিলাম আদাব/ নমস্কার। বাকী তিনজন চুপ করে গেল। তরিকুল চুপচাপ চলে যাচ্ছিল। মোসাদ্দেক ঘুরে এসে আমাকে মসজিদের সামনে ডাকল, আমি গেলাম। ও তখন কয়েকটা কথা বলছে যা এখনো কানে বাজে। আমি ওর চোখের দিকে তাকায়ে ছিলাম, চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে যাবে এমন একটা অবস্থা, প্রচন্ড কষ্ট পাইছে ছেলেটা। ও আমাকে তখন বলল আমি কিন্তু তোমাকে একটা দোয়া দিছিলাম কিন্তু তুমি এর উত্তরে যা বললা আমার খারাপ লাগছে। আর এইটা মজা করার জিনিস না। আমি কোন কথাই বলি নাই। ওর চোখের দিকে তাকায়েই বুঝে ফেলছি বিশাল একটা খারাপ কাজ করে ফেলছি। কিন্তু ওই কথা বলার পর থেকে আমি দুইটা কাজ করি সবসময় কথা বলা শুরুর সময় সালাম দেয়ার চেষ্টা করি, যাদের সাথে অনেকদিন পর পর কথা হয়, আর কথা শেষে আল্লাহ হাফেজ, এমনকি নাম্নীকে ফোনে কথা বলার পর আল্লাহ হাফেজ না বলা পর্যন্ত ফোন কাটি না। এই ঘটনার পর ওর সাথে আমার একটা ভালোই সম্পর্ক হয়। কারন আমি বুঝছি বাকি সবার ইসলাম চর্চা আর ওর ইসলাম চর্চার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। এবং যেইটা আমি খুব কম ধার্মিক মানুষের মধ্যে দেখি। সবাই খুব উত্তেজিত থাকে, কিন্তু ওকে আমি দেখছি ও বেশ কষ্ট পায় আজেবাজে কোন ঘটনা ঘটলে।
ওর সাথে আমার পরের সম্পর্কগুলো একটু ভালো হয় দুই কারনে, এক ক্লাসে খুব বেশি পকপক করার কারনে মানুষ মনে করত আমি ভালো ছাত্র, দুই হলে ২/১ ২/২ তে খেতে যেতাম তখন হলে আসা যাওয়ার কারনে ওকে একটু পড়াশুনায় সাহায্য করছিলাম। সেইখানে বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটে।ঐ সময়টায় নিয়মিত হলের ক্যান্টিনে খাওয়ার কারণে ওর সাথে বেশিরভাগ সময় দেখা হত যখন ও নামাজ পড়তে যেত। আমি ২/১ এর ফাইনাল এক্সাম দিছি হলের রিডিং রুমে পড়ে। কারণ মেস তখন সুবিদবাজার ছিল। রাতে হলে চলে আসতাম রিডিং রুমে পড়তাম আর মাঝে মাঝে ফয়সালের রুমে ঘুমাতাম। ও অই সময়টায় পড়তে আসত বঙ্গবন্ধু হলের রিডিং রুমে। আমার একটা অভ্যাস ছিল আমাই বেঞ্চে ঘুমায়ে পড়তে কোন অসুবিধা হত না। ও হয়ত রাতে নামাজ পড়তে যেয়ে কোনভাবে দেখছে আমি ঘুমায়ে টেবিলে, ও ধরে নিয়ে এসে ওর বেডে শুতে বলল। কাল ফাইনাল এক্সাম আমি ওর বেডেই ঘুমায়ে পড়ছি। পরে ও আমাকে সকালে ডেকে দিয়ে বলল, যাতে শেষ মুহুর্তের প্রিপারেশন নেই। আমি পরে জানলাম ও হলের মসজিদে রাতে ঘুমাইছে। অথচ ওর ও এক্সাম ছিল। আর আমি ওর বেডে আরামে ঘুমাইছি। অই যে বললাম ও কেউ কষ্ট পাচ্ছে এইটা দেখলে বেশ কষ্ট পায়। আমি খুব কম মানুষের মধ্যেই এইটা দেখছি। ওর সাথে আমার শেষ কথাবার্তা হয়, সিলেটের তেমুখিতে যখন ইজতেমা হয়।
আমার স্পষ্ট মনে আছে ওইদিন শুক্রবার ছিল। জুম্মার নামাজ শেষে নাম্নী বলল ও লেডিস হলের বিরিয়ানি নিয়ে আসবে, আমরা খাব। আমি খাওয়া দাওয়া শেষে কিলোরোড দিয়ে হেটে যাচ্ছি, তখন একটা লোক মাথায় ব্যাগ, দুই হাতে দুই ব্যাগ বেশ কষ্ট করে নিয়ে হেটে আসতেছে, কোন রিকশা পায় নাই বলে। আমাকে সালাম দিল, আমি উত্তর দিতে যেয়ে দেখি এইটা মোসাদ্দেক। ওরে অবস্থা দেখে আমার মনে হল ওকে সাহায্য করা উচিত। কিন্তু ও কিছুতেই আমাকে ব্যাগ দিবে না। আমি পরে জোর করে বললাম আচ্ছা তুমি একা হেটে যাচ্ছ আমি তোমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য কিছু দূর যাব। আমি মাঝামাঝি আসার পর বললাম আমি তোমার সাথে হেটে যাচ্ছি অথচ তুমি আমাকে ব্যাগ সাহায্য করতে দিচ্ছ না, আমার খারাপ লাগছে। তখন ও আমাকে একটা ব্যাগ দিল। সেইটা আমি যখন চেতনা একাত্তর পর্যন্ত যাওয়ার পর ও দাড়ায়ে গেল, বলল তুমি অনেক কষ্ট করছ আমি আর কষ্ট দিতে চাচ্ছি না তোমাকে, তুমি ব্যাগ দিয়ে দাও। নাছোড়বান্দা ওকে দিতেই হল। রিকশাও নাই, ঠিক করে দিব। অনেক পরে আমি টিউশনি করাতে যেয়ে দেখলাম সিলেট ইজতেমা মাঠ ছিল খিদিরপুর, যা সাস্ট থেকে প্রায় ৫-৬ কিলোমিটার। পুরো রাস্তাটা এভাবে হেটে আসছে। আমি যতবার অই ইজতেমা মাঠ পার হইছি ততবার আমি একটা দুর্বল ঠাণ্ডা হাতের করমর্দন অনুভব করি । ও এতটাই দুর্বল ছিল যে ও ঠিকমত খাওয়া দাওয়াই করত না।
আমার ওর কথা বলার কারণ আছে একটা। ইসলাম শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এইটা জোর করে প্রমান করার কিছু নাই। আমি ছোট্ট একটা উদাহরন দেই- বুয়েট, ঢাবি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটা স্টান্ডার্ড। এইটা সেরা। এইটা বারবার যদি কেউ বলে যে এইটা সেরা, আমি ঢাবিয়ান, বুয়েটিয়ান, তখন জিনিসটা নিয়ে মজা হয়। আমি প্রায় একটা কথা বলি, ইসলামের প্রভাব সবার মধ্যে ঢুকবে, এইটা জোর করে ঢুকানোর কিছু নাই। কিন্তু সমস্যাটা করে অতি উৎসাহীরা। মোসাদ্দেকের মত ছেলেরা কখনই এইসব নিয়ে চিল্লাফাল্লা করবে না, ওরা ইসলামের আঘাত দেখে কষ্ট পাবে, যে ইসলামকে অপমান করে তার সামনে যেয়ে চোখের পানি বের করে বলবে ভাই তুমি যা করছ এইটা আমাকে বেশ কষ্ট দিছে, তার সামনে নিজের দুর্বল হাতখানা বের করে দিয়ে বলে দেখ ভাই আর এইটা করো না। এবং মোসাদ্দেকের মত ছেলেরা চিল্লাফাল্লা করে না দেখেই, এক শ্রেনীর মুসলিম আছে যারা ফ্রান্সের শিক্ষক কোপায়ে মেরে ফেলবে, ফলে ইমানুয়েল ম্যাক্রো সুযোগ পাবে ইসলামকে অপমান করার। আমি ভাবি ব্যাপারটা এমন হলে কেমন হত, যেই শিক্ষক নবীর ব্যঙ্গ চিত্র দেখাইছে ওর সাথে যদি মোসাদ্দেক যে আচরন করছে সেইটা করত। অই শিক্ষকের সামনে যেয়ে যদি বলা হত, যে ভাই নবী আমাদের বেশ প্রিয়, তুমি এই ছবিটা ব্যবহার করছ এইট খুব খারাপ লাগছে। অই শিক্ষক লজ্জা পেয়ে আর কখনও এই কাজ করত না। কিন্তু আমার আফসোসটা এইখানেই মোসাদ্দেকরা কখনও উত্তেজিত হয়ে এইসব করবে না, আর ওরা কখনই ক্ষমতায় যাবে না। ক্ষমতায় যাবে মোদির মত, এরদোগান, ম্যাক্রো, ট্রাম্পের মত একপ্রকার মানুষ। এই যে আজ লালমনিরহাটের ঘটনাটা ঘটল এইটা নিয়ে অনেক কথা হবে, কিন্তু এক শ্রেনীর উত্তেজিত লোকের কাজ এইটা। আমি জুম্মার নামাজ শেষ করে যখন এই লেখা লিখছি তখন এলাকায় বিশাল একটা মিছিল বের হল ফ্রান্সের পন্য বয়কট নিয়ে। আমি আবেগকে চূড়ান্ত সম্মান দিচ্ছি, বয়কট করে যদি শান্তি পায় করেন, কিন্তু এইযে উত্তেজিত হয়ে মানুষ মেরে ফেলা এইট ইসলামকে আরো অপমান করে, যারা ধর্ম মানতে চায় না তাদের কাছে। আমি হয়ত ইসলামফোব, কারণ আমার এক বন্ধু আমাকে বলছে আমি নাস্তিক তাই ইসলামফোব, ইসলাম ধর্ম শ্রেষ্ঠ আমি মানি, আমি এও বিশ্বাস করি- ইসলামের প্রভাব দিন দিন বাড়বে কিন্তু সমস্যা হবে অন্য জায়গায়, মোদীর, এরডগানের, ম্যাক্রো, ট্রাম্পের মত লোক ক্ষমতায় আসবে। ফলে আপনাকে জোর করে সারাদিন বলতে বলা হবে- বল ইসলাম শ্রেষ্ঠ। আমার আপত্তি সেখানেই।
আজ বারো ই রবিউল আউয়াল। আমার মনে হচ্ছে আমার বলা উচিত- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”। শেষ কথা বলে রাখি, আমার আর ধর্ম নিয়ে কোন পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে নাই, আমার মনে হয় এইটা শুধুই একটা বিভেদ তৈরি করে। নিজের কাজের ক্ষতি। আমি লাস্ট কয়েকদিন quran.com থেকে কুরান নতুন করে পড়তে যেয়ে বুঝলাম আমি যাদের দেখি বেশ ইসলামিক এদের কথায়, মানবিক গুনাবলী আর ইসলামিক লেখার উদ্দেশ্য উত্তেজিত করা মানুষকে। সেইটা আরিফ আজাদ হোক, আর আলহামদুল পেজ। ঘুরে ফিরে ওই এক কথাতেই যাবে- যারা বিশ্বাস করেন না, কুরান আল্লাহর বানী তাদের জন্য এই এই আয়াত। এমন কী আমি নিজেও উত্তেজিত হয়ে অনেক কিছু বলে ফেলি যা খুবই খারাপ। হুদাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করে কি মজা পায়। নবী (স) মারা যাওয়ার দশ বছরের মাথায় কাছের সাহাবীরা একে অপরকে সন্দেহ করে যুদ্ধে লিপ্ত হইছে, হযরত ওসমান (রা) পুরো খিলাফতকালে কাটাইছে এই দ্বন্দ নিরসন করতে, হযরত আলী (রা) এবং হযরত আয়েশা (রা) একে অপেরর বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরছে, এইসব নবীর সবচেয়ে কাছের সাহাবীদের মধ্যে ঘটছে, আর আপনি কিভাবে আশা করেন, নবী (স) এর ১৪০০ বছর পর নবী কে না দেখে দুইটা ভিন্ন মত তৈরি হবে না, আর মানুষ আপনার কথা শুনবে?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৪৩