সুং সাং পাড়া, পাসিং পাড়া, জাদিপাই পাড়া হয়ে জাদিপাই ঝর্ণা দর্শন, আবার জাদিপাই পাড়া হয়ে, পাসিং পাড়াতে দুপুরের আহার, এই পর্যন্ত পুরো ট্রেকিংটায় মনে হচ্ছিল যেন... পৌষের শীতে যেন চৈত্রের খরতাপ!! হ্যাঁ এমনই!
যারা ২৯, ৩০, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ তে, ওইসব জায়গাতে গিয়েছেন তারা সবাই এটা পেয়েছেন বোধয়? দুপুরের আহার শেষে ৩ টা ৩০ মিনিটে কেওকারাডং হয়ে আর একবার কেওকারাডং এর চুড়াতে ওঠা!! অনেকেই এটাকে বেশী বেশী বলে ফেলেছেন! কিন্তু আমি জানি, আর একবার না উঠে আমি বগালেক আসতে পারবনা! আর একবার ওর কাছে যাওয়া চাইই চাই!! সে যে কি মায়া! কি টান! কি আকর্ষণে! আমি বোঝাতে পারবনা!
সন্ধা তখন চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরেছে, পাহাড়ের উপর থেকে বগালেক যেন বলছে.........এসো, আমাতে এসো! ভেজাবো তোমায়, আমার মায়ায়! লুপ্ত হবে তোমার ক্লান্তি, ঘিরে ধরবো তোমায়, আমার আচ্ছন্নতায়!
১১ ঘণ্টার টানা ট্রেকিং শেষে, বগালেকের শীতল জলে, মনের সাধ মিটিয়ে গোসল করে, আমাদের রাত্রি বাসের মাচায় ফিরে এলাম। একগ্লাস গরম পানিতে, নিজস্ব কফি ও বোতলের মুখ মেপে চিনি দিয়ে, শরীর টাকে বাঁশের দেয়ালে কেবল এলিয়ে দিয়েছি, অন্য সবাই গেছে চায়ের সুধা পানে ক্লান্তি দূর করতে।
শরীর টাকে এলিয়ে দিয়ে বাঁশের ঘরের ছোট খাট ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বাইরের আবছা প্রকৃতিকে উপভোগের চেষ্টা করছিলাম- লেকের টলমলে স্বচ্ছ জলের সন্ধার আগমনে কালো হয়ে যাওয়া, আকাশে শত-সহস্র নিয়ন আলো, বেড়ার ফাঁক গলে ছোবল মারা মধ্যশীতের কনকনে বাতাস, আশেপাশে অবস্থানরত অন্যান্য অভিযাত্রীদের যান্ত্রিক আলোচনা! কে কয়টা ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছে আর তাতে কয়টা লাইক বা কমেন্ট পড়েছে! ইত্যাদি, ইত্যাদি।
তো এই সব উপভোগের পাশাপাশি ১০-১৫ মিনিট থেকে আমি লক্ষ্য করছিলাম, প্রায় ৮-১০ টা চা বা এই জাতীয় দোকান থাকা সত্তেও সবাই (অন্য টিমের সদস্যরাও!!) একটি মাত্র দোকানে বসে চা-সিগারেট, চিপস-চকলেট এই জাতীয় জিনিষ গুলো উপভোগ করছে! অন্য সকল দোকান প্রায় ফাঁকা!
অন্য দোকানে যে দু-একজন বসে ছিলেন বা চা পান করছিলেন, তারাও আবার এই দোকানে এসে চায়ের অর্ডার দিচ্ছেন এবং চা নিয়ে বসেই রয়েছেন! কেউ-ই ওই দোকান থেকে উঠছেননা! এমনকি আমাদের টিমের যেসব সদস্যরা ভীষণ-ভীষণ ক্লান্ত ছিল, যারা কোনমতে এক কাপ চা শেষ করে, একটা ঘুম দেবে বলে ঠিক করেছিল, তাদের পর্যন্ত ওঠার কোন ইচ্ছাই দেখা গেলনা!
বিষয়টা আমার কাছে বেশ খটকা লাগলো, মনে মনে ভাবছিলাম ব্যাপারটা কি? কি আছে ওখানে? সবাই কেন মৌমাছির মত ওই দোকানে ভিড় করছে, ঘিরে ধরেছে? কিন্তু পায়ের আরামের কাছে ওই বিষয়টি উপেক্ষিত রাখলাম!
কিন্তু আর পারলাম না! যখন দেখলাম আমাদের টিমের সবচেয়ে ভদ্র, সভ্য এবং বিনয়ী এবং অবশ্যই সুইট ছেলেটি আর পাহাড়ে এসে সবচেয়ে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ক্ষোভে ফেটেপড়া এবং বান্দরবানে আর কোনোদিন না আসার প্রতিজ্ঞাবধ্য ছেলেটিও ওই দোকানের মায়ায় আচ্ছন্ন! তখন, আমার নিজের কৌতূহল মেটাতে উঠতেই হল!
প্রথমে গেলাম সিয়াম দিদির দোকানে (যেহেতু সিয়াম দিদি বেশ পরিচিত, ওনার দোকানে আগে না যাওয়াটা, হয়তো ওনার মন খারাপের কারণ হতে পারে!), চা নিলাম আর ওই দোকানের দিকে চোখ রেখে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম, ব্যাপারটা কি? কিন্তু আধোআলো আর আধো অন্ধকারে সেটা বোঝা যাচ্ছিলনা।
অবশেষে কফি শেষ করে আমিও গেলাম ওই দোকানে, ভিড় ঠেলে ভিতরে যেতেই বুঝলাম, ওহ এই কারণ! স্বাভাবিক! খুবই স্বাভাবিক! এতো দিনের এতো ক্লান্তি-অবসন্নতা-রাগ-ক্ষোভ-ব্যাথা-বেদনা দূর করার জন্য এর চেয়ে ভালো উপাদান-উপকরণ বা উপহার আর হতেই পারেনা!
আর এই পাহাড়ের মত নির্জন-দুর্গম-দুর্লভ জায়গায়, এতো মৌচাক! বগালেকে মৌচাক!!
তার চুল থেকে শুরু করে, পায়ের পাতা পর্যন্ত সব কিছুই যে মোহিত হবার মত! আর তার কথা বার্তায় আহ্বান! বাঙালি পুরুষের আকুলতা! চায়ের কাপ দেয়ার সময়, ইচ্ছে করে আঙুলের ছোঁয়া! পাহাড়ি শীতেও নিজেকে যথেষ্ট আকর্ষণীয় ও কমনীয় করে মৌমাছি! ধরে রাখার অভিপ্রায়ে পর্যাপ্ত কাপড়ের অযথা অপচয়!
ইচ্ছে করেই বারে-বারে খসে পড়া ওড়নার সম্মোহন, দুই ঠোঁটের ফাঁক গলে ধেয়ে আশা উষ্ণ কুয়াশা! বিভিন্ন পন্য বিনিময়ের সময় সঠিক ও যথাযথ ইচ্ছাকৃত স্পর্শ! এবং উপস্থিত সকলকে সম্মোহনে বিমুঢ় করে রাখা!
তো একে কি বলা যায়?
আমি বলেছি বগালেকে মৌচাক! ভ্রমরের আকর্ষণ!!
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৫ সকাল ৯:২৮