যখন ভোঁর হবে-হবে করছে, দিনের আলো তখনও ফোটেনি, কিন্তু প্রকৃতির ডাকে সাড়া না দিয়ে আর কোন উপায় না দেখে, চরম ঠাণ্ডা বাতাস আর শীতকে উপেক্ষা করে যখন বের হলাম; কিছুক্ষণের জন্য আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, প্রকৃতির ডাকের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম! চারিদিক যেন সোনায় মোড়ান!
যতদূর চোখ যায় শুধু সোনালি আভা চোখে পড়ছে, একটুও সময় নিলামনা, চলে গেলাম চূড়ার উদ্দেশ্যে। চতুর্থ বারের মত চুড়ায় উঠে, গতকাল রাত আর আজকের সকালকে মনে হল আমার দেখা সবচেয়ে মোহময় মুহূর্ত দুটি আমি দেখে ফেলেছি। যা শিমলা-মানালির চেয়েও আমাকে বেশী বিমোহিত করেছে। ঠাণ্ডাটা শরীরের ভিতর পর্যন্ত চলে যাচ্ছে দেখে রুমে গেলাম আরও কিছু গরম কাপড় পরতে, সবাইকে ডাকলাম, কিন্তু তেমন কারো সাড়া না পেয়ে চলে এলাম, চুড়াতে, এই মোহময় রূপসুধা উপভোগের জন্য যেন একটুও সময় অন্য কোথাও ব্যয় নাহয়!
কতক্ষণ ছিলাম জানিনা, মন চাইছিল একটা দিন, অন্তত একটা বেলা কেওকারাডং এর কাছে থেকে যেতে, কিন্তু অন্য সবার মতামত এবার আর উপেক্ষা করা সম্ভব ছিলনা বলেই শুরু করলাম, আজকের ট্রেকিং.........। গন্তব্য সুংসাং বা সুনসান পাড়া (যে যেভাবে পড়ে বা বলে), রুমানা পাড়া হয়ে, জিংসাং ঝর্ণা (নামের উচ্চারন ব্যাক্তি বা অবস্থান ভেদে ভিন্ন হতে পারে), এবং ডাবল ফলস।
সবাই বেশ খুশী! কারণ কেওকারাডং থেকে এবার শুধু নামছি আর নামছি, বেশ কঠিন কিন্তু নামাটা, কারণ ট্রেকার মাত্রই জানেন যে, পাহাড়ে চড়াই এর চেয়ে উতরাই মোটেও কম কষ্টের নয়। বরং কখন, কখন বেশী কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ; কারণ, নামার ক্ষেত্রে হাঁটুতে এবং গোড়ালিতে বেশী চাপ পড়ে, তাই বেশী সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু অনেকেই নামাটাকে সহজ মনে করে, অতি আনন্দে তাড়াতাড়ি নামতে চায়, যে কারনেই দুর্ঘটনার সম্ভবনা পাহাড়ে উঠার চেয়ে নামার সময় সাধারণত বেশী হয়। আর স্বভাবতই আমরা সাধারন ট্রেকাররা নামার চেয়ে উঠতেই বেশী সতর্ক থাকি, যে কারনে ওঠার সময় তেমন একটা সমস্যা হয়না।
সবার খুশী দেখে মনে, মনে বলছি, “বাছারা যতটুকু নামছ, আবার ততটুকুই উঠতে হবে!” হয়তো বেশিও!
গাইড সবাইকে একটু ধীরে, ধীরে নামার পরামর্শ দিল কিন্তু তেমন কেউই কানে আমলে নিলনা, তারা, তাদের মতই নেমে যাচ্ছে, সাবধান বলতে, বলতেই মিতুল ধপাস! প্রথম পিচ্ছিল, একেবারেই শুকনো জায়গায়! কিন্তু পা পড়েছিল ঝুরো মাটিতে, পাহাড়ের ঝুরো মাটি অনেক ঝামেলার। পা পড়লেই, পা হড়কায়, কারণ ঝুরো মাটিতে, স্যান্ডেলের গ্রিপও তেমন কাজ করেনা, এটা বেশ সতর্কতার সাথে পার হতে হয়। আর এ ক্ষেত্রে যে কাজটা করতে হয় টা হল, একটা সুত্র ফলো করা, সেটা এমনঃ
“তুমি তোমার পরবর্তী ধাপ ফেলার আগে ভেবে নাও, তার পরবর্তী ধাপের জায়গা আছে কিনা? যদি না থাকে, তবে জায়গা বানাতে হবে! এবং সামনের ধাপ ফেলার আগে দেখে নাও, সামনে যাওয়ার জায়গা না থাকলে, পিছনে ফিরতে পারবে কিনা?” তার মানে কঠিন ট্রেইলে মোটামুটি চারটি ধাপের জায়গা থাকা আবশ্যক। বর্তমান অবস্থান, পরবর্তী স্টেপ, তারপরের স্টেপ, এবং অবশ্যই বর্তমান অবস্থানের আগের স্টেপ। একথা গুলো কোথায় যেন পড়েছিলাম, তখন থেকেই পাহাড়ে গেলে মেনেচলি, কারণ পাহাড়ে নিজের নিরাপত্তা, নিজের কাছেই (সৃষ্টিকরতার পরে)।
এসব লেকাচার এখন নাহয় থাক! সুংসাং পাড়াতে পৌঁছে সবাই সামান্ন নাস্তা করতে শুরু করলো, আর, আমি? আমার প্রাকৃতিক চাপে বিপর্যস্ত প্রায়! কারবারির কাছে অবস্থান জেনে চললাম প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে, টয়লেটে ঢুকে আমি থ............?? একি দেখছি আমি? এও কি সম্ভব? পৃথিবীতে টয়লেট এতো মনোরম, এতো মায়া মাখা, এতো মন কেমন করা হতে পারে?? এযে অভূতপূর্ব, অবিশ্বাসও! কারণ? কারণটা একটু পরে বলি......।
একটু ভাবুনতো... যারা একটু সচ্ছল, সামান্ন সৌখিন, এক চিলতেও সুযোগ যাদের আছে, টয়লেটের ব্যাপারে তারা কতটা সিরিয়াস? ভেবে দেখুনতো... বাসা ভাড়া নিতে গেলে আমারা প্রথমে কি দেখি? হ্যাঁ টয়লেট! কয়টা টয়লেট? কতটা বড়? কতটা পরিষ্কার? ভাল ভ্যানটিলেশন আছে কিনা? ইত্যাদি, ইত্যাদি, তাইনা?? এরপর কি দেখি? বেলকনি বা বারান্দা...তাইনা?? কিন্তু কেন? বাইরের আলো আসে কিনা? কতটা বাতাস আসবে? শীতের সময় রোদ আসবে কিনা? আসে পাশে কতটা খোলামেলা? ইত্যাদি। তারপরে আসি মাস্টার বেড, গেস্টরুম, ড্রয়িংরুম এসবে... ঠিক কিনা?
তো এই জন্যই বললাম, এটা হল আমার দেখা পৃথিবীর সেরা টয়লেট! কারণ এর আগেও বহুবার পাহাড়ে গিয়েছি, প্রতিবারই কমবেশি বিব্রত হয়েছি, যারা গিয়েছেন তারা হয়তো মনে, মনে হাসছেন, সত্যটা এতদিন কেউ বলতে পারেননি তাই! নিজের ভিতরে চেপে রেখেছিলেন! বড়জোর খুব কাছের বন্ধু বা সহযাত্রীদের সাথেই ব্যাপারটা শেয়ার করেছিলেন। আর প্রতিবার পাহাড়ে যাবার আগে এবিষয়টা নিয়ে সামান্ন হলেও চিন্তিত থেকেছেন!
সেজন্যই এটা শুধু আমার কাছে নয়, পাহাড় প্রেমী মানেই পৃথিবীর সেরা টয়লেটের মর্যাদা পাবে! কারণ যেখানে প্রত্যাশা শুনেরও নিচে, সেখানে গিয়ে যদি দেখেন যে, যেদিগে তাকাবেন শুধু পাহাড় আর পাহাড়! পাহাড়ে পাহাড়ে গা ছোঁয়াছুয়ি বন্ধুত্ব! চারিদিকের পাহাড়েরা সবুজের চাদর বিছিয়ে রেখেছে! স্তরে, স্তরে পাহাড় আর পাহাড়, মন মাতাল করে দেয়া সৌন্দর্য! সেখানে আপনি কতটা সময় কাটাবেন? সেটা আপানর নির্ধারিত নয়! নির্ধারণ করবে কমডে অভ্যস্তরা কতক্ষণ কমোড ছাড়া বসে থাকতে পারবেন, তার উপর! হ্যাঁ, সত্যিই বলছি, গিয়েই দেখুন না একবার! আর যারা গিয়েছেন তারা চোখ বন্ধ করে মনে দেখুনতো! (যদিও এই সময় সাধারণত আমরা অন্য কিছুই খেয়াল করিনা, সেটাই স্বাভাবিক)।
কারবারির বউ ও মিরিন্ডার বোতল......! (লখ্যহীন এডভেঞ্চারের পরবর্তী গল্প)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১৫ সকাল ৯:০৪