কৈশোরের প্রথম ভালোলাগার কথা মনে পড়ে? স্কুলের ভালোলাগা সহপাঠিনী, যার চোখে একবার চোখ পড়লেই মেঘলা দিনও রঙিন হয়ে যেত! হৃদয় জুড়ে সুখের বাতাস বয়ে যেত! আর যদি কখন টিফিনের ফাঁকে মনে হত যে, সে আমার দিকে তাকিয়েছে বা দেখছে তবে তো পরবর্তী কয়েকদিনের জন্য সান্ত মন অশান্ত হয়ে উঠতো! অথবা একক্লাস ছোট বা বড় কোন মেয়ে যাকে এক নজর দেখার জন্য বার বার ক্লাস থেকে বের হতে মন আনচান করতো! যার দৃষ্টিতে দৃষ্টি বিনিময় ছিল পরম অরাধ্য! আর যদি চাইতো কোন কিছু ধাঁর? পেন, পেন্সিল, পানি, পেপার, বা কোনো বই-খাতা-নোট? বর্তে যেতাম অনন্ত আনন্দে! অথবা স্কুলের আসার পথে একটু দেখা!
অথবা মেয়েদের ক্ষেত্রে ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র বা বড় ক্লাসের কোন বড় ভাইয়ের প্রতি কিছুটা ভালোলাগা বা একটু আকুলতা! সহানুভূতির পাওয়ার ব্যাকুলতা! বিকেলে বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় সাইকেলের টুং, টাং শব্দ শোনার অধীর অপেক্ষা! বা ছাঁদে উঠে বাড়ির ছোট ভাইবোনদের সাথে কথা বা গল্পের ছলে পাশের বাড়ির ছাদের ভাইয়ার মনোযোগ আকর্ষণের অপার আগ্রহ! ঘুড়ি ওড়ানোর ছলে চোখাচুখি! বা স্কুলের ছুটির ভীরে একটু ছুঁয়ে যাওয়ার বাসনা! কখনও, কখনও দু-একটি উড়ো চিঠি পাওয়ার অসীম আনন্দ! অথবা স্কুলে যাবার পথে চোখের চাওয়া!
অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, যে, গল্পের নামের সাথে এইসব মধ্য! বেলার, মিথ্যে আবেগের কি সম্পর্ক? হ্যাঁ সেটাই তো! কিন্তু না! সম্পর্ক আছে! হ্যাঁ আসলেই আছে! চলুন দেখি কেন? ও কিভাবে?
প্রথম ভারত ভ্রমণের পরিকল্পনাই শুরু হয়েছিল সিমলা-মানালিকে ঘিরে, কিন্তু সেবার কোলকাতা গিয়ে বুঝতে পারলাম হবেনা, সময়-খরচ কিছুতেই আমরা কুলিয়ে উঠতে পারবনা, যে কারনে সেবার দিল্লী আর আগ্রা দেখেই ফিরে এসেছিলাম।
এরপর আবার সেই সিমলা-মানালির পরিকল্পনা করা হল, কিন্তু বিভিন্ন কারনে সেবার দার্জিলিং-কালিম্পং-মিরিখ দেখে ফিরে এলাম, অপেক্ষা আর অপেক্ষা, কিছুতেই সবকিছু মিলছিলনা! কিন্তু মন-প্রান সব বারে, বারে চলে যায় সেই সিমলা-মানালিতে! স্বপ্নে বরফ! কথায় বরফ, ঘুমে বরফ! জাগরণেও! বরফ আর বরফ! সকল কথাবার্তার আগে,পরে মাঝখানে চলে আসে বরফ! এই ছিল আমাদের অবস্থা, দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মাস! একসাথে বসলেই সবার একটাই চাওয়া এবার সিমলা-মানালি চাইই, চাই! যেতেই হবে! আরাম এবার পেতেই হবে বরফের বিছানায়! শরীর এবার এলিয়ে দিতেই হবে বরফের দেয়ালে! তাই এবার দীর্ঘ ছয় মাস ধরে চলছিল ব্যাপক পরিকল্পনা, কর্মযজ্ঞ, সময় ও অর্থের সম্মিলন ঘটানোর মহাউৎসব!
বহু অধ্যাবসায়, শ্রম আর সাধনার সম্মিলনে এলো সেই ক্ষণ! আমার সিমলার পথে! কোলকাতা-দিল্লী-পাঞ্জাব-চণ্ডীগড় এবং সবশেষে হিমালয়ান মাউনটেরিয়ান হাইওয়ে পেরিয়ে সিমলার প্রবেশ দারে! পেরিয়ে এসেছি বহু সাধ ও সাধনার সময় ও পথ, বরফের দেশের পানে! মনের টানে! প্রানের ডাকে!
আর নেই চিন্তা বা ভঁয়, নেই না পেয়ে ফিরে যাবার আশঙ্কা! পেতে, পেতেও না পাবার যন্ত্রণা! নেই কোনো সন্দেহের অবকাশ! এই যে পৌঁছে গেছি বহু দিনের লালিত স্বপ্নের সিমলায়! বরফ এখন হাত ছোঁয়া দুরত্তে! শুধু রাতের আঁধার পেরিয়ে দিনের আলো ফোঁটার অপেক্ষায়! মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা! এখন শুধু ঘুম আর ঘুমের শেষে বরফের ডাকে, বরফের বিছানায়! বরফের দেয়ালে! আর বরফের প্রান্তরে!
সুতরাং সেই স্কুল জীবনের প্রথম, প্রথম ভালো লাগার সেই অবিকল একই আবেগ আর সকালে পথে যেতে বা স্কুলের গেটে বা ক্লাস রুমে অথবা টিফিনের ফাঁকে বা বিকেলে বাড়ির ছাঁদে, না হয় জানালার ফাঁকে! সেই রূপ বা মধু মাখা মুখ দেখার অপেক্ষার মত বা দৃষ্টি বিনিময়ের মোহময়তার মত দারুণ মন ছটফট করা রাত শেষের অপেক্ষায়!
সকাল হতেই ছুটে বেরিয়ে পড়া একা-একা, বরফের প্রথম পরশ নেব বলে! কিন্তু বরফ কৈ? অন্য সবাই ও আমার পিছু নিয়েছিল বুঝতে পারিনি! সবাই যে আমারই মত অপেক্ষা করে ছিল জানতে পারিনি! কেউই কাউকে কিছুই বলেনি! সবাই প্রথম বরফ দেখে, ছবি তুলে অন্যদেরকে চমকে দিতে চেয়েছিল! ওই ক্লাসের মাঝারি ছাত্ররা যখন তাঁদের বিশেষ কোন মেধা দিয়ে, ক্লাসের মিষ্টি মেয়েটির নজর কাড়ার মত অবস্থা! অথবা খেলাধুলায় প্রথম হয়ে সহপাঠিনীকে চমকে দিয়ে তার কাছাকাছি এসে মেধাবী ছাত্রটিকে নাজেহাল করার অভিপ্রায়! কিন্তু হলনা কিছুই! কেউই কাউকেই হারাতে পারেনি......
সুন্দরী সিমলা চায়নি তার বরফের শুভ্রতা, শুদ্ধতা, সম্মোহনী সৌন্দর্যের সুষমা কারো একাকে দিতে! যেমন ক্লাসের আদুরে, মায়াময় এবং মিষ্টি ও অসম্ভব বুদ্ধিমতি মেয়েটি চায়না কাউকেই কষ্ট দিতে, দেখতে চায় সবাইকেই সমান চোখে! দিতে চায় সবাইকেই সমান স্নেহ ও সন্মান, যার যেটা প্রাপ্য! ঠিক তেমনি সিমলাও তার বরফ নিয়ে সেটাই করেছে আমাদের সাথে, জিততে দেয়নি কোন একজন কেও, দেয়নি হারতেও!
সুতরাং এবার সবাই মিলে জীপে ওঠো, বরফের দেশে চল...... যাচ্ছি কুফরির পথে, জীপ কয়েকটি বাঁক নিতেই পাইনের বনে ঢুকলো, পাহাড়ের গাঁ বেঁয়ে-বেঁয়ে পাইনের সারি-সারি একহারা সাঁজ, সমান-সবুজ-সাবলীল! আর তাঁদের সৌন্দর্য? সে সীমাহীন! যাচ্ছি আর খুঁজছি, দৃষ্টির সবটুকু শক্তি দিয়ে, হ্যাঁ সেই অনেক কাঙ্ক্ষিত আর কল্পনার শ্বেত শুভ্রতাকে! হ্যাঁ বরফ কে? দেখতে চাইছি একবার!
কে যেন বলল, “ওই দ্যাখ সাদা-সাদা, কি যেন!” সবাই একই সাথে, মুহূর্তেই দৃষ্টি ঘোরালো! হ্যাঁ ওটা কি? বরফ নাকি? নাহ, সেতো অনেক হবে, একই সাথে, একটু-একটু না! নাহ, আমি দেখবো ওটা কি? হবে হয়তো চুনের পানি! এক জনের উত্তর, নাহ, গাড়ি থামান! এখুনি! দেখাতে চাই বরফ না চুন! ড্রাইভার বলে, “আরে সামনে তো বরফ আর বরফ! একটু উপরে উঠলেই!” “এখানে থেমে কি করবেন?!” (অবশ্যই হিন্দিতে)। নাহ, এখানেই থামুন, আগে দেখে নেই! পরখ করে নেই! ওটাই বরফ কিনা?
গাড়ি থামলো, মুহূর্তেই সবাই বেরিয়ে গেল, এক সাথে! উল্কার বেগে! অবিশ্বাস্য দ্রুততায়! সবাই ঘিরে ধরলো, সেই সাদা-সাদা স্তূপকে! এবার একই সাথে বসে হাত ছোঁয়াবো! এখনো বুঝতে পারছিনা বরফ না চুন! সবাই চোখ বন্ধ করে প্রত্যেকের এক হাত দিয়ে আর একজনের হাত ধরে, আর একহাত, একই সাথে সবার! সেই স্তূপের উপর রাখলাম! বিদ্যুৎ চমকের মত হাত সরিয়ে নিলাম সবাই! সবার!! জড়িয়ে ধরলাম এঁকে-অন্যকে, আঁকড়ে ধরলাম পরম অরাধ্য প্রেয়সীর পরশ পেয়ে! হ্যাঁ ওটা বরফই! আবার ছুঁলাম! এবার রোম গুলো জেগে উঠলো! যেনে বুঝে বরফ ছোঁয়ার আবেগে! প্রথম বার কেন এমন হলনা? আবেগের বিহ্বলতায়!
ওই যে? ওই গাছের নিচেও! আর একজন চেচিয়ে উঠলো! ওই যে ওখানেও! এভাবে অনেক-অনেক গাছের গোঁড়ায় জমে স্তূপ হয়ে আছে পেজা বরফ! শুভ্র, কোমল, তুলতুলে, হিমশীতল বরফ! আমরা ছন্নছাড়া যে, যার মতন! এক-একজন, এক-এক জায়গায় মেতে উঠেছে বরফ নিয়ে কৈশোরের প্রথম আবেগের মত, মিথ্যে মরীচিকার মত ভালোলাগায়!
কারণ সামনে রয়েছে আরো অনেক-অনেক সত্যিকারের, সীমানা ছাড়ানো, বরফের সমারোহ! সে, সব বাস্তবতাকে না মেনেই মেতে উঠেছিলাম কৈশোরের অবুঝ, অন্ধ আবেগের মত.....................।
সিমলা-মানালির স্বপ্নিল পথে, অসীম মুগ্ধতায় (পরবর্তী গল্প)......
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৯:৩৯