১৫৭৬ খৃস্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে সুলতান দাউদ খানের পরাজয়ের পর বাংলা মোগল সম্রাজ্যভুক্ত হয়। কিন্তু সম্রাট আকবর বাংলাকে মোগল সম্রাজ্যভুক্ত করলেও কার্যত বাংলার একটি ক্ষুদ্র অংশের উপর মাত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। বাংলার বিভিন্ন অংশে তখন ভূঁইয়া ও আফগান নায়করা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করছিলেন। এ সময় থেকেই বারো ভূঁইয়াদের একটি নতুন ও চমকপ্রদ ইতিহাসের সূচনা। এ সমস্ত স্বাধীনতাকামী জমিদার বা ভূঁইয়া বাংলার মোগল আক্রমণের বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিরোধ গড়ে তুলে মোগল বাদশাহকে সর্বদাই বিব্রত রেখেছিলেন। সম্রাট আকবরের রাজত্বের শেষ ২৯ বছর (১৫৭৬-১৬০৫) এবং জাহাংগীরের রাজত্বের প্রথম ছয় বছর (১৬০৫-১৬১১) তৎকালীন বাংলা বিশেষত পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার প্রকৃত শাসক ছিলেন তারাই। সংস্কৃত ভৌমিক শব্দ হতে ভূঁইয়া শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ জমির মালিক। অবশ্য আগেও প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ভূঁইয়াদের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন মানিকরামের ধর্মমংগল ও মুকুন্দরামের চন্ডীমংগলে পূর্বে হিন্দু রাজারা সম্রাজ্যের ঐক্য ও নিরাপত্তার জন্য তিন শ্রেণীর অধীনস্ত শাসক নিয়োগ করতেন। এরা হলেন বড় ভূঁইয়া, মধ্য ভূঁইয়া ও ছোট ভূঁইয়া। সম্ভবত ‘‘বড় ভূঁইয়া’’ শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে লোকমুখে বারো ভূঁইয়া হয়েছে।
বংগ বিজয়ের প্রাক্কালে বা পরে এইরূপ বারো ভূঁইয়া প্রাধান্য লাভ করেছিল। বলতে গেলে একপ্রকার তাহারাই বঙ্গদেশকে বা নিম্নবঙ্গের দক্ষিণভাগকে নিজেরা ভাগ করে নিয়েছিলেন, এইজন্য বাঙ্গালাকে তখন বারো ভূঁইয়ার মুলুক বা বারো ভাটি বাঙ্গালা বলত। কিন্তু তারা সংখ্যায় যে ঠিক বারজনই ছিলেন, তা বলা যায় না। হয়ত একজনের রাজত্বের শেষ সময়ে অন্যের রাজত্ব আরম্ভ হয়েছিল অথবা কোন প্রধান ভূঁইয়ার মৃত্যুর পর তারা কোন বংশধারা নামমাত্র শাসন পরিচালনা করতেন, কিন্তু হিসাবের বেলায় তিনিও বারোভূঁইয়ার অন্যতম বলিয়া গণ্য হতো। বাঙালিদের প্রাত্যহিক জীবনে বেশ কিছুসংখ্যাকে কেন্দ্র করে প্রবাদ -প্রবচনের প্রচলন রয়েছে, যেমন-পাঁচ, দশ, বার ইত্যাদি। কিন্তু এ সংখ্যাগুলো প্রায়ই সুনির্দিষ্ট সংখ্যার অর্থ বহন করে না। ‘পাঁচ পীরের পরিচয় থাকলেও পাঁচজন পীরের সঠিক পরিচয় আমরা আজও জানি না। ‘দশচক্রে ভগবান ভূত' হয় আমরা জানি। কিন্তু আমরা এ প্রবাদের প্রয়োগ করতে গিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে দশটি চক্রের প্রয়োগ কখনই আমরা অনুভব করিনি। এভাবেই বারো ইয়ারী বা বারোয়ারী বলতে আমরা কখনই সুনির্দিষ্ট বারোজনকে বুঝিনি। এইসব দৃষ্টান্ত হতে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই এখন মনে করেন যে বারো ভূঁইয়া আসলে বারোজন ভূঁইয়ার সমষ্টি নয় এবং তারা যে একই সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন তা নয়। অতএব বারোয়ারী শব্দের মত তৎকালীন অনেক ভূঁইয়ার সমষ্টিকে বারো ভূঁইয়া নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাই বাংলার ইতিহাসে বারো ভূঁইয়া একটি বিতর্কিত অধ্যায়। এটা পরবর্তীকালে এতই বিতর্কের জন্ম দেয় যে, এইসব ভূঁইয়াদের বাংলার জাতীয় চেতনা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতীক হিসেবে দেখা হয় তা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন যদুনাথ সরকারের মতে বারো ভূঁইয়ারা স্বাধীনতার প্রতীক ছিলেন না। আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে যে বারো ভূঁইয়া বারোজন ভূ-স্বামীকে বুঝায় কিন্তু কেউই সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তাদের নামের তালিকা তৈরি করতে পারেননি। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা নামের তালিকায় কয়েকজন বাদে অন্য কারো মিল নেই। অধিকন্তু হেনরী ব্লাকম্যান, বেভারিজ ওডেইলফোর্ডের বর্ণনায় বারোজন ভূঁইয়ার নাম থাকলেও ওয়াইজ সাহেব মাত্র সাতজনের নাম উল্লেখ করেছেন। সমসাময়িক লেখক ও পর্যটকদের বর্ণনায় ভূঁইয়াদের সংখ্যা সঠিকভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তারা ভূঁইয়াদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছেন কিন্তু কোন দুই তালিকাতেই সামঞ্জস্য পাওয়া যায়নি। ভূঁইয়াদের সংখ্যার হেরফের এবং তাদের গোলকধাঁধায় এ ধারণাই জন্মায় যে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সকল ভূঁইয়ার আবির্ভাব ঘটেনি।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। এর মধ্যে আবার সাম্প্রদায়িক মনোভাবও সুস্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে। কেননা অধিকাংশ হিন্দু ঐতিহাসিকই বারো ভূঁইয়াদের নামের তালিকায় হিন্দুদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখিয়েছেন। কিন্তু বারো ভূঁইয়াদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান। সেইসাথে তারা যশোরের প্রাতাপাদিত্যের কৃতিত্ব বড় করে দেখিয়েছেন অন্যদিকে ভূঁইয়াদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ঈষা খাঁনের কৃতিত্বকে ছোট করে দেখিয়েছেন। মূল জটিলতাটি সৃষ্টি হয়েছে এখানেই। তবে সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলার ইতিহাসে বারো ভূঁইয়াদের আবির্ভাব ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় হতে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই আলোচ্য সময়ে মোগলদের বিরুদ্ধে যারা নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছেন ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তারাই ভূঁইয়া। মোগলদের হাত হতে বাংলাকে মুক্ত রাখার জন্য মুসলমান ও হিন্দু জমিদারদের সংগ্রাম বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তাদের মধ্যে ঈসা খান, মুসা খান, রাজা প্রতাপাদিত্য, কেদার রায়, রাজা কন্দর্পনারায়ণ ও রামচদ্র, বাহাদুর গাজী, ফজল গাজী, সোনাগাজী ও ওসমান খানের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এদের কর্মকান্ডকে যেমন বর্তমান যুগের রাজনৈতিক মাপকাঠিতে বিচার করা যাবে না তেমনি আবার একে নিছক জমিদারী রক্ষার যুদ্ধ হিসেবেও দেখা যাবে না।
বারো ভুঁইয়া, মোগল সম্রাট আকবর-এর আমলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল শাসনকারী কতিপয় জমিদার বা ভূস্বামী, বারো জন এমন শাসক ছিলেন, যাঁদেরকে বোঝানো হতো 'বারো ভূঁইয়া' বলে। বাংলায় পাঠান কর্রানী বংশের রাজত্ব দূর্বল হয়ে পড়লে বাংলাদেশের সোনারগাঁও, খুলনা, বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে কিছু সংখ্যক জমিদার স্বাধীন রাজার মতো রাজত্ব করতে থাকেন। সম্রাট আকবর ১৫৭৫ সালে বাংলা দখল করার পর এসকল জমিদার ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোগল সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। 'বারো ভুঁইয়া' নামে পরিচিত এই সকল জমিদাররা হলেন:
ঈসা খাঁ - খিজিরপুর বা কত্রাভূ,
প্রতাপাদিত্য - যশোর বা চ্যাণ্ডিকান,
চাঁদ রায়, কেদার রায় - শ্রীপুর বা বিক্রমপুর,
কন্দর্প রায় ও রামচন্দ্ররায় - বাক্লা বা চন্দ্রদ্বীপ,
লক্ষ্মণমাণিক্য - ভুলুয়া,
মুকুন্দরাম রায় ভূষণা বা ফতেহাবাদ,
ফজল গাজী - ভাওয়াল ও চাঁদপ্রতাপ,
হামীর মল্ল বা বীর হাম্বীর - বিষ্ণুপুর,
কংসনারায়ন - তাহিরপুর,
রামকৃষ্ণ - সাতৈর বা সান্তোল,
পীতম্বর ও নীলম্বর - পুঁটিয়া, এবং
ঈশা খাঁ লোহানী ও উসমান খাঁ লোহানীঃ - উড়িষ্যা ও হিজলী।
সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) তাঁর জীবদ্দশায় সমগ্র বাংলার উপর মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি।কারণ বাংলার বড় বড় জমিদারেরা স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে মুঘলদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।তাঁরা বারভূঁইয়া নামে পরিচিত।এখানে 'বারো' বলতে অনির্দিষ্ট সংখ্যা বুঝায়।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯