রহিমউদ্দিন সদ্দারের হাতে এখন তেমন কোন কাজ নাই, ফজরের নামাজের পরে কুয়াশা পায়ে কিছুক্ষন হাটাহাটি, পুকুরপাড়ে আম,কাঁঠাল গাছ গুলো গনে দেখা,বাসায় ফিরে ছেলের বৌয়ের হাতে এক কাপ চা আর একটা বিস্কুট অথবা মুড়ি.......কাটছে জীবন.....।
৮০ বছরের হালকা পাতলা শরীর, এ সামান্য ধকলেই কাহিল হয়ে আরাম কেদারাই বসে কুয়াশা ভেজা পা মোছে, পুরানো অভ্যাসের মধ্যে প্রায় সব কিছুই টিকে আছে......এখনো মাঘ মাস আসলেই আম, কাঁঠাল গাছগুলোর গোড়ায় পানি দেয়......আর বৌমাকে এসে বলে.....জানো বৌমা....পুকুরের দক্ষিন পাড়ের নুতন আম গাছটাতে মুকুল এসেছে।
বৌমা শুনে আর হাসে......বাবা, ঐ গাছে গত বছর ও আম ধরেছিলো....আমি আচার বানিয়ে ছিলাম, মনে নেই আপনার! রহিম সদ্দারকিছুই বলে না...আনমনে মাথায় হাত বুলায়, চশমাটা পান্জাবীর পকেট দিয়ে পরিস্কার করে আবার চোখে লাগায়।
একামাত্র নাতি , দোলন,এবার ৮ম শ্রেনীতে উঠেছে। ওর বইপত্র গুছানো,বাংলা বইয়ের সব কবিতা আবৃত্তি করে শুনানো, একসাথে নামাজ পড়া,ছুটির দিনে পুকুর পাড়ে বেড়ানো, একসাথে গোসল করা, গল্প বলতে বলতে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া,রহিমউদ্দিন বেশ আনন্দ নিয়েই করে...বলতে গেলে দাদা আর নাতি যেন 'এক আত্মা এক প্রাণ'।
আজ সকালে, বাইরে থেকে ফিরে, চেয়ারেরর উপর নূতন পান্জাবী আর শাল দেখে, বৌমাকে বলে,"আজকে কি কোন অনুষ্ঠান আছে? কোথাও যেতে হবে ? না বাবা......আজকে টেলিভিশন থেকে কিছু লোক আসবে....আপনার ইন্টাভিউ নিতে......। এটা কী করলা , বৌমা, তুমি ওদের কেন বলে দাও নাই আমি স্মৃতি ভ্রষ্ট। বৌমা , কোন উত্তর না দিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে যায়....।দোলন ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকে.....কাঁপা হাতে রহিমউদ্দিন কী যেন খুঁজে....।দোলন বলে,দাদা, "চশমাটা তোমার গায়ের পাজাবী'র পকেটেই কলমের সাথে....."
সাজানো ড্রয়িং রুম,সেগুন কাঠের বড় চেয়ারটাতে রহিম উদ্দিন সদ্দার। গায়ে খদ্দরের পান্জাবী আর কাঁধে ঘিয়া রংঙের শাল।ক্যামরা'র আলোকে পুরো ঘর আলোকিত............।
স্যার একটু বলবেন, সেদিন কী ঘটেছিলো...কীভাবে সবাই মিছিলে নামলো....কখন গোলাগুলি শুরু হয়.....কীভাবে আপনারা প্রথম শহীদ মিনারটা বানালেন...??????
"না না না আমি কিছু জানি না......আমি কিছু জানি.....আমার কিছু মনে নাই...আমার কিছু মনে করতে পারছিনা.."।স্যার, একটু চেষ্টা করুন....দেখুন ! দোলন বলে ওঠে......গত বছর দাদা'র স্ট্রোক হয়..তার পরে উনি অনেক কিছুই ভুলে গেছেন।দাদা'র এ ডায়রিতে সব লেখা আছে.........আমি বলছি .....।
"কার্জন হল থেকে প্রতিবাদের আগুনটা ছড়িয়ে পড়লো প্রায় সব জায়গায়..।দাদা , তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোর ছাত্রনেতা।বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের প্রতিটা হলে হলে গিয়ে সবাইকে ব্যাপারটা বুঝাতে লাগলেন....রাতেই প্রচুর ব্যানার লেখা হল, দেয়ালে দেয়ালে লেখা হলো "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" ,"রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" ।দৃপ্ত পদক্ষেপে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গল ছাত্ররা..সে এক বিশাল গনজোয়ার.....মিছিলের আগে হানাদারদের সাঁজোয়া গাড়ী বহর.....উদ্দেশ্যমূলক ভাবে গুলি করলো আমাদের......দমাতে পারেনি.....লাশ কাঁধে নিয়ে আবার মিছিল হলো...সে রাতেই শহীদ মিনার বানানো হল....।হিংস্র হায়েনারা সেটা গুড়িয়ে দিল.........
সে গুড়ানো শহীদ মিনারের ধুলা দৃঢ় এ হাতের মুঠোই ধরে.......আমাদের এ দাদারা'ই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ঘুড়ি আকশে উড়িয়ে দিয়েছিল......."।
নিশ্চুপ ঘরে হঠাৎ করে গড়িয়ে পড়া এক ফোটা চোখের জলের আওয়াজ শোনা গেল ......।