এক,
“বাজান, ও বাজান, আমি তো শ্যাষ বাজান।“ এতো চিৎকার করছে কেন লোকটা। “আমার পোলাডারে কেউ বাঁচান,আমাদের কেউ বাঁচান, আমি শ্যাষ বাজান, আল্লাহ, ও আল্লাহ!”
গাড়িটা উলটো হয়ে পড়ে আছে এখনো। আচ্ছা এটাকে কি গাড়ি বলা যায় ? নিজের মনে প্রশ্ন করছে পুতুলি। বাবা বলেছে যেটাই চাকা দিয়ে চলে সেটাকেই নাকি গাড়ি বলে, সব গাড়ির চার চাকা থাকলেও কোন কোনটার আবার দুই চাকাও থাকে, আর পুতুলির ছোট ভাই দীপুর চাকা ছাড়া একটা গোল খেলনা গাড়ি আছে, বাবা বলেছে সেটাও এক ধরণের গাড়ি, তবে এই গাড়ি এলিয়েনরা চালায়, আর এলিয়েনদের গোল গোল দেখতে প্লেনও আছে, বাবা আমাকে সেটা কিনে দিবে বলেছে। আচ্ছা এই লোকটার গাড়িটা এমন কেন ? এটা মনে হয় এক ধরণের ঠেলাগাড়ি। যে ছেলেটার এই গাড়িটা ঠেলার কথা সে রাস্তার মধ্যে শুয়ে আছে, কি যেন মজার একটা খেলা খেলছে ওরা। বুড়ো লোকটার চারপাশে অনেক টাকা পড়ে আছে। আচ্ছা ওরা কি অনেক বড়লোক ? তাহলে এতো নোংরা কেন ওরা ! ছি, বাবা দেখলে বকা দিবে নিশ্চিত।
ওমা! কত রক্ত !লোকটার কি হয়েছে ? কাছে গিয়ে দেখলে কি বাবা আমাকে বকা দিবে ? মনে হয়না। আমার বাবা তো সবচেয়ে ভালো বাবা।
“ফকির, মরছে একটা, আরেকটাও মরে মরে অবস্থা।“
“কেমনে কি হইছে ভাই ?”
“আরে মাইক্রো একটা আইসা ধাক্কা দিছে পিছন দিয়া, মরাটা গাড়ি ঠেলতেছিল, আরেকটা বইসা আছিলো”
“মাইক্রো আটকাইছে নাকি কেউ ?”
“নারে ভাই,হিট এন্ড রান কেস”
“আরে আবাল কিছু আছে, গাড়িতে উঠলে রাস্তায় আর কিছু দেখেনা, কে কত্তো স্পীডে গাড়ি চালাইতে পারে সেই পাল্লা দেয়।“
আচ্ছা এই লোকগুলো ভিড় করে শুধু দেখে যাচ্ছে, কেউ সেই ঔষধটা আনছে না কেন, শয়তান দীপুটা খামচি দিয়ে আমার গাল কেটে দিলে তখন বাবা তো আমাকে ঔষধ লাগিয়ে দিয়েছিলো মুখে, তখন তো আর রক্ত বের হয় নাই আমার। আচ্ছা বাবা তো এখনি আসবে, তাকে বলব ওদেরকে ঔষধ দিয়ে দিতে, আমার বাবা সবচেয়ে ভালো বাবা।
দুই,
“কি ব্যাপার, তুমি ফোন ধরতেছিলা না কেন ?” খানিকটা অভিমানের সুর পুতুলির মার গলায়। “পুতুলির জন্মদিন, ওকে নিয়ে আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার কথা না ?”
“শুনো আমি পুতুলিকে আনতে পারব না,ওর স্কুলের সামনে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে…. আমার গাড়িতে….. দুইটা ফকির…. মনে হয় মারা গেছে.. আমি আর গাড়ি থামাই নাই….।”
তিন,
আচ্ছা বাবা এখনো আসছে না কেন। নাহ, বাবাটা অনেক দুষ্ট হয়ে গেছে, কান মলে দিতে হবে আবার। আচ্ছা আমি তো এখন স্কুলে পড়ি, অনেক বড় হয়ে গেছি, আজকে আমি একাই বাসায় ফিরে যাব, বাসায় গিয়ে বাবাকে অনেক করে বকে দিব।
এইতো মিষ্টির দোকান, এরপর একটা খেলনার দোকান আছে, আমি তো রোজ গাড়িতে এই দোকানটাকেই দেখি, কত্তো সুন্দর সুন্দর খেলনা! আজকে বাবা আমাকে অনেক খেলনা কিনে দিবে বলেছে।
চার,
“নাহ সোনা, এখন ফোন রেখো না, আরেকটু কথা বলি প্লিজ, প্লিজ।“ প্রিয় মানুষটার সাথে কথা বলার সময় ঘড়িটা বোধহয় এক আধটু দ্রুতই চলতে থাকে,একদিন দুনিয়ার সব ঘড়ি থামিয়ে শুভ্র ওর ভালবাসার মানুষটার সাথে কথা বলবে ঠিক করেছে, দু’জন দু’জনার সাথে গল্প করবে এবং দু’জন দু’জনের গল্প করবে।
ক্র্যাএএএএএ….ক্র্যাচ !!
গাড়ির হুইলে মাথা ঠেকতে ঠেকতে সিট বেল্টের কারণে বেঁচে গেলো শুভ্র। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে ওর, বাহিরে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে,শুভ্র জানে এখন তাকে কি করতে হবে।
বাচ্চা মেয়েটা “বাবা, বাবা” বলে কাঁদছে। এক মুহূর্ত থেমে দম নিলো শুভ্র, দ্বিতীয় মুহূর্তে ওর গাড়িটা আবার চালু হল, চাকার নিচে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার পৌশাচীক শব্দ যতোই হৃদয়বিদারক হোক শুভ্র জানে আপনি বাঁচলে বাপের নাম।
পৃথিবীটা ধীরে ধীরে ঘোলাটে হয়ে আসছে পুতুলির।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:২৮