এই উপমহাদেশের কওমি মাদরাসা বলেন, আর আলীয়া মাদরাসা বলেন, সবখানেই একটা বই পড়ানো হয়। সেটা হচ্ছে হেদায়েতুন নাহু। আগের দিনে ধর্মের প্রচারে নিজের কাজকে উৎসর্গ করার জন্য লেখকরা নিজের নাম কেতাবে লিখে রাখতেন না। নাম ছাড়াই বই প্রকাশ করতেন। এ বইটিও এমন। তবে তাদাদুল উলুম বইয়ের লেখক বলেছেন, হেদায়েতুন নাহু বইটির লেখক হলেন- শায়খ সিরাজ উদ্দীন উসমান চিশতি নিজামী ওরফে আখী সিরাজ আওধী রা.। তিনি একজন আল্লাহর অলী ছিলেন। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য যেসকল আল্লাহর অলীদের অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার পীর ছিলেন- সুলতানুল মাশায়েখ হযরত খাজা নিজামুদ্দীন মুহাম্মদ বাদায়ুনী দেহলবী রা.। তিনিও প্রসিদ্ধ আল্লাহর অলী ছিলেন। তিনিই হযরত সিরাজ উদ্দীন উসমান রা. কে অত্র অঞ্চলে ইসলামের প্রচারের জন্য মনোনীত করেন। জানা যায়, সিরাজ উদ্দীন ওসমান রা. দিল্লীর অদূরে একটি গ্রামে জন্ম নেন। স্থানীয়ভাবে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন । পরবর্তীতে তিনি দিল্লীতে হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রা. এর দরবারে চলে যান। একসময় তিনি দরবারের অন্যতম খাদেমে পরিণত হন।
হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রা. তার প্রধান শিষ্যদের উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে পাঠানোর জন্য ঠিক করলেন। এসময় হযরত সিরাজ উদ্দীন উসমান রা. কে বঙ্গ অঞ্চলে পাঠানোর নিয়ত করেন। পরে তিনি জানতে পারেন, সিরাজ উদ্দীন উসমান রা. এর ইলমে বাতেনির জ্ঞান থাকলেও ইলমে জাহেরি নেই। মানে তিনি কোন শিক্ষকের কাছে ফরমাল শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। এসময় তিনি বলেন, ইসলাম প্রচারের জন্য বা ইসলাম সম্পর্কে মানুষকে আহবানের জন্য সর্বপ্রথম ইলমে জাহেরি বা প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান থাকতে হবে। এই জ্ঞান ছাড়া একজন মানুষ শয়তানের খেলনা। শয়তান তাকে নিয়ে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে খেলতে পারে। এসময় তার সামনে প্রখ্যাত আলেম হযরত ফখরুদ্দীন যারবাদী রা. উপস্থিতি ছিলেন। তিনি সিরাজ উদ্দীন উসমান রা. কে তার হাতে সোপর্দ করার জন্য অনুরোধ করেন, যাতে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেন। হযরত খাজা নিজামুদ্দীন রা. তাকে অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে হযরত যারবাদী রা. তাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে দিল্লীতে পাঠান। এই ফরমাল শিক্ষার পরেই তাকে খেলাফত দিয়ে বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে ইসলাম প্রচারের জন্য প্রেরণ করা হয়।
যে সকল আল্লাহর অলীদের পরিশ্রমে ও প্রচারে আমাদের পূর্বপুরুষ মুসলমান হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন এই হযরত সিরাজ উদ্দীন উসমান আওধী রা.। বই লেখার জন্যও তিনি তার পীরের অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। নিমামুদ্দীন রা. অনুমতি দিয়ে বলেছিলেন, নাহু। মানে অনুরূপ করো। পীরের সম্মানার্ধে বইয়ের নাম রাখা হয় হেদায়েতুন নাহু। বইটি পড়ানোর শুরেুতেই মাদরাসার শিক্ষকরা এ গল্পটি করে থাকেন। তার হেদুয়েতুন নাহু ছাড়াও মিজানুস ছরফ, পাঞ্জেগাঞ্জসহ কয়েকটি বই মাদরাসাসমূহে পড়ানো হয়। এ ঘটনা এজন্য উল্লেখ করলাম, এটাই ইসলাম প্রচারের জন্য যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আল্লাহর রাসুল দ. এর হাতে সাহাবারা বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। এরপর হাতে হাতে বাইয়াত গ্রহণ ও খেলাফত প্রাপ্তির পরই তারা ইসলাম প্রচার করার অনুমতি পেয়েছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে- ইসলাম প্রচারের জন্য তাহলে কী ইলমে জাহেরীই সব? শুধু মাদরাসায় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের কাছে পড়লেই কী ইসলাম প্রচার করেতে পারবেন? না কী ইলমে বাতেনীও তার দরকার হয়। বিষয়টা খোলসা করার জন্য আসুন আরেকটি ঘটনা শুনি। এ গল্পটার জন্য ড. মুফতি কফিল উদ্দীন সরকার সালেহী এর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আমাদের চার ইমামের একজন ইমাম হাম্বল রা.। আমরা জানি বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী রা. হাম্বলী মাজহাব অনুসরণ করতেন। ইমাম হাম্বল রা. সাড়ে এগারো লাখ হাদীসের হাফেজ ছিলেন। ওই যুগে তার মতো এত হাদীস কারো মুখস্থ ছিলনা। হযরত ইমাম বোখারী রা. ছয় লাখ হাদীসের হাফেজ ছিলেন। বলা হয়, ইমাম হাম্বল রা. এর জানাজায় ছয় লাখ মুসলমান জড়ো হয়েছিলেন। তাদের কান্না দেখে সাড়ে ছয় হাজার খ্রীস্টান মুসলমান হয়েছিলেন। তিনি বলতেন, বাতেনী জ্ঞানের জন্য পীরের দরবারে যাওয়ার দরকার নেই। একসময় তিনি কয়েকটি হাদীসের মর্মার্থ পুরাপুরি বুঝতে পারছিলেন না। তিনি যেই আলেমের কাছে হাদীসটি বুঝতে যান, তারা তাকে সমীহ করেন। কারণ তারা জানতেন, ইমাম হাম্বল রা. সাড়ে এগারো লাখ হাদীসের হাফেজ। তার সামনে মুখ খোলা যাবেনা।
কোন আলেমের কাছে সমাধান না পেয়ে তিনি চিন্তা করলেন, বাগদাদের অলী গলিতে হেটে কোন দরবেশের দেখা পাওয়া যায় কী না? ইমাম হাম্বল বলেছেন, এ চিন্তা থেকে বাগদাদের রাস্তায় রাস্তায় হাটতে শুরু করলাম। এসময় একজন আল্লাহর অলী পেয়ে গেলাম। তার নাম আবু হাফস অথবা আবু হামজা রা.। তার পোষাক, অবয়ব, ব্যক্তিত্ব আর চেহারার দ্যূতি দেখে মনে হলো- আমি তার কাছে কিছুই না। তার কাছে একের পর এক মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করলাম, এই বিষয়ের সমাধান কী। ওই বিষয়ের সমাধান কী? আমি জিজ্ঞাসা করতে না করতেই তিনি জবাব দিচ্ছিলেন। এঘটনার পর ইমাম হাম্বল রা. বাতেনি জ্ঞানের বিষয়ে ধারণা পাল্টে ফেলেন। ইন্তেকালের আগে তিনি তার পুত্রকে অসিয়ত করে যান, ইয়া ওলাদি, এত্তাবেয়ি মিনহা উলায়ি আল্লাজিনা ঝাদু আলাইনা বিল ইলমে। আল্লামনাহু মিন লানুদনা ইলমা। মানে হে আমার সন্তান, এরপর থেকে তুমি আল্লাহর অলী, পীর, দরবেশের দরবারে যাবে। কারণ তাদের জ্ঞান আমাদের আলেমদের চেয়ে বেশি। কারণ আলেমরা ক্লাস করে জ্ঞান অর্জন করে। আর আল্লাহর ওলীরা সরাসরি জ্ঞান পেয়ে থাকেন। এ জ্ঞানটাই বাতেনি। ইসলাম প্রচারে এ বাতেনি জ্ঞানের দরকার আছে। যুগ যুগ ধরে এই উভয় জ্ঞানের সমন্বয়েই ইসলাম প্রচার করা হয়েছে। চরমোনাইর মরহুম পীরের একটা অডিও ইউটিউবে আছে। তিনি বলছিলেন, ওয়াজ শুনার আগে দেখবেন বাবারা, তার বাইয়াত আছে কী না। নয়তো ভ্রান্ত হয়ে যাবেন।
এবার আসি সাম্প্রতিক বিষয়ে। হালের নামকরা ওয়ায়েজিন মিজানুর রহমান আজহারী। তার ইলমে জাহেরি আছে। বাতেনি নেই। একারণে যে সমস্যা হতে পারে তার বড় প্রমাণ তিনি। ওয়াজ করতে করতে হযরত মা খাদিজা রা. কে বললেন, তিনি বিধবা। উইডো। ইনটেক না। এজন্য পরে অবশ্য মাফও চেয়েছেন। তিনি মাত্র ২০০৪ সালে দাখিল পরীক্ষা দিয়েছিলেন বলে আরেকটা ভিডিওতে দেখলাম। এখনো চল্লিশ বছর পার করেছেন বলে মনে হয়না। তিনি বাইয়াত গ্রহণ করলে তার পীর তার মানসিক পরিপক্কতা দেখতেন। সবদিক থেকে কামালিয়ত অর্জন করলেই তাকে ইসলাম প্রচারের জন্য অনুমতি দিতেন। তখন এধরণের ভুল হতোনা। আহলে বায়াতের শানে এমন শব্দ ব্যবহার করতেন না। আরো কয়েকজন মিথ্যাবাদি কিউট মৌলভী মনোয়ার আর ইব্রাহিমের কথা বাদ দিলাম। এরা মওদুদীর সাগরেদ। আর মওদুদী বাইয়াতের বিরোধী। এ নিয়ে ছারছিনা থেকে শুরু করে মাওলানা সামছুল হক ফরিদপুরী বই লিখেছেন। আমি আর নতূন করে কী বলবো। এই মওদুদীর সাগরেদরা মওদুদীবাদ প্রচার করছেন। মওদুদীর নয় পুত্র ছিল। তিনি তার সন্তানদেরকেও তার বই পড়তে বলেন নি। তাদেরকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। এদের একজনতো কয়েকদিন আগে এসে এসব তথ্য দিয়ে গেলেন। আর তার মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে এই সাগরেদরা মিথ্যা আর মনগড়া কথাবার্তা প্রচার করে নূতন প্রজন্মের কাছে ইসলাম ধর্মকে একটা হাসি ঠাট্টার বিষয় বানিয়েছেন। এরা ধর্ম প্রচারের নামে ইসলামের যে কতবড় ক্ষতি করছেন- তা যদি একটু বুঝতে পারতেন!
একটা বিষয় জেনে রাখা দরকার। এদেশে ইসলাম প্রচার হয়েছে আল্লাহর অলী, দরবেশ আর পীরের হাত ধরে। পেছনে ছিল বাইয়াত। এখন এদের সাগরেদরা পুরো অনলাইন জুড়ে মাজার বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে। মাজারে যারা সেজদা করে এগুলারে আামার কাছে আহাম্মক ছাড়া কিছু মনে হয়না। অথচ এই আহাম্মকগুলোকে সামনে এনে আল্লাহর অলীদেরকে গালি দেয়া হচ্ছে। যাদের জন্য আমরা মুসলমান তাদের মাজার থাকবেনা! মানুষ জেয়ারতের জন্য যাবেন না! এইতো একশ বছরের বেশি হবেনা। আল্লাহর রাসুলের রওজা নিশ্চিহ্ন করারও চেষ্টা করা হয়েছিল। রওজার গিলাফে আগুন লাগানো হয়েছিল। পরে তুরস্কের খলিফা এদের একজনকে ধরে এনে শিরোচ্ছেদও করে। কিছু লোকজন ইতিহাস না জেনেই আবোল তাবোল মন্তব্য করে যাচ্ছে। আগের নবীদেরও তো মাজার আছে। এটা অবৈধ হলে আল্লাহর নবী তো ওসব ভাঙ্গতে বলতেন। সাহাবাদের মাজার রয়েছে বিভিন্ন দেশে। ইমাম গাজ্জালী রা. তো বলেই দিয়েছেন, কার মাজার থাকতে পারে। কার মাজার করা যাবেনা।
যাই হোক, আমার লেখা অনেকে পড়েন। সাম্প্রতিক বিষয়ে একজনের সঠিক কী পন্থা হওয়া উচিত- তা অনেকেই জানতে চান। তাদের জন্যই এ লেখাটা। আমরাতো আসলে সবাই গুনাহগার। আমল করতে না পারলেও ইমান আকীদাটা ঠিক রাখা দরকার। এজন্য বুঝেশুনে ওয়াজ শোনা উচিত। শীত আসলে দেশে ওয়াজের নামে সারাদেশে এক প্রকার প্রবাহ বয়ে যায়। একেকজন ওয়ায়েজীন আর তার ভক্তদের বহাস একসাথে চলতে থাকে। এ কারণে আসলে কে কী বলতে চায় তা কেউই শুনেনা। ফলে এত ওয়াজ মাহফিল হয়, অথচ দেশে থেকে ব্যক্তিগত অনাচার কমেনা। মানুষের হক মেরে খাওয়া, দুর্নীতি, প্রতারণা, আরেকজনকে ঠকানো, ভেজাল দিন দিন বাড়ছে। ওয়াজ এসব বিষয়ে মানুষের নৈতিকতার মান বাড়াতে ভূমিকা রাখলে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতো। সেটা কী হচ্ছে! আমার মতে হচ্ছেনা। কারণ আর কিছুই না যার ওয়াজ করার কথা না তিনি ওয়াজ করছেন।
যার বাইয়াত নেই, সাথে ইসলামিক ফরমাল এডুকেশন নেই, এমন ব্যক্তির ওয়াজ শুনলে বিভ্রান্ত ছাড়া কিছু হবেন না।
দক্ষিণ কোরিয়া
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০