'স্যার' একটি পুরুষবাচক শব্দ, রংপুরের ডিসি একজন নারী হয়েও তাকে যে স্যার ডাকতে বলেছে, এটাই মর্যাদার দিক থেকে নারীর পিছিয়ে থাকার মূল কারণ। অর্থাৎ বলতে চাচ্ছি নারীরা যখন সবকিছুতে পুরুষের মানদণ্ডে নিজের মান পরিমাপ করতে যায় তখন তাদের নিজস্ব মান বলতে আর কিছু থাকে না। ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেও এই সাধারণ বিষয়টা তিনি বুঝতে পারেনি, শুধু তিনি নয় অন্য কোন নারীকেও সেটা অনুধাবন করতে দেখিনা। সবাই প্রচলিত পদ্ধতিতে নারী হিসেবে নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই নিজেকে পুরুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কেউ নতুন করে নতুন কিছু চিন্তা করতে পারছে না। অথচ প্রচলিত এই পদ্ধতিতে আদৌ নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না, এবং গত একশো বছরেও সেটা সম্ভব হয়নি। কেন সম্ভব না সেটা নিচের উদাহরণ থেকে আরো স্পষ্ট হবে।
শুধু নারী নয়, যখনই কোন জাতি বা প্রজাতি অপর কারো মতো হতে চায় বা অপর কাউকে আদর্শ মানদণ্ড মনে করে তখনই ঐ জাতিটা অপর জাতির নিচে নেমে যায়। বাঙালি জাতির নিজস্ব একটা সাংস্কৃতি আছে, সেটাকে পাশকাটিয়ে পশ্চিমা সাংস্কৃতিকে সাংস্কৃতির আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে সবকিছুতে তাদের মতো হওয়ার প্রচেষ্ঠা বাঙালি জাতিকে পশ্চিমাদের নীচে নামিয়ে দেয়। এজন্য কি পশ্চিমারা দায়ী? না বাঙালি নিজেই, অর্থাৎ বাঙালির মনস্তাত্ত্বই এ জন্য দায়ী। ইদানীং কেউ কেউ আরব সাংস্কৃতি ধারণ করার চেষ্টা করছে, এটা তাদের আরবদের নিচে নামিয়ে দেবে।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে "কাক কখনো কোকিল হয় না"। প্রশ্ন হচ্ছে কাককে কেন কোকিল হতে হবে? কাক যখন কোকিলের মতো হতে চায় তখন পক্ষীসমাজে সে মূলত নিজেকে কোকিলের নিচে নামিয়ে ফেলে। এ জন্য কোকিল দায়ী নয়, কাক নিজেই এ জন্য দায়ী। কাক হওয়াটাকে ছোট করে দেখে ক্রমশ কোকিল হয়ে ওঠার প্রচেষ্টার দ্বারা সে নিজেই নিজের মর্যাদা হ্রাস করে। অথচ পৃথিবীতে প্রতিটা প্রাণীরই অবদান রয়েছে, সুতরাং কাক হওয়াতে পক্ষীসমাজে নিজেকে ছোট মনে করার যেমন সুযোগ নেই, আবার নিজেকে সবার থেকে শ্রেষ্ট বলে অহংকার করারও কোন সুযোগ নেই। কাককে কাক হয়েই পক্ষীসমাজে তার অবস্থান জানান দিতে হবে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় কাকের বাসায় জন্ম নিয়েও পক্ষীসমাজে কোকিলের দৃঢ় অবস্থান রয়েছে। কারণ কাকের বাসায় জন্ম নিলেও সে কখনো নিজেকে কাকের মতো করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে না, সে কোকিল হিসেবেই নিজেকে তৈরি করে।
বহু নারী প্যান্ট-শার্ট, টি-শার্ট, পরে রাস্তায় বের হয়, এবং এটাতে সে নিজের মধ্যে এক প্রকার মর্ডানিটিও ফিল করে (প্রত্যেক নারীই বাপ, ভাই, স্বামী বা তার নিজের টাকায় পোশাক কিনে পরে, আমার বা আমার বাপের টাকায় নয়, তাই কে কেমন পোশাক পরবে সেটা তার ব্যক্তিগত অভিরুচি, আমি শুধুমাত্র ঐসকল নারীর সাথে পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্যটা দেখাতে চাই)। অথচ একজন পুরুষকে যদি বলা হয়, ১০০০ টাকা দেয়া হবে বিনিময়ে শাড়ী বা সেলোয়ার-কামিজ পরে রাস্তায় বের হতে হবে, পুরুষ কি সেটা করবে? আশাকরি পুরো বিষয়টা বুঝতে চিন্তাশীল এবং বুদ্ধিমতী নারীদের জন্য এই প্রশ্নটাই যথেষ্ট।
জাতি হিসেবে পশ্চিমাদের তুলনায় বাঙালির অবস্থান নিচে থাকার দায় যেমন বাঙালির নিজের। পাখি হিসেবে কোকিলের তুলনায় নিচে থাকার দায় যেমন কাকের নিজের। মানুষ হিসেবে পুরুষের নিচে থাকার দায়ও তেমন নারীর নিজের। পুরুষের মতো করে নিজেকে তৈরি করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে নারী নিজই নিজের অবস্থান পুরুষের নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। আমার প্রকৃতি যেমন ঠিক সেভাই নিজেকে তুলে ধরতে হবে, অপরের মত হওয়ার চেষ্টা মানেই নিজের বিকৃতি ঘটানো। সমাজে জন্মে এই সমাজ এব প্রকৃতির প্রতি আমার কিছু দায়িত্ব রয়েছে, আমার প্রাকৃতি আমাকে যা করার সুযোগ দিয়েছে তা সমাজে কোন ইতিবাচক অবদান রাখছে কিনা সেটাই মুখ্য, তার আর্থিক মূল্য কম না বেশি, আছে না নাই সেটা বিবেচ্য কোন বিষয়ই নয়। এবং এটা বিবেচনা করে নিজেকে ছোট বা বড় ভাবাও নিজেকে অসম্মান করার শামিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০২৩ ভোর ৫:৫৫