১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের রাস্তায় প্রায় পনেরো হাজার নারী ভোটাধিকার প্রাপ্তির দাবীতে রাস্তায় মিছিল বের করে। অর্থাৎ বেশীদিন আগের কথা নয় গত শতাব্দীর শুরুতেও পশ্চিমা সভ্য সমাজে নারীর ভোট দেয়ার অধিকার ছিল না। এমনকি তারা নারী আদৌ মানুষ কিনা এ বিষয়ে একটা সময় বিতর্কও পর্যন্ত করতো। নারীর প্রতি ন্যাক্কার জনক এই অবমাননাকে হাতিয়ার করে, শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী সময়ে কম মূল্যে শ্রমিক পেতে নয়া ফাঁদ পাতা হলো, এর নাম দেয়া হলো নারীবাদ! ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে, সহজ বাক্যে বললে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তাকে বাহিরে এসে পুরুষের মতো পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করতে হবে। অর্থ উপার্জন করলেই তাকে কেউ আর ছোট করতে পারবে না, এটাই ছিল নারীবাদের মূল বক্তব্য। ব্যাস, নারীও মর্যাদা পাওয়ার আশায় টোপ গিলে ঝাঁকে ঝাঁকে বাহিরে বেরিয়ে আসতে লাগলো। খেয়াল করলে দেখবেন শিল্পবিপ্লবের পরপরই ইউরোপ হতে নারীবাদের উৎপত্তি। আসলে নারীবাদের গোপন দুরভিসন্ধি ছিল নারীকে বাহিরে এনে শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি করে শ্রমের মূল্য কমানো। যা শ্রমশোষণকেই তরান্বিত করেছে মাত্র। নিজেই খেয়াল করে দেখুন, এসব করে সমাজে আদৌও কি নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠীত হয়েছে? না হয়নি। বরং ধীরে ধীরে পরিবার প্রথা উঠে যাচ্ছে এবং সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর"। প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই পঙক্তিটি সকলেরই জানা, তবে নারীর সবচেয়ে বড় অবদানটিকে আদৌও কি সমাজে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে? না, বরং নারী-পুরুষের সমতার নামে মূলত নারীকে পুরুষ বানানোর বিষয়টিই বিভিন্নভাবে প্রচার হতে দেখা যায়। পুরুষ এটা করছে নারী কেন করতে পারবে না, পুরুষ ওটা করছে নারী কেন করতে পারবে না। প্রশ্ন হচ্ছে পুরুষ যেটা করছে, নারীকেও কেন সেটাই করতেই হবে? পুরুষের মতো করেই কেন নারীকে তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে? পুরুষ কি কখনো বলেছে নারী এটা করছে, পুরুষ কেন করতে পারবে না? কাককে কেন কোকিলের মতো হয়ে পক্ষি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে? কোকিল একটা পাখি কাকও একটা পাখি, উভয়কে আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, জীববৈচিত্র্য রক্ষার উভয়েরই ভিন্ন ভিন্ন অবদান রয়েছে। সুতরাং উভয় পাখিরই মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু কাক যখনই কোকিলের মতো সাজতে চায় তখনই সে পক্ষি সমাজে নিজের জাতিগত মর্যাদা হারিয়ে ফেলে, একই সাথে কাকের কাজের ঘাটতির কারণে জীববৈচিত্র্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এটা ঠিক যে, সামগ্রিকভাবে মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এরজন্য বরাবরই পুরুষতন্ত্রকে দায়ী করা হয়। হ্যাঁ সে দায় হয়তো আছে, কিন্তু পুরুষতন্ত্রই এর পেছনে একমাত্র বা প্রধান কারণ নয়। এর প্রধান কারণ হলো অর্থতন্ত্র। নারী বা পুরুষ কারো ক্ষেত্রেই আজ পর্যন্তও কর্মের কোন মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যেটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা হলো অর্থের মর্যাদা। যে কর্মে যতবেশি অর্থ সে কাজকেই ততো মর্যাদা দেওয়া হয়। এমনকি এক্ষেত্রে উপযোগিতাও বিবেচনা করা হয় না। যদি অর্থের বিষয়টা বিবেচনা না করে উপযোগিতা বিবেচনায়ও কর্মের মর্যাদা নির্ধারিত হতো, তবে বহু আগেই নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হতো।
শুধু বাংলাদেশেই না পৃথিবীর অধিকাংশ নারীই গৃহিণী। সেদিন টাইম ম্যাগাজিনে একটা রিপোর্ট পড়লাম, যার শিরোনাম, "I'm One of the 56% of American Mothers Who 'Prefer' to Stay Home" । নারীর অধীকার নিয়ে অনেক আলাপ আছে, কিন্তু আমি আজ পর্যন্ত নারীর গৃহস্থালি কাজ এবং পুরুষের বাহিরের কাজকে সমান করে মূল্যায়নের কোন আলাপ দেখিনি। অথচ গৃহিণীদের কারণেই মানবসভ্যতা রক্ষায় পরিবার নামক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি এখনো টিকে আছে। হাজার হাজার বছর আগের পিথাগোরাসিও সময় যে নীতিবিদ্যার উপর সমাজ পরিচালিত হতো, মেখানে নারীর গৃহস্থালি কাজ এবং পুরুষের বাহিরে কাজকে সমানভাবে মর্যাদা দেয়া হতো। অর্থাৎ তখনকার মানুষও গৃহস্থালি কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারতো, কিন্তু আধুনিক মানুষ তা পারছে না! কথা হলো অধিকাংশ নারীই যে পেশায় জড়িত আছে বা থাকতে চায়, সেই পেশাকে ছোট করে দেখে আদৌ কি নারী জাতির মর্যাদা অর্জন সম্ভব? বৃটেনে অবশ্য আইরিন লাভলক নামের এক নারী 'British Housewives League' নামে গৃহিণীদের পক্ষে কথা বলার জন্য একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। গৃহিণীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় চীন, জাপান, জার্মানি সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মাইনাসে নেমে গেছে। এভাবে চললে কয়েকশো বছরে তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে ভেবে সেখানকার সরকার উদ্বিগ্ন, তারা চেষ্টা করছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার পজিটিভে ফিরিয়ে আনার কিন্তু পারছে না। কারণ মোটিভেশনালি সেখানকার নারীরা এখন ক্যরিয়ারে আগ্রহী, সন্তানজন্ম এবং লালনপালনে নয়।
না, আমি বলছি না যে নারী বাহিরে কাজ করবে না। নারীর আর্থিক দায়িত্ব নেয়ার মতো কেউ না থাকলে তাকে অর্থ উপার্জন করতেই হবে। আবার কিছু কাজ রয়েছে যা নারী ব্যতিত অন্যকারো দ্বারা সম্ভব না, কিংবা নারীই ঐ কাজ ভালো করতে পারবে, সেখানে অবশ্যই নারী কাজ করবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পুরুষের মতো অর্থ উপার্জনের মাধ্যমেই নারীর মর্যাদা অর্জনের যে সাংস্কৃতি চালু হয়েছে এটা নারীর এবং সমাজের জন্য সামগ্রিকভাবে কল্যাণকর কিনা?
বর্তমানে বাহিরে কাজ করেও অনেক নারী সংসার সামলে নিচ্ছে, কিন্তু সেটা কি তার জন্য অতিরিক্ত চাপ হয়ে যাচ্ছে না? তাছাড়া সন্তান জন্মের পর পাশে থেকে আদর স্নেহ দিয়ে গড়ে তোলার জন্য, শিক্ষা দেয়ার জন্য, একজন গৃহিণীর যে সুযোগ রয়েছে, তেমন সুযোগ কি একজন কর্মজীবী নারীর রয়েছে?
নিশ্চই না। তাহলে নিজের মর্যাদা অর্জন করতে গিয়ে চাকরিজীবী মা কি তার সন্তানকে বঞ্চিত করছে না? (পৃথিবীতে মায়ের ভালোবাসার উপর কোন ভালোবাসা হয় না, সেই মা'ই সন্তানকে ঠকাচ্ছে?)। তাছাড়া নারীপুরুষ উভয়ের শারীরিক সক্ষমতা কি একইরকম? নিশ্চই না। এই বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে সুদূর আদিম সমাজেও খাদ্য সংগ্রহে পুরুষ শিকারের কাজ করতো এবং নারী ফলমূল সংগ্রহ এবং সন্তান লালনপালন করতো।
কিন্তু বর্তমান মানবসমাজ শিকারী ভিত্তিক নয়। বর্তমান সমাজে নানান রকমের কর্ম থাকলেও কর্মীর তুলনায় কর্মের পদসংখ্যা সীমিত। আবার রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী নারীর আর্থিক দায়িত্ব পুরুষের উপর। তাই কর্ম না থাকার কারণে অনেক পুরুষই বিয়ে করে না। পুরুষ বিয়ে না করা মানে নারীরও বিয়ে না হওয়া, যেটা সমাজে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক এবং গর্ভপাত বৃদ্ধি করছে। ধরুন স্বামীর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ১০০ জন নারী সমাজে নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যাংকে চাকরি নিলো। এখন প্রশ্ন হলো, তারা যদি এই চাকরি না নেয় তবে কি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবে? না যাবেনা। কিন্তু সংসারে নারী যে কাজ সে কাজ যদি নারী সঠিক ভাবে না করে বা করতে পারে তবে পরিবার ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাবে। পুরুষ চাইলেই সন্তান পেটে ধরতে পারবে না, বুকের দুধ পান করাতে পারবে না। একজন নারী যত সুন্দরভাবে সংসার সামলাতে পারে পুরুষ কখনোই সেভাবে পারে না। তাছাড়া একজনকে কেন সব কাজই করতে হবে, পারদর্শিতা অনুযায়ী কাজ ভাগ করে নেওটাই তো উত্তম। ইঞ্জিনিয়ারিং কনসেপ্টও এটাই বলে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের কাজকে সমানভাবে মর্যাদা দিলেই তো আর কোন সমস্যা থাকে না বা থাকার কথা না।
তাছাড়া ব্যাংকের ঐ ১০০টি পদে যদি নারী কাজ না করে, তবে ১০০ জন পুরুষ কাজ করবে, এবং বিয়ের মাধ্যমে ১০০ জন নারীও আর্থিক নিরাপত্তা পাবে। তারমানে চাকরি পাওয়া ১০০ জন নারীর বিপরীতে অপর ১০০ জন নারীর বিবাহ বন্ধ হবে। আরো সহজ করে বললে, চাকরি পাওয়া ১০০ জন নারীর বিপরীতে অপর ১০০ জন নারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এখানেই শেষ নয়, চাকরি না পেলে যেহেতু মর্যাদা নেই, তাই চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে বর্তমানে বহু নারীই বিয়ের বয়স অতিক্রম করে ফেলছে। ফলে একদিকে একাকিত্ব এবং অন্যদিকে চাকরির চাপ, দুটো মিলে অনেক নারীই আজ হতাশায় নিমজ্জিত। এর কারণেও বৃদ্ধি পাচ্ছে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক এবং গর্ভপাত। আবার গর্ভপাতের কারণে নাকি পরবর্তীতে অনেক নারীর গর্ভধারণে জটিলতারও সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া বয়স বাড়ার সাথে সাথে নারীর ফার্টিলিটিও কমতে থাকে। কিন্তু পুরুষ বৃদ্ধ বয়সেও সন্তান জন্মদানে সক্ষম থাকে। অর্থাৎ সবদিকে আল্টিমেটলি নারীই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন তো অনেক পুরুষও বেকার নারী বিয়ে করতে চায় না। এই সংখ্যাটা ধীরেধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে অবস্থা এমন হবে যে পুরুষ আর নারীর অর্থনৈতিক দায়িত্ব নেবে না, যার যার আর্থিক দায়িত্ব তার তার। ফলে দেখা যাবে একটা সময় এদেশের চাকরি না পাওয়া নারীদেরকেও পশ্চিমের নারীদের মত পেটের চাহিদা মেটাতে শরীর বিক্রিতে নেমে পড়তে হবে! বিষয়টা কি নারীর জন্য মঙ্গলের হবে?
এটা সত্যি যে নিজের উপার্জন না থাকায় বহু গৃহিণীকেই স্বামীর অনেক নেতিবাচক কথাবার্তা হজম করতে হয়, সেটা নারীর জন্য পীড়াদায়ক। কিন্তু চাকরি বা অর্থ উপার্জনই কি এর সঠিক সমাধান? চাইলেও কি শতভাগ নারীর পক্ষে বাহিরে কাজ করে অর্থ উপার্জন সম্ভব? সম্ভব না। সে পরিমান কর্মও খালি নাই। তাছাড়া অনেক নারীই বাহিরে কাজ না করে নিরেট গৃহিণী হতে চায়, আবার যারা বাহিরে কাজ করছে বা করতে চাচ্ছে তাদের অধিকাংশও গৃহিণী হতে চায়, কিন্তু গৃহিণী পেশায় সম্মান না থাকায় তারা বাহিরে কাজ করতে যায় বা যেতে চায়।
পুরুষের প্রথম শিক্ষক একজন নারী, এবং প্রতিটা পুরুষই কোন না কোন নারীর হাতে গড়ে ওঠে। প্রশ্ন হলো যেই নারীর হাতে পুরুষ গড়ে উঠছে সেই নারীকে কেন পুরুষের হাতে নিপিড়ীত হতে হচ্ছে? এর কারণ হলো নারী সঠিক ভাবে, এবং সঠিক শিক্ষা দিয়ে পুরুষকে গড়ে তুলতে পারছে না। নেপলিয়ন বলেছিলেন, "তোমারা আমাকে শিক্ষিত মা দেও আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেবো"। অথচ যে নারী জাতিকে গড়ে তুলবে সে নারীর এ বিষয়ে কোন একাডেমিক শিক্ষার ব্যবস্থাও নেই যে কিভাবে সন্তানকে গড়ে তুলতে হবে!
পুরুষের কাজ নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র আইন করে এ দায়িত্ব পুরুষের কাঁধে তুলে দিয়েছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ হিসেবে এ দায়িত্ব যেমন পালন করতে হবে, আবার দায়িত্ব পালন করার পর নিজেকে খুব বড় কিছু ভেবে বসার মানসিকতাও পরিহার করতে হবে। তবে সামগ্রিকভাবে নারী পুরুষের সমান মর্যাদা আদায়ে পুরুষের বাহিরের কাজ এবং নারীর গৃহস্থলী কাজেকে সমানভাবেই গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টাতে নারীকেই সোচ্চার হতে হবে। এ বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত করতে সকল সংকোচ দূর করে নারীরই কথা বলতে হবে, কারণ আল্টিমেটলি ভিক্টিম তো নারীই। নারীকে বুক ফুলিয়ে বলতে হবে, আমি নারী, যে ঘড় হতে সমাজ এবং সভ্যতা গড়ে ওঠে, আমি সে ঘড় গড়ে তুলি। নারী যখন এই কথাটা নিঃসংকোচে বলতে পারবে, তখনই নারীর মর্যাদা আদায় হবে, অন্যথায় হবে না। শতবছর চেষ্টা করে নিজেকে পুরুষ বানানো ব্যতিত সামগ্রিকভাবে নারী আজও তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি, হাজার বছরেও পারবে না। তাই নারী পুরুষ উভয়ের কাজই হোক সমমর্যাদার, এটাই কামনা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩২