কিছুদিন আগে আড্ডা দিতেদিতে একজন বেবি-কেয়ারে তার একদিনের ইন্টার্নির অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিল। তার ঐ একদিনের অভিজ্ঞতা শুনেই আমি অবাক! আট মাসের বাচ্চাকে বেবি-কেয়ারে রেখে বাবা-মা যে'যার কাজে চলে যাচ্ছে, কত ভয়ংকর কথা!
যাবেই'বা-না কেন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে নিজের অজান্তেই তো মানুষ সার্বজনীন ভাবে পশ্চিমা পুঁজিবাদী ধর্মকে গ্রহন করে নিচ্ছে, যার কলেমা হচ্ছে "মানি ইজ সেকেন্ডে গড" ['সেকেন্ড' শব্দটা না থাকলে একেশ্বরবাদীরা গ্রহণ করতো না তাই টেকনিক করে 'সেকেন্ড' শব্দটা প্রবেশ করানো হয়েছে মাত্র]। তাই মানুষ আজ অর্থের আরাধনায় মত্ত। মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করা হয় অর্থে। মানুষকে কেনা যায় অর্থে। কিসের ঘর, কিসের সংসার, কিসের পরিবার।
অথচ সুন্দর সমাজের জন্য প্রয়োজন সুন্দর পরিবার। সুন্দর পরিবারের জন্য চাই সুন্দর মানুষ। মানুষের সৌন্দর্য থাকে তার মনে, তার চিন্তায়। ঘুরেফিরে আমাদের চিন্তাগুলো রসুনের মতো অর্থের মধ্যে এসেই মিলিত হয়৷ তাই সরাসরি কর্মের মানদণ্ডে মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করা হয় না। অর্থের মানদণ্ডে কর্মের মর্যাদা নির্ধারণ করার পর কর্মের মানদণ্ডে মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করা হয়। গৃহস্থালি কাজে যেহেতু অর্থ নেই, তাই তাতে মর্যাদাও দেয়ার হয় না।
অথচ অবস্থা ও উপযোগিতা অনুসারে দুনিয়ার দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে নারী-পুরুষে উভয়েই সমান অংশীদার। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের পিথাগোরীয় সমাজও তা বুঝতো, কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর উন্নত মানুষেরা তা বোঝে না। পিথাগোরীয় সমাজে নারীর গৃহস্থালি কাজকে পুরুষের বাহিরের কাজের মতো সমানভাবে মর্যাদা দেয়া হত। পিথাগোরীয় সময়ে নীতিবিদ্যার মাধ্যমে সমাজের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করা হত। পুরুষের বহির্মুখী কাজ এবং নারীর গার্হস্থ্য কর্মের সমমর্যাদা পিথাগোরীয় নীতিবিদ্যারই অংশ ছিল।
নারী কি চায়? নারী চায় একটি ঘর, যেটাকে সে সুন্দর এবং মনের মতো করে সাজাবে। সৃষ্টিকর্তা সেভাবেই নারী হৃদয়কে সৃষ্টি করছেন। কিন্তু মনে রাখা দরকার নারীর প্রথম পরিচয় সে মানুষ, তারপর নারী। মানুষ চায় সম্মান, চায় মর্যাদা। গৃহস্থালি কর্মে যেহেতু অর্থ নেই এবং অর্থই যখন মর্যাদা পরিমাপের স্কেল, তখন মানুষ হিসেবে কাঙ্খিত মর্যাদা অর্জনে নারীকে অর্থের পেছনেই ছুটতে হয়। ফলে ধ্বংস হয় পরিবার। সন্তান বঞ্চিত হয় মায়ের বুকের দুধ থেকে, ভালোবাসা থেকে।
মানুষের জীবনে অর্থ এবং ভালোবাসা দুটোই প্রয়োজন রয়েছে। অর্থ মানুষের বাহ্যিক চাহিদা পূর্ণ করে, পরিবার মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়। ভালোবাসা মানুষের আত্মাকে তৃপ্ত করে। ভালোবাসাহীন মানুষ কতটা অসহায় তা কদিন আগেই মোহসিন খানের ( রিয়াজের শ্বশুর) আত্মহত্যা থেকেই উপলব্ধি করা যায়। এত অর্থ সম্পদ তার ভালোবাসার অভাব দূর করতে পারেনি।
আল্লাহ বলেন-
তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সংগিনীদেরকে যেন তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন (সূরা রূম: ২১)
তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তা থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন। যাতে সে তার নিকট শান্তি পায়। (সূরা আরাফ: ১৮৯)
কিন্তু অর্থের মোহে আমরা যখন পরিবারকে ধ্বংস করে দিচ্ছি, তখন তৈরি হচ্ছে ভালোবাসার শূন্যতা। সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষকে সৃষ্টি করে এমন একটা বিধান দিয়েছেন যেখানে সবকিছুর ভারসাম্য বজায় থাকে। মানুষ তা উপলব্ধি করে না, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যেমন; সামর্থ্য অনুযায়ী স্ত্রী এবং সন্তানের ভরনপোষণের দায়িত্ব ইসলাম পুরুষকে দিয়েছে । (সূরা আল-বাকারা:২৩৩, সূরা আত-তালাক: ৬, সুনানে আবূ দাউদ:২১৪২)। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (সঃ) স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের নিকট আল্লাহর আমানত।
আবার নারীদের উদ্দেশ্য বলা হয়েছে -
তোমরা ঘরে অবস্থান করো এবং জাহেলি যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করো না। (সুরা আহজাব: ৩৩)
আবার নারী-পুরুষ দু'জনকে দু’ধরনের দায়িত্ব দিয়ে বলে দেয়া হয়েছে, একজন অপরজনের আবরণ সরূপ ( সূরা আল-বাকারা:১৮৭)। অর্থাৎ একে অন্যের নিরাপত্তা দেবে, সুখে অসুখে পরস্পরের পাশে থাকবে, সেবা করবে।
নারীর দায়িত্ব নেয়ার মতো কেউ না থাকলে সে আর্থিক প্রয়োজনে কর্ম করতেই পারে। কিন্তু সমাজ যখন নারীর গৃহস্থালি কাজকে মর্যাদা দেয় না তখন পশ্চিমা পুঁজিবাদীরা মার্কেটিং করে, উপার্জনই নারীর মর্যাদা, এবং নারীও সেই মর্যাদার পেছনে ছোটে।
সুতরাং সমাজের চিন্তায় পরিবর্তন দরকার। উপযোগ অনুযায়ী গৃহস্থালি কাজ এবং অর্থ উপার্জন কোনাটাই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সৃষ্টির উপর স্রষ্টার বিধান প্রকৃত ভাবে মেনে চলা দরকার, তবেই পৃথিবী সুন্দর হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০২৩ ভোর ৫:১৭