-বাবা , এই বাবা , কি করো ?
- কিচ্ছু না রে মা , এমনি বসে আছি ।
-সন্ধ্যা হলেই তুমি বারান্দায় এসে বসে থাকো কেন ? লাইট জ্বালাই ?
-থাক না মা । অন্ধকার তো ভালো লাগছে ।
-বাবা জানো , আমি এখন বারান্দার লাইটের সুইচ একলাই দাঁড়িয়ে অন করতে পারি , চেয়ারে দাঁড়াতে হয় না ।
-তাই নাকি ! আমার মামনি তো তাহলে অনেক লম্বা হয়ে গেছে !
-হুম বাবা , আমি বড় হয়ে মা'র সমান লম্বা হবো ।
-মা'র সমান কেন ? তর মা তো বেশি লম্বা ছিলো না । আরও লম্বা হবি তুই ।
-না ,না বাবা , আমি ঠিক মায়ের সমান লম্বা হবো । তারপর মায়ের শাড়ি পরবো ।
-আচ্ছা মা , পরিস ।
-আচ্ছা বাবা , তুমি আমাকে বলবে কেন তুমি অন্ধকারে বসে আকাশ দেখো ?
- এমনিতেই রে বুড়ি , ভালো লাগে তাই ।
-আমি জানি তোমার কেন ভালো লাগে ।
-কেন?
-স্কুলে আমার এক বন্ধু বলেছে , মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায় । এটা কি ঠিক বাবা ?
-হতে পারে মা । আমরা কি আর সব জানি ?
- ওর দাদু ওকে বলেছেন , মানুষ মরে গেলে আকাশে তারা হয়ে যায় ।
- বন্ধুর দাদু যখন বলেছেন তাহলে হয়তো তাই হবে ।
-বাবা , তাই কি তুমি সন্ধ্যায় আকাশের তারা দেখো ? মাকে খোঁজ ?
- হুম।
- মা কোন তারাটা ?
-ওই যে সবথেকে উজ্জ্বল তারাটাই তোর মা ।
- মা , ওখানে বসে সব দেখেন ?
-হ্যাঁ রে বুড়ি , সব দেখেন । আমি কি করি , তুই কি করিস সব দেখেন।
-বাহ ! মায়ের তো তাহলে ভীষণ মজা !
-হ্যাঁ , তোর মায়ের অনেক মজা ।
-বাবা , তোমার মায়ের জন্য মন অনেক খারাপ লাগে তাই না ?
- তা তো লাগবেই রে মা । এই যে তোর মা কথা নাই , বার্তা নাই হুট করে আমাদের রেখে তারা হয়ে গেলো । এখন তোর দেখাশোনা তো আমি ঠিকমতো করতে পারি না ।
- কি যে বল বাবা , আমি তো অনেক বড় হয়ে গেছি । আমাকে তোমার দেখাশোনা করতে হবে না । আমিই তোমার দেখাশোনা করবো । বুঝলে বাবা ?
- হাহাহাহা ! তাই নাকি ? কি কি দেখাশোনা করবি আমার ?
-এই মনে করো সকাল বেলা তোমার চা বানিয়ে দেবো । নাস্তা খাবার সময় তোমার কাছে বসে থাকবো ।
-আর ? আর কি করবি আমার মা ?
-আর তোমার অফিসে যাবার সময় হলে মায়ের মতো তোমাকে সব গুছিয়ে দেবো । মা তোমার কপালে চুমু দিতো , আমিও দেবো । তুুমি দেখে নিও একদম মায়ের মতো সব দেখাশোনা করবো আমি।
-তারপর?
-তারপর আমি নিজের পড়া শেষ করে স্কুল বাস এলে স্কুলে চলে যাবো । দুপুরে ফিরে এসে গোসল করে তারপর ফোন করে তোমার খবর নেবো ।
- ওরে বাপরে ! তুই এত্ত কিছু জানিস মা?
-বাহ ! জানবো না ? আমি তো মাকে দেখতাম এগুলো করতে ।
- আমার সেদিনের এতটুকুন মেয়ে ! কবে কবে এত্ত বড় হয়ে গেলিরে মা !
-মা নেই , এখন তো আমাকেই সব দায়িত্ব নিতে হবে । স্কুলের মিস বলেছেন , নানু বলেছেন , এখন থেকে আমিই তোমার গার্ডিয়ান ।
- ওরে ! বাপরে ! দেখি দেখি আমার গার্ডিয়ান কতো বড় হয়েছে । কেমন দেখতে হয়েছে ! হাহাহাহা !
-অকারণে হাসবে না তো বাবা । শোন বাবা , তুমি সন্ধ্যায় অফিস থেকে এলে তোমাকে চা আমি বানিয়ে দেবো । বুয়া আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে রঙ চা বানাতে হয় । তুমি তো রঙ চা খাও লেবু দিয়ে , চিনি এক চামচ । ঠিক বলেছি ?
-তুই চা বানিয়ে খাওয়াবি আমাকে? তাহলে তো তুই সত্যি অনেক বড় গার্ডিয়ান আমার ।
-হুম , বাবা একটা হাসির কথা শুনলে ? বুয়া লেবুকে কি বলে জানো ? বলে লেম্বু । হি হি হি ।
- হা হা হা । আসলেই তো মজার শব্দ । লেম্বু !
-আর রাতে খাবার খেয়ে তুমি যদি ওষুধ খেতে ভুলে যাও তাহলে কিন্তু বকা দেবো ।
- বকাও দিবি ? আমি তো এখুনি ভয় পাচ্ছি রে ।
-অফিস থেকে ফিরে কাপড় চোপড় অগোছালো করে রাখলেও কিন্তু বকা খাবে । আর একদম সিগারেট খাওয়া যাবে না ।
-আর কি কি করা যাবে না আমার আম্মাজান ?
-বেশি রাত জাগা যাবে না ,বুঝলে বাবা ?
-বুঝেছি ,বুঝেছি, আমার কপালে শান্তি নেই । তোর মা যেমন জ্বালিয়েছে মনে হচ্ছে তুইও জ্বালাবি তেমনি ।
- এসব বলে কোন লাভ নেই বাবা । এখন ঘরে চল । আমাকে পড়া দেখিয়ে দেবে ।
- একটু পর আসি ? তোর মায়ের সাথে আর একটু কথা বলি ?
-না তা হবে না। আমি গেলেই তুমি কাঁদবে জানি । আমি কি কাঁদি বলো ? আমারও তো কান্না পায় , আমি তোমার কথা ভাবি আমার সব কান্না ফুরিয়ে যায় ।
- আমিও আর কাঁদবো না রে মা । তোর মায়ের জন্য অনেক দোয়া করবো শুধু । যেন ওই আঁধারের তারা হয়ে সে খুব ভালো থাকে ।
-আমিও দোয়া করবো বাবা ।
-হ্যাঁ , তাহলে তোর মা অনেক ভালো থাকবে । প্রতিদিন তারা হয়ে আমাদের দেখতে আসবে ।
- তারা মাকে আমরা অনেক গল্প বলব , তাই না বাবা ?
- হ্যাঁ মা ।সারাদিনের সব গল্প বলব ।
- তুমি একটুও মন খারাপ করবে না । ঠিক তো বাবা ?
- আজ সত্যি সত্যি আর মন খারাপ লাগছে না রে বুড়ি । তোর মা আঁধারের তারা হয়ে যাবার আগে যে তোকে আমার কাছে দিয়ে গেছেন । আমার গার্ডিয়ান আলো'র তারা ।