একজন লেখক হিসেবে আমার কোন দল বা গোষ্ঠির পক্ষে কথা বলা অনুচিৎ। মানুষের অস্তিত্ব যেখানে সেখানেই থাকতে হবে লেখকের বিবেক। আল্লামা আহমদ শফি, শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আজাদ, অভিজিৎ রায়, ভারতের দেবযনি কিংবা যেকোন পতিতালয়ের নারী, পুলিশ কিংবা সেনা বাহিনী, আলেম-ওলামা, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি যে কেউ, যে পেশা, যে বর্ণ এবং যে ধর্মেরই থাকুক, সে আক্রান্ত হলে আমার বিবেক জেগে যদি না ওঠে তা হলে আমি বিবেকবান নয়। আমার মনে একটা দলের প্রতি, একটা ধর্মের প্রতি, একটা আদর্শের প্রতি, একটা জাতি-গোষ্ঠির প্রতি প্রেম থাকতে-ই পারে। কিন্তু সত্য আর ন্যায় থেকে আমাকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না।
বুঝের অভাবে কিছু ঘটলে ভিন্নকথা। আজকে আমি পুলিশ বিষয়ক কিছু কথা বলতে চাই। আমরা সর্বদাই পুলিশের দোষ দেখি, দেখি পুলিশ ঘুষ খায়, পুলিশে মারে, পুলিশ হিংস্র হয় ইত্যাদি। কিন্তু আমরা কেউ একবারও ভাবি না পুলিশ কেন এবং কখন এগুলো করে। আমরা তাও ভাবি না যে পুলিশও যে মানুষ। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে পুলিশ হলো রাষ্ট্রের তাবেদার। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যারা থাকে পুলিশ বাধ্য তাদের তাবেদারী করতে। পুলিশ যদি সরকারের হুকুম অমান্য করে তবে সরকার পঙ্গু হয়ে যাবে। অব্যশ নীতিকথা হলো সরকার যদি অন্যায় করে তবে পুলিশ বিদ্রোহ করবে। কিন্তু ন্যায়-অন্যায় বিচার করবে কে? আপনি যাকে ন্যায় বলছেন, অন্যজন এটাকে অন্যায় বলছে, আপনি যাকে বৈধ মনে করছেন, অন্যজন এটাকে অবৈধ মনে করছে। আপনি মনে করছেন হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্বরে সমবেত হয়ে রাষ্ট্রদ্রোহী কর্ম করেছে, আবার অনেকে মনে করছেন হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্বরে সমবেত হয়ে দেশÑজাতি-স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছেন। আপনি পুলিশকে-সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন হেফাজতে ইসলামকে পিঠিয়ে সরানো হোক। অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চকে আপনি মনে করছেন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলন, দেশের অনেক মানুষ মনে করছে এই গ্র“পটা একটি বেহায়া এবং সন্ত্রাসী গ্র“প, ওরা ভারতের মদদপ্রাপ্ত একটি গ্র“পটা। ওরা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, ধর্মে আঘাত করেছে, সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি আর প্রকাশ্য নারী-পুরুষের নির্লজ্জ মিলামিশা করছে, ওদেরকে পুলিশ দিয়ে শাহবাগ থেকে উঠিয়ে দেওয়া হোক। পুলিশ কোনদিকে যাবে? জনগণ যেদিকে থাকে উচিৎ হলো পুলিশকে সেদিকে যাওয়া। কিন্তু প্রতিটি ঘটনায়-তো আর গণরায় নিতে গণভোটের আয়োজন করা যাবে না। তাই পুলিশকে সরকারের নির্দেশ মেনে নিতে হয়। সরকার যে পক্ষে থাকে পুলিশও সেই পক্ষের হয়ে কাজ করে। কেউ হয়তো বলবেন বৃটিশ পুলিশের কথা, আমি বলবো প্রথমত সেখানে আদালত ক্ষেত্র বিশেষ নিরেপেক্ষ থাকে। কোন উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক কারণ না হলে তারা সরকারের পক্ষে কাজ করে না। কিন্তু বাংলাদেশে উপজেলা আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এখানে দলের নির্দেশের বাইরে গিয়ে পুলিশের একটি চুলকেও সরানোর সাহস নেই। যদি কেউ সাহস দেখায় তবে চাকুরী যাবে, শাস্তি পাবে। তারপরও তারা অনেক সময় কেউ কেউ সরকারের অনেক নির্দেশকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আবার কেউ কেউ সরকারের ইশারা ছাড়াই হয়ে উঠে হিংস্র। পুলিশ যখন ঘুষ খায় আমরা পুলিশকে গালি দেই। কিন্তু আমরা হিসাব করে দেখি না এই ঘুষের অংশ কতটুকু পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয় এবং ঘুষ না খেলে পুলিশের শাস্তি কি হয়? আমরা শুধু পুলিশের দোষ দেখি, সমালোচনা করি। আমরা ছায়াছাবি দেখতে যাই বিরতির পরে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখি না। তাই বুঝিনা নায়ক কেন কখনও কখনও ভিলেন হয়। কিন্তু তাদের উপরও যে আক্রমণ হয় সেটা নিয়েও আমাদের কথা বলতে হবে। পুলিশের অধিকার নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। কোন নারী যদি পুলিশের উপর হিংস্র হয়ে যায় তখন পুলিশ কি করতে পারে? আমিও স্বীকার করবো পুলিশের উচিৎ ধৈর্য্য ধারণ করে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা। কিন্তু পরিস্থিতি অনেক সময় পুলিশেরও নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তাই তারা বাধ্য হয় একশনে যেতে।
পুলিশ থাকে সর্বদাই মহাবিপদে। তাদের একদিকে সরকারী ছাপ, চাকুরীর মায়া, চোখের সামনে ভাসতে থাকে সন্তানদের ভবিষ্যত। অন্যদিকে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, আইন-আদালত ইত্যাদি। তাদের সর্বদাই জীবনের ঝুকি নিয়ে কাজ করতে হয়। পুলিশের হাজারো দোষ আছে, আমি স্বীকার করি, কিন্তু তাদের দোষকে বিরতির পর ছবি দেখার মতো দেখলে বুঝা যাবে না নায়ক কেন ভিলেন হলো। পুলিশকে ভিলেনের স্থান থেকে নায়কের স্থানে আনতে হলে প্রথমে আদালতকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে নিরেপেক্ষ করতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র সৎ করতে হবে। জনগণ তাদের নেতা নির্বাচনকালে সৎ এবং যোগ্য দেখে নির্বাচিত করতে হবে। যদি আমরা এই কাজগুলো করতে পারি তবেই পুলিশ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ পাওয়া যাবে, নতুবা শুধু যে সরকার আসবে তার হুকুমে পুলিশ প্রতিপক্ষকে দমন করতে বাধ্য হবে, আর যে আক্রান্ত হবে সে পুলিশকে গালি দেবে। কিন্তু সমস্যার কোন সমাধান হবে না। বিষয়গুলোকে আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধির সমন্বয়ে ভাবতে হবে। আমরা যদি পারি জ্ঞান-বুদ্ধির সমন্বয় করে এবিষয়ে কিছু করতে তবেই সমস্যার সমাধান হবে। কোন কাজ হিংসা বা প্রতিহিংসা থেকে করলে ভুল হয়, মানুষ ও প্রকৃতিরি মঙ্গলার্থে হৃদয়ে সর্বদা দেশপ্রেমকে জাগিয়ে রাখতে হয়। আমরা যদি জ্ঞান-বুদ্ধি-কর্ম এবং প্রেমের সমন্বয়ে সমাধানের পথে যেতে পারি তবেই সম্ভব পুলিশের কাছ থেকে ভাল ব্যবহারের। বিষয়টি বিবেকবানদের ভাবতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:১৩