কোরআনিক ব্যাখ্যায় দয়াদর্শন : সূরা বাকারা, রুকু-২, আয়াত : ১১
প্রসঙ্গ : মুনাফিকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ফাসাদ সৃষ্টি
-----------------------------------------------------------------------------------
সুরা বাকারা, রুকু-২, আয়াত :১১
{১১} نَحْنُ مُصْلِحُونَ وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لاَ تُفْسِدُواْ فِي الأَرْضِ قَالُواْ إِنَّمَا
উচ্চারণ : ওয়া ইজা কিলা-লাহুম লা তুফসিদু ফিল আরদি কালু ইন্নামা নাহনু মুসলিহুন।
অর্থ : আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, জমিনের বুকে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে আমরা তো মিমাংসার পথ অবলম্বন করেছি।
‘আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, জমিনের বুকে ফাসাদ সৃষ্টি করো না’ আয়াতের এই অংশ যখন আমরা পূর্ববর্তি আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় পড়ে যাবো তখন আর নতুন করে প্রশ্ন আসে না, এখানে ‘তাদের’ দিয়ে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? তবে একটু প্রশ্ন দেখা দেয় যখন হযরত সালমান ফারসী (রা.) বলেন, যাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাক কোরআনের এই আয়াত অবতীর্ণ করেছেন তারা আর কোনদিন হযরত রাসুল (স.)-এর দরবারে আসেনি। হযরত সালমান ফারসির এই বক্তব্যকে হযরত ইবাদ ইবনে আব্দুল্লাহ সমর্থনও করেছেন। আবার হযরত রাবি ইবনে আনাস (রা.) প্রমূখদের মতে ওরা মুনাফিক শ্রেণীর লোক। তাদের যুক্তি হলো, এখানে ‘ফাসাদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে পাপাচার অর্থে। যারা আল্লাহ ও রাসুল (স.)-এর অবাধ্য তারাই এখানে উদ্দেশ্য। বিশেষ কোন সম্প্রদায় নয়। তাঁর মতে পৃথিবীর মূল শৃঙ্খলা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্যের মধ্যে রয়েছে। এখানে প্রশ্ন দেখা দিলো, এখানে ‘তাদের' দিয়ে কি উপস্থিত কোন গ্রুপকে বুঝানো হয়েছে, না সবসময়ের কিছু মানুষকে বলা হয়েছে। কোরআন বিশেষজ্ঞরা এনিয়ে প্রচুর আলোচনা করেছেন। আমরা তাদের সাবার আলোচনাকে সমন্বয় করে বলতে পারি, কোরআনের বৈশিষ্ট্য-সে উপদেশ করে কখনও বিশেষ কোন কিছু সামনে রেখে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য থাকে সর্বকালের সর্বমানব। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ‘লা তুফসিদু’ অর্থাৎ ফাসাদ সৃষ্টি করো না। এখানে ফাসাদের অর্থ অনেকে বাংলায় করেছেন ‘বিশৃঙ্খলা’। শৃঙ্খলার বিপরীত শব্দ হলো বিশৃঙ্খলা। শৃঙ্খলার আরবী হলো ‘সালাহ’। হযরত মুজাহিদ (র.) মতও তাই। তিনি বলেন, তারা পাপে লিপ্ত হলে যদি বলা হতো পাপ করো না তখন তারা বলতো আমরাতো হেদায়তের উপর আছি, আমরা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকারী। তবে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এখানে ভিন্ন মত করেছেন। তিনি ‘ফাসাদ’ কে ফাসাদ অর্থাৎ বিশৃঙ্খলা হিসাবেই দেখেছেন। তিনি কোরআনের বক্তব্য ‘আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, জমিনের বুকে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে আমরা তো মিমাংসার পথ অবলম্বন করেছি’র ব্যাখ্যায় বলেন, তারা বলে আমরা তো মুমিন ও আহলে কিতাবীদের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষার ইচ্ছে পোষণ করি। কাযি ছানাউল্লাহ পানিপথি (র.) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর এই মতকে গ্রহণ করে বলেন, মুনাফিকরা মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিয়ে যুদ্ধ সৃষ্টির চেষ্টা করতো, আবার কাফেরদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বলে যুদ্ধের প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি করতো। তারা যে এই কাজগুলো করতো তা ছিলো ফাসাদ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা। (তাফসীরে তাবারী, আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জরীর র. এবং তাফসীরে মাযহারী, কাযি ছানাউল্লাহ পানিপথি র.)।
আমরা সালাফ বা আকাবিরদের আলোচনাকে সামনে রেখে সবার বক্তব্যকে সমন্বয় করতে পারি। তাদের বক্তব্যে ভিন্ন শব্দ প্রয়োগের ফলে ব্যাখ্যায় কিছুটা ব্যবধান মনে হলেও তাতে কোন ব্যবধান নেই। বিশৃঙ্খলা জিনিষটাও পাপ। ফেতনাকে বলা হয়েছে হত্যা থেকেও জঘন্য পাপ। যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতো কিংবা করে তারা মূলত পাপকেই প্রতিষ্ঠা করে। আর পূর্ববর্তি আয়াতগুলোর বর্ণনার পরিক্রমায় প্রমাণ করে এই আয়াতে মুনাফিকদের উদ্দেশ্য করেই কথা বলা হয়েছে। মুনাফিক বিশেষ কোন সময় কিংবা বিশেষ কোন গোত্রে চিহ্নিত করা এখন আর প্রয়োজন নেই। মুনাফিক এখন চিহ্নিত করতে হবে নিফাকের বৈশিষ্ট্যসমূহ দিয়ে। সাইয়েদ কুতুব (র.) নিফাকের সকল বৈশিষ্ট্যকে সমন্বয় করে খুব সংক্ষেপে বলেছেন, মুনাফিকরা সত্যকে নিঃসংকোচে মেনে নেওয়ার সৎসাহস রাখে না, আবার মুখোমুখি সত্যকে অস্বীকারও করতে পারে না, আবার তারা সাধারণ মানুষের কাছে মর্যাদা লাভেরও প্রত্যাশা করে। তাঁর মতে ঐ শ্রেণীর মানুষ কোন বিশেষ সময়ের সাথে সম্পৃক্ত নয়, ওরা আছে সর্বকালে-সর্বযুগে। (তাফসীরে ফী যিলালিল কোরআন, ১ম খণ্ড)। আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী (র.) লিখেছেন, মুনাফিকরা সবসময়ই মিথ্যুক, অবিশ্বস্ত, লোভী, সুবিধাবাদি এবং নীতিজ্ঞানশূন্য হয়। ভণ্ডামি আর কপটতাই হলো তাদের মূল রোগ। ওরা ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা নিয়ে ভাবে না, তারা সবসময় ভাবে নিজের সুবিধার কথা। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নিজের অবস্থান ভাল বা সুবিধাজনক করা। সুবিধাজন অবস্থান তৈরির জন্য তারা ন্যায়-নীতি ছেড়ে দিতে পারে। তারা বুঝতেই চায় না যে, ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় কখনও এক হতে পারে না। তারা নিজের স্বার্থে ভালকেও মন্দে রূপ দিতে অপরাধবোধ করে না। ( কোরআনের প্রথম ইংলিশ অনুবাদ)।
আমরা যদি সকল বক্তব্যকে সামনে রেখে বর্তমান সময়ের মুনাফিকদের চরিত্রগুলো পর্যালোচনা করি তবে সময় আর সমাজের ভিন্নতার মধ্যেও চরিত্রে অনেক অভিন্নতা দেখা যাবে। বর্তমান সময়েও মুনাফিকরা অন্তরে এককথা রেখে মুখে অন্যকথা বলে। প্রতিদিন তারা পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে ফাসাদ সৃষ্টি করে নিজেদের হীনস্বার্থে, অথচ বড় গলায় মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা কবুতর উড়িয়ে নিজকে শান্তির দূত বলে ঘোষণা করে। কারো নাম এখানে উল্লেখের প্রয়োজন নেই। আসুন, আপনি বা আমি নিজের স্থানে দাঁড়িয়ে প্রথমে নিজকে দেখি, অতঃপর দেখি নিজের আশপাশের অবস্থা। আমরা যারা বক্তব্যে সত্য, ন্যায় এবং ইনসাফের কথা বলি তাদের কর্তৃক সত্য, ন্যায় এবং ইনসাফ কতটুকু লুন্ঠিত হচ্ছে, তা একটু বিবেচনা করেদেখি। ভালো মানুষের পোশাক আর সুশীল সমাজের ব্যানার লাগিয়ে আমরা কি কি করছি তা একটু বিবেচনায় এনে সাবেক মুনাফিকদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে আমরা ওদের থেকে মুনাফিকিতে কতটুকু দূরে?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:০৫