কোরআনিক ব্যাখ্যায় দয়াদর্শন : সূরা বাকারা, আয়াত : ৬
কুফুর এবং কুফরির প্রকারভেদ
{৬} إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَأَنذَرْتَهُمْ أَمْ لَمْ تُنذِرْهُمْ لاَ يُؤْمِنُونَ
উচ্চারণ : ইন্নাল্লাযিনা কাফারু সাওয়উন আলাইহিম আ-আনযারতাহুম আমলাম তুনযিরহুম লা ইউমিনুন
অর্থ : যারা কুফরি করেছে,তুমি তাদেরকে সতর্ক করো কিংবা না, তাদের পক্ষে উভয়ই সমান। তারা ঈমান আনবে না।
মুত্তাকিদের পরিচয় এবং মুত্তাকিদের প্রতি সুসংবাদ দেওয়ার পর সূরা বাকারার ছয় নম্বর আয়াত থেকে অবিশ্বাসীদের সমালোচনা শুরু হয়েছে। এই আয়াতে ‘কাফারো’ শব্দ এসেছে, যার অর্থ কুফরি। এখন প্রশ্ন হলো-কুফরি কি? কুফর শব্দের অর্থ কোন কিছু ঢেকে বা লুকিয়ে রাখা। আরবদেশে রাতকে এবং ক্ষেতে বীজ রোপনকে কুফরি বলা হয়। অকৃতজ্ঞতা, না-শুকুরি ইত্যাদিও কুফরি। মুফতি মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান (র.)-র মতে, নবী করিম (স.) কর্তৃক আনীত বিষয়াদি যা অকাট্যভাবে দ্বীনের অঙ্গ বলে প্রমাণিত এ সবের কোন একটি অস্বীকার করাকে কুফরি বলে। (কাওয়াইদুল ফিক, পৃষ্টা ৪৪৫)। মুফতি শফি (র.)ও সমার্থক কথা লিখেছেন, যে সমস্ত বিষয়ে ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন ফরয, সেগুলো অস্বীকার করাকে কুফর বলে। (তফসীরে মাআরেফুল কোরআন)। শায়খুল হাদিস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (র.) ‘কুফুর’ কে চারভাগে বিভক্ত করেছেন,
১) কুফরে ইনকারী : মুখে এবং অন্তরে সত্যকে অস্বীকার করা। মনে মনে সত্যকে বিশ্বাস না করা এবং মুখে স্বীকারও না করা।
২) কুফরে জুহুদ : হক বা সত্যকে অন্তর দিয়ে সত্য জানা, কিন্তু মুখ দিয়ে স্বীকার না করা।
৩) কুফরে মুআনাদা : সত্যকে সত্য জেনে স্বীকার করার পরও তা গ্রহণ না করা, তার অনুসারী না হওয়া।
৪) কুফরে নিফাক : মুখে সত্যকে স্বীকার করা কিন্তু অন্তরে অস্বীকার করা। (ফায়যুর বারী শহরে বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ.৭১)।
যে কুফুরি করে তাকে কাফের বলা হয়। প্রকৃত অর্থে কাফের কোন গালি নয়, তা কোন কিছু গোপনকারীদের পরিচয়। তবে প্রত্যেক জিনিষের ভালো-মন্দ নির্ভর করে যে বলে তার নিয়তের উপর। ভালো কথাকেও যদি খারাপ নিয়তে বলা হয় তবে তা শোনতে খারাপ-ই লাগে। সুরা বাকারার ছয় নম্বার আয়াতের সরাসরি অর্থ করলে স্পষ্ট হয়, যারা কুফরি করেছে তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে লাভ নেই, কারণ তারা ঈমান আনবে না। এখানে শব্দ এসেছে ‘এনযার’, যা দিয়ে বুঝায় ঐ দয়াময় সতর্ককারীর সতর্কবার্তা, যা মানুষকে ভুল পথ থেকে রক্ষায় মনে ভয়ের সঞ্চার করে। মুফতি শফি (র.) তফসীরে মাআরেফুল কোরআনে এই ভয় প্রদর্শনকারীর উপমায় মায়ের কথা বলেছেন। নবী ও রাসুলেরা প্রকৃত অর্থে মা থেকেও বেশি দয়ার বিশ্বাসী। তাই তাদেরকে ‘নাযির’ বলা হয়েছে। কারণ, তারা দয়া ও সতর্কতার ভিত্তিতে মানুষকে আগামীর বিপদ থেকে রক্ষার জন্য সর্বদা সতর্ক রাখতে চেষ্টা করেছেন, বেহেস্ত ও দোযখের ভয় দেখিয়েছেন, দাওয়াতে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন দায়ী ইলালল্লাহর দায়িত্ব হলো দয়ার পরশে মমতা ও সমবেদনা সহকারে আল্লাহর পথে, সৎ পথে, আলোর পথে মানুষকে দাওয়াত দিবে। হযরত মুহাম্মদ (স.) তাঁর দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে পালনের পর কিছু জেদিÑআহংকারী সত্য জেনেও অহংকারবশত অসত্যে দৃঢ় থেকে গেলে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। আয়াতের ভাষা থেকে যদিও পরিস্কার নয় যে, এই হুকুম সকল কাফিরদের জন্য, না বিশেষ কারো কারো জন্য? যদি তা সবার জন্য হয় তবে আর দাওয়াতী কাজ করে লাভ কি? কোন কাজ যখন করা না করা সমান হয়ে যায় তখন আর এই কাজ করার কোন অর্থ থাকে না। আল্লাহ যখন বলেই দিলেন, ওদেরকে সতর্ক করা, না করা সমান, তখন আর সতর্ক করার কোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু হযরত রাসুল (স.) এবং তাঁর সাহাবীরা তো থেমে থাকেন নি, থেমে নেই আমাদের সময়েও দাওয়াতের কাজ। এই আয়াতের শানে নুজুল থেকে স্পষ্ট, প্রকৃত অর্থে এ আয়াতের হুকুম সব কাফেরের জন্য প্রযোজ্য নয়। এখানে ‘যারা কুফরি করেছে’ বাক্যটা অতীতের খবর। এই খবরে সরাসরি বুঝা যাচ্ছে না কথাটি কাদেরকে ইঙ্গিত করে এবং যাদেরকে এখানে ইঙ্গিত করা হচ্ছে তারা জীবিত না মৃত। কোন কোন কোরআন ব্যাখ্যাকারীর মতে, এই আয়াত তাদের সম্পকের্, যারা কুফরির মধ্যে মারা গিয়েছে। তবে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর মতে হযরত রাসুল (স.)-এর সময়ে মদিনার উপকণ্ঠে বসবাসকরি ঐ ইহুদিদের তিরস্কার্থে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, যারা জানতো হযরত মুহাম্মদ (স.) সকল মানুষের কল্যাণার্থে প্রেরিত আল্লাহর রাসুল, অথচ অস্বীকার করতো। আর হযরত রাবী ইবনে আনাস (রা.) বলেন, এই আয়াত কাফের দলপতিদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। বেশিরভাগ ব্যাখ্যাকারী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কথাকে সঠিক বলে মত দিয়েছেন। ‘যারা কুফরি করেছে’ বাক্য দিয়ে বুঝা যায় আগে তারা কুফরির মধ্যে ছিলো না, তারা নতুন করে করছে। আর যদি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-র কথা সত্য হয় তবে ‘যারা কুফরি করেছে’ একথা সঠিক। কারণ ইহুদিরা তো প্রথমে তাওহিদের বিশ্বাসী ছিলো, পরে বিভ্রান্ত হয়ে কুফরি করেছে। আর যদি আমরা ধরে নেই একথাটি সকল ইহুদিদের জন্য, তবু তা সত্য। কারণ, আজও সত্য বলে প্রমাণিত যে, ইহুদিদেরকে সতর্ক করা এবং না করা সমান। তারা ঈমান আনবে না। কেন তাদের জন্য সতর্ক করা, না করা সমান? তা পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে,
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১:২০