খেজুরের রস খেতে যাব একথা আগের রাতে ফোনে জানানো হয়। মঞ্জিদ গাছি ভোরে যেতে বলে।
ভোর ছ'টার দিকে মঞ্জিদ গাছির বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাই। বাড়ির বউ বা ঝি-দের অনেকেই তখনও বিছানার লেপের উষ্ণতা ত্যাগ করেনি। আমরা পৌঁছানোর পর উষ্ণ শয্যা ত্যাগ করে বাহিরে বেরিয়ে আসে। জানায়, ভোর রাতে বেরিয়েছে সে। এখনও ফেরে নাই। তবে রস নিয়ে ফেরার সময় হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরবে হয়তো।
ঘর হতে চেয়ার বের করে বাহিরে বসতে দেওয়া হয় আমাদের। আমরা রস জ্বাল দেওয়ার চুলার পাশে বসে অপেক্ষা করি।
কিছু সময় পর ভ্যানগাড়ি টেনে নিয়ে রস-সহ এসে পৌঁছায় মঞ্জিদ গাছি। জীর্ণ শরীরে দ্বীনতার ছাপ স্পষ্ট। মাত্র একটা চাদর দিয়ে পৌষের শীত প্রতিহত করার চেষ্টা। খালি পা শিশিরে ভেজা। পৌষের শীতে নেতিয়ে পড়েছে তবুও কর্মব্যস্ততায় ব্যঘাত হতে দিচ্ছে না। ভ্যানগাড়িতে মাঝারি আকারের ড্রামে রস। ড্রামের চারপাশে মাটির ভাঁড় শক্ত করে বাঁধা। খেজুরগাছ কেটে রস সংগ্রহ করতে যে ভাঁড় গাছে লাগিয়ে রাখা হয়। স্ত্রীর সহযোগিতায় ভ্যানগাড়ির ওপর হতে কড়াইতে রস ঢালে। রসের মধ্য থেকে বন কচুর টুকরাগুলো কাপড়ের ছাকুনিতে জমা হয়। বলি, এ কী দিয়েছেন?
জবাব দেয়, জ্যারি ছাওয়ালপল রস খায়া ভাঁড় নিচে থুয়ে দেয়, তাই লেগিন বন কচু দেই। গলা চুলহেলি খায় না। তুমারে লেগিন আলাদা হরে লিয়াইচি।
স্ত্রীর হাতে একটা ভাঁড় ধরিয়ে দিয়ে বলে, ছেহি জগে হরে খাবির দ্যাও।
পতির নির্দেশ মোতাবেক স্ত্রী ভেতর থেকে জগ নিয়ে আসে। ভাঁড় থেকে কাপড়ের পরিস্কার ত্যানা দিয়ে ছেকে জগে ঢেলে আমাদের খেতে দেয়। অনেকদিন পর খেজুরের রস খাই। গত শতাব্দির শেষ দশকেও যাদের শৈশব বা কৈশোর গ্রামে অতিবাহিত হয়েছে তারা জানে শীতের সকালে হিমশীতল খেজুর রসের মজা। যে মজা পৃথিবীতে তৈরি এমন কোনো কোমল পানীয় নাই যে দিতে পারবে।
মঞ্জেদ গাছি কথা বলে সীমিত। কথা বলা ছাড়া আর কিছুতে আলসেমি আছে বলে মনে হলো না। বলি, কাকা একগ্লাস খান?
জবাব দেয়, আমি খাই নিএ।
- কেন খান না?' জিজ্ঞেস করি। বলে, এবাই খাইনিএ।
গ্লাসে ঢেলে সামনে ধরি। আন্তরিকতা অগ্রাহ্য করতে পারে না। ঢকঢক করে খেয়ে ফেলে।
এরপর ছবি তোলার কথা বলি। প্রথমে একটু ইতস্তত বোধ করে। পরে স্ত্রীকে বলে, আমার ক্যাপডা লিয়ে আসো।
ঘর থেকে ক্যাপ এনে দেয় স্ত্রী। ক্যাপ পড়ে ছবি তোলার জন্য প্রস্তুত হয়। পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি।
বাজারে খেজুরের রসের খাঁটি পাটালি গুড় পাওয়া যায় না। ভেজাল গুড়ে বাজার ছয়লাব। নিজের সুনাম ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে সে ভেজাল করে না। দুঃখ করে বলে, এইদ্যাশে কি পরিশ্রমের মূল্য আছে? খাঁটি মানুষই তো নাই তা খাঁটি জিনিস আসবি কোনোতিন।
-সোহাগ তানভীর
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সকাল ৭:৪৪