ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে আমাদের কৌতুহলের কোন শেষ নেই। আর সেই ভবিষ্যদ্বাণী যদি অত্যন্ত আশ্চার্য জনক ভাবে সত্যি হয়ে যায়, তাহলে গোটা বিশ্ব জুড়ে হইচই পড়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বক্তা মানব সভ্যতা সম্পর্কে কিছু আগাম পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, যেগুলো পরবর্তীতে হুবহু মিলে গিয়েছিল। এইসব ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যে কিভাবে মিলে গেল, তার কোন যুক্তি মানুষ এখনো পর্যন্ত দাড় করাতে পারে নি! চলুন তাহলে আজকে জেনে নেয়া যাক পৃথিবীর বিখ্যাত এমনই কিছু ভবিষ্যদ্বাণীর কথা.........
হিটলারের জন্মের পূর্বাভাসঃ- পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম একনায়ক 'অ্যাডলফ হিটলারের' উত্থানের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ফরাসি ভবিষ্যদ্বক্তা 'নস্ত্রাদামু'। ১৫৫৫ সালে তিনি হিটলার সম্পর্কে এই ভবিষ্যদ্বাণীটি করেছিলেন। নাৎসি শাসকের জন্ম বৃত্তান্ত ও নিষ্ঠুরতার কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, "পশ্চিম ইউরোপের এক শিশু, যে দরিদ্র ঘরে জন্ম নেবে এবং তার কথার মোহে আবিষ্ট হবে পৃথিবীর বহু মানুষ"। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো, নস্ত্রাদামু এমনকি সেই শিশুর নামটিও লিখে গিয়েছিলেন। তবে পার্থক্য শুধু এটুকুই যে তিনি নামের জায়গায় হিটলারের পরিবর্তে উল্লেখ্য করেছিলেন 'হিসটার'।
ওকলাহোমা বোমা বিস্ফোরণঃ- আমেরিকার আধ্যাত্নিক মিডিয়াম 'ট্যানাহয়' একসময় দাবী করেছিলেন, তার সাথে অশরীরী আত্নাদের যোগাযোগ আছে। আশরীরী আত্নারা তাঁকে অদূর ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার কথা জানিয়ে যায়। ১৯৯৫ সালের ঘটনা। এক লাইভ রেডিও অনুষ্ঠানে তিনি জানান, 'ওকলাহোমা শহরের এক বাড়িতে বিধ্বংসী বোমা বিস্ফোরণ ঘটাবে জঙ্গিরা'। এর ঠিক ৯০ মিনিট পরেই প্রচন্ড বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় 'ওকলাহোমার অ্যালপ্রেড পি মুরাহ ফেডেরাল বিল্ডিং'। এই বিস্ফোরণ ঘটনার হোতা টিমথি ম্যাকভেই ও তার সঙ্গীরা পরে গ্রেফতার হয়।
হিরোসিমা-নাগাসাকির বিস্ফোরণঃ- সাহিত্যিক এইচ জি ওয়েলস ১৯১৪ সালে তার ‘দ্য ওয়ার্ল্ড সেট ফ্রি’ উপন্যাসে মানব ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম সর্বনাশের কথা লিখে গিয়েছিলেন। এখানে তিনি ঘটনার ত্রিশ বছর আগেই অ্যাটমিক বোমার আঘাতে গণহত্যার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। তিনি এটাও বলেছিলেন যে, 'অ্যাটমিক বোমা বিস্ফোরণের অনেক বছর পরও এই দুই ক্ষতিগ্রস্থ জনপদ বাসযোগ্য হবে না'।
টাইটানিকের সলিল সমাধিঃ- ১৯ শতকের সাহিত্যিক 'মর্গ্যান রবার্টসন' মূলত একজন ছোট গল্পের রচয়িতা হিসাবে বেশি পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তার একটি বিখ্যাত উপন্যাস হচ্ছে ‘ফিউটিলিটি, অর দ্য রেক অফ দ্য টাইটান’। এই উপন্যাসের কাহিনীতে দেখানো হয়েছিল, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ট্রিপল স্ক্রু প্রপেলার বিশিষ্ট জাহাজ উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে হিমশৈলের ধাক্কায় ২৫০০ যাত্রীসহ ডুবে যায়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই উপন্যাসটি প্রকাশের ১৮ বছর পর আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তরে একইভাবে দূর্ঘটনার কবলে পড়ে ডুবে যায় বিশাল যাত্রীবাহী জাহাজ 'আরএমএস টাইটানিক'।
অগ্নুৎপাত, সুনামি এবং হারিকেন ক্যাটরিনাঃ- বেশ কয়েক বছর আগে 'পামার' ভারত মহাসাগরে উদগীরণ এবং সুমাত্রা ও ইন্দোনেশিয়া উপকূলে আছড়ে পড়া ভয়ঙ্কর জলোচ্ছাসের কথা জানিয়েছিলেন। ২০০৪ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়শিয়া সহ বিশ্বের ১৪টি দেশে সুনামির তান্ডবে প্রাণ হারান প্রায় ২,৩০,০০০ মানুষ। শুধু প্রাকৃতিক দূর্যোগই নয় উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র সম্ভারের পূর্বাভাসও করেছিলেন তিনি। তবে 'পামার' সব থেকে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন ২০০৫ সালে। হারিকেন ক্যাটরিনা সম্পর্কে তার ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গেলে, রাতারাতি তিনি বিশ্ব বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।
আব্রাহাম লিঙ্কন হত্যাকান্ডঃ- প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট 'আব্রাহাম লিঙ্কনের' মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন লিঙ্কন নিজেই। আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার ঠিক দু’সপ্তাহ আগে হত্যাকান্ডের গোটা দৃশ্যই তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন । দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের আবহে নিত্যদিনের মানসিক চাপে থাকা প্রেসিডেন্টের পক্ষে এ ধরণের দুঃস্বপ্ন দেখা স্বাভাবিক হলেও, এটি ছিল একটি বিষ্ময়কর ঘটনা। ঘুম থেকে উঠে তিনি জানিয়েছিলেন, 'স্বপ্নে তিনি নিজেকে একটি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে দেখেন। তখন চারদিকে মৃত্যুকালীন নিরবতা বিরাজ করছিল। শুধু কোথাও থেকে কারো ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল'।
চন্দ্রাভিযানের পূর্বাভাসঃ- ‘জুলভার্ন’ একজন বিশ্ববিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক। মানুষ যে একদিন চাঁদে পা রাখবেন তা তিনি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। ১৮৬৫ সালে ‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’ উপন্যাসে তিনি মানুষের চন্দ্রাভিযানের আগাম ইঙ্গিত প্রদান করেছিলেন । তার উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার ১০০ বছর পর তার দেয়া চন্দ্রাভিযানের বর্ণনার সাথে অনেকটাই মিলে যায় পৃথিবীর উপগ্রহের মাটিতে প্রথম মানব পদচিহ্নের ঘটনা। মহাকাশযানের আকার, মহাকাশচারীর সংখ্যা, অভিযানের মোট সময় এবং ভরশূণ্যতার খুঁটিনাটি তথ্য ভার্নের লেখার সাথে একেবারেই মিলে গিয়েছিল।
লন্ডনের অগ্নিকান্ডঃ- ১৫৫৫ সালে 'নস্ত্রাদামু' তার প্রকাশিত বই ‘লে প্রোফেতিস’-এ লন্ডন শহরের ভয়ানক অগ্নিকান্ডের কথা লিখে গিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘৬৬ সালের এই আগুনে লন্ডনের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের রক্ত পুড়বে’। এর ঠিক চার'শ এগার বছর পর ১৯৬৬ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ রাজধানীতে ভয়ঙ্কর অগ্নিকান্ডে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারান।
মার্ক টোয়েন’র মৃত্যুঃ- জনপ্রিয় সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন নিজের মৃত্যুর দিন ও সময় সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তার মৃত্যুর সময় সেই ভবিষ্যদ্বাণী একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। টোয়েন লিখেছিলেন, ১৮৩৫ সালে তার জন্মের সময় আকাশে হ্যালির ধূমকেতু দেখা গিয়েছিল। এবং তিনি জানিয়েছিলেন, 'এই হ্যালির ধুমকেতুর পুনরাবির্ভাবের সময় তার মৃত্যু হবে'। ১৯১০ সালে মার্ক টোয়েনের যখন জীবনাবসান হল ঠিক তার সঙ্গে সঙ্গে রাতের আকাশে আবার দেখা গেল সেই হ্যালির ধূমকেতু।
পরমানু বোমা এবং আমেরিকাঃ- 'সলিউশন অ্যানস্যাটিসফ্যাক্টরি' ছোট গল্পে এমন এক আমেরিকার কথা লিখেছিলেন জনপ্রিয় সাহিত্যিক 'রবার্ট হেইনলেইন', যে দেশ পৃথিবীর অন্য সব দেশের আগে পরমানু বোমা বানিয়ে পৃথিবীর একমাত্র সুপার পাওয়ার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। তার দেখা দেখি অন্য দেশ গুলিও তড়িঘড়ি করে এই পরমানু বোমা তৈরি করবে বলেও তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে যান। সাহিত্যিকের এই দূরদৃষ্টি পরবর্তি অধ্যায়ে কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে সেটা তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন।
পুনশ্চঃ- বাস্তবতার নিরিখে বিচার করলে নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হয় যে; অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে সব কিছুর জ্ঞান একমাত্র মহান স্রষ্টার মধ্যেই বিরাজমান। সবই তিনি জ্ঞাত! আজ থেকে নিযুত কোটি বছর পরে কী ঘটবে তার সবই তিনি আগেই ঠিক করে রেখেছেন। গভীর সমুদ্রের অতল তলে, অরণ্যের নিভৃত কোণে, মহাকাশের সুদূর অন্তরীক্ষে কোথায় কী ঘটছে এমনকী প্রতিটি মানুষের মনের অভ্যন্তরে কী কথা লুকায়িত আছে, কী ভাবছে এ সবই স্রষ্টার নখদর্পনে। আর এই জন্যই তো তিনি সৃষ্টিকর্তা।
এখানে উল্লেখ্য; কোন ভবিষ্যদ্বক্তা যখন কোন ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তখন সেই ভবিষ্যদ্বাণী ঘটার পরেই এটাকে প্রকৃত ফলপ্রসূ ভবিষ্যদ্বাণী বলা হয়। অন্যথায় সেই ভবিষ্যদ্বাণীটি ঘটার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, আর না ঘটলে তখন এটি আর ভবিষ্যদ্বাণী বলে বিবেচিত হয় না। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, নিযুত কোটি ঘটনা প্রবাহের মধ্যে দু একটি ছিটে ফোঁটা ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী আমরা জানছি এবং ফলপ্রসূ হতে দেখছি। তবে সার্বিক বিবেচনায় যে বিষয়টি সব থেকে বেশি স্পষ্ট সেটি হলো, এই মহাবিশ্বের যাবতিয় সবকিছু অত্যন্ত সুচিন্তিত, সুনিয়ন্ত্রিত, এবং খুবই সুপরিকল্পিত। আর এজনই এর যে কোন ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় এবং তা ফলপ্রসূও হতে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে বলতে গেলে আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাই তো সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী। তিনি সব কিছু জানেন এবং বোঝেন। এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্যের দ্বার উদঘাটনে আইনস্টাইনের সেই উক্তিটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, “নিশ্চই এর পেছনে রয়েছে এক অকল্পনীয় মহাজ্ঞানী সত্ত্বার এক রহস্যময় অভিপ্রেত।” আর তিনিই হলেন সকলের সৃষ্টিকর্তা!!
তথ্যসূত্রঃ- ইন্টারনেট অবলম্বনে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:২৫