শিশুতোষ বই নিয়ে এ কেমন নৈরাজ্য? (এটি একটি গবেষণা মূলক প্রতিবেদন)
নিন্মের গবেষণাটি কাউকে আঘাত দওয়ার জন্য নহে।
আমার প্রশ্ন বাংলাদেশের স্কুল কলেজে শধু মাত্র মুসলমান ছেলে মেয়রা পড়া লেখা করেন। আর অন্য কোন ধর্মের ছেলে মেয়রা পড়া লেখা করেন না।
মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী কি এই সব দেখে না।
প্রি-প্রাইমারি এবং নন-স্কুলগোয়িং বাচ্চাদের কী বই পড়ানো হচ্ছে এবং কারা এসব বই তৈরি করছে, কোথা থেকে মুদ্রিত হচ্ছে, সে বিষয়ে সরকারের কোনো নজরদারী নেই বলে এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। নানান ধরনের ভুলের পাশাপাশি এসব বইতে জঙ্গিবাদের রসদও আছে। যদিও শিশুরা তত্ত্ব গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়, এবং শিশু মনোবৈজ্ঞানিকেরা বলে থাকেন যে এমন কোনো বিষয় নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত শিশুদের সামনে উপস্থাপন করা উচিৎ নয় যা বস্তুগতভাবে বুঝানো যায় না। দেখা যাচ্ছে, এসব বইতে এমন অনেক বিষয় (বাক্য) উপস্থাপিত হয়েছে, যা শিশুদের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। বাক্যের সাথে যেসব ছবি বইতে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো শিশুদের কাছে দৃশ্যত কোনো পরিচয় তুলে ধরে না। যেসব শব্দ এবং বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে, মোটেও সেগুলো শিক্ষামূলক নয় বলে মনে করেন বেশিরভাগ অভিভাবক। এছাড়া যেসব ছড়া বইতে উপস্থাপিত হয়েছে, সেগুলোর মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন তোলা যায়, প্রশ্ন থেকে যায় বিষয়বস্তু নিয়েও।
প্রদত্ত বিশ্লেষণে বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত কয়েকটি প্রকাশনীর বই নমূনা হিসেবে নিয়ে বিষয়টির ভয়ঙ্কর দিক তুলে ধরা হয়েছ।
১) বইয়ের নাম: ‘বাল্যশিক্ষা’ প্রকাশনীর নাম: ফ্রেন্ডস বুক সেন্টার, ঠিকানা: ৩৮/২-খ, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, ফোন: ০২ ৭১১৫২৭৩, ০১৭১৫০০৪১০২
বইয়ের পিছনে মূল্য লেখার ঘর আছে, কিন্তু সেখানে কোনো মূল্য উল্লিখিত নেই, পাশে ভুল বাক্যে লেখা রয়েছে "Export from India" খোজ নিয়ে জানা গেছে মোটা তেলতেলে কাগজ এবং রঙ্গীন এ বইটি অত্যন্ত কম মূল্যে পুস্তক বিক্রেতাদের দেওয়া হয়, যাতে এ ধরনের বইগুলো সারা বাংলাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মূল্য লেখা না থাকার কারণে লাইব্রেরিয়ানরা ইচ্ছেমত দামে বইটি বিক্রী করতে পারে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্কুলে বইটি পাঠ্য রয়েছে। ভালো এবং মোটা কাগাজের বইয়ের দাম কম হওয়ায় ফুটপথ থেকেও এসব বই দেদারচ্ছে বিক্রী হচ্ছে।
২) বইটিতে বর্ণ শেখাতে গিয়ে মূলত ধর্ম শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, উপস্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন বিমূর্ত বিষয়, যা একটি দুই/তিন/চার/ বছরের শিশুর জন্যে অত্যন্ত নেতিবাচক বলে মনে করেন দেশের খ্যাতনামা শিশু মনোবৈজ্ঞানিকেরা।
এছাড়া বানান ভুল এবং ভুল বাক্য রয়েছে বইটিতে। কঠিন শব্দ রয়েছে, অনর্থপূর্ণ শব্দ রয়েছে।
বইটির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় স্বরবর্ণ দিয়ে যে দশটি বাক্য রয়েছে, এর মধ্যে ছয়টি বাক্যই ধর্ম সম্পর্কে, বস্তু নির্ভর না হওয়ায় সেসব বাক্যে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, এসব বাক্য এবং ছবি থেকে একটি শিশু কী শিখবে অভিভাবকরা তা বুঝে উঠতে পারছে না।
কথা উঠেছে, বইটির পাঠক নিয়ে। “কারা পড়বে বইটি?” বইটি যেহেতু কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, বরং মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার জন্য, তাই এ ধরনের বইয়ে নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম সম্পর্কে শিশু মনে বিভ্রন্তি ছড়ানো কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্নটি উঠছে গুরুতরভাবে।
বইটির ২ নম্বর পৃষ্ঠার দ্বিতীয় বাক্যে লেখা রয়েছে, ‘খ’ তে “খোদার রহমত পাবে তাতে” সাথে রয়েছে ফুলের ছবি। ‘খোদাকে’ ফুলের ছবি দিয়ে বর্ণনা করে আকার দেওয়ায়, বিষয়টিকে ধর্মাবমাননা বলছেন অনেক ইসলামী পণ্ডিত।
তিন নম্বর লাইনে রয়েছে, ‘গ’ তে “গান শোনা ভালো নয়”। লাইনটিকে ইসলাম বিরোধী এবং জঙ্গিবাদের সহায়ক বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা।
চার নম্বর পৃষ্ঠায় প্রথম লাইনে ‘ড’ তে “ডান হাতে খাবার খাও” লেখা রয়েছে। অনেক শিশুর ডান হাত না থাকতে পারে, তাই একথাটি লেখার সুযোগ নেই। এ ধরনের লাইন লেখার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা, কারণ, কিছু জিনিস মানুষ জন্মগতভাবে শেখে।
চার নম্বর লাইনে আছে, ‘ত’ তে “তাজা মুরগীর খাব রোস্ট”। বইটি দেখালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেছেন, এই লাইনটি থেকে বোঝা যায় কতটা স্বস্তা চিন্তা-ভাবনার মানুষ দ্বারা বইগুলো করানো হচ্ছে।
‘থ’ তে “থাকলে তুমি আল্লার পথে” ছবি হিসেবে এখানে দেখানো হয়েছে মসজিদ। এই লাইনটি দ্বারা একটি শিশু কী বুঝবে? ‘দ’ তে “দয়া পাবে আখেরাতে” এখানে রয়েছে ফলমুলের ছবি। ‘ন’ তে “নয়তো আল্লাহর সাজা পাবে” ছবি দেওয়া হয়েছে আগুনের।
‘ক্ষ’ তে “ক্ষমা চাও আল্লাহর কাছে” ছবি হিসেবে দেওয়া হয়েছে ‘দুটি হাত’। ‘ড়’ তে “দৌড়ে যাও নেকীর পথে” সাথে একটি মসজিদের ছবি দেওয়া হয়েছে। ‘দৌড়ে’ বানানটি ভুল রয়েছে সেখানে। “দৌড়ে যাও নেকীর পথে” পড়ে শিশুরা কী বুঝবে? -প্রশ্নটি করেছেন একজন অভিভাবক।
বইটির ১১ নম্বর পৃষ্ঠায় কঠিন কঠিন শব্দে যেসব নীতিবাক্য দেওয়া হয়েছে, তা বর্ণশিক্ষার বইতে দেওয়া উচিৎ কিনা, সে বিষয়ে যেমন প্রশ্ন থেকে যায়, পাশাপাশি ভুল রয়েছে বানানে।
বইটির ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় অজস্র ভুল বানানে যা লেখা রয়েছে বর্ণ শিখছে এমন একটি শিশুর জন্য মোটেই তা উপযোগী হয় না।
বইটিতে এরপর রয়েছে ছড়া, সবছড়াই ধর্মভিত্তিক, তবে লেখকের নাম নেই, বা সংকলিত হলে তা কোথা থেকে সংকলন করা হয়েছে, তা উল্লেখ নেই।
১৮ নম্বর পৃষ্ঠায় রয়েছে ইংরেজি বর্ণ পরিচয়। এখানে ইংরেজি বর্ণ দিয়ে শব্দ বানানো হয়েছে। এরপর তার অর্থ দিয়ে বাংলায় বাক্য গঠন করা হয়েছে। অনেক বাক্য এখানেও ধর্ম বিষয় নির্ভর। ভুল শব্দ, বাক্য এবং ভুল সমন্বয় তো আছেই।
Z-Zoo দিয়ে রয়েছে “চিড়িয়াখানাতে আল্লাহর কুদরত দেখো” ছবি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে চিড়িয়াখানার একটি গেট।
ইংরেজি ছড়া অংশে বিভিন্ন আরবী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা কোনো অর্থ বহন করছে না। এক্ষেত্রে ছড়াকারের নাম নেই। সংকলন করা হলে কোথা থেকে করা হয়েছে তা উল্লেখ নেই।
এরপর রয়েছে আরবী বর্ণমালা শিক্ষা। এখানেও বিভিন্ন বিমূর্ত এবং ধারণা নির্ভর বাক্যের সাথে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
[img|http://s3.amazonaws.com/somewherein/pictures/Rubel1984/Rubel1984-1477448590-73ea9d0_xlarge.jpg
৩২ নম্বর পৃষ্ঠায় পৃথিবীর প্রথম মানুষ সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিচের কথাগুলো লেখা হয়েছে। (ছবিতে প্রদর্শীত)
৩৯ নম্বর পৃষ্ঠায় রয়েছে বাংলাদেশের ম্যাপ, যেখানে সীমান্ত নির্দেশিত নেই। ম্যাপটি দেখলে মনে হবে বাংলাদেশের কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেই। তবে এডিট করতে গিয়ে কিছু ভুল তারা করে রেখেছে, 'International Boundary' নিচে লিখে রেখেছে, যদিও 'International Boundary' তারা মানচিত্র থেকে মুছে দিয়েছে।
শেষ পৃষ্ঠায় প্রতিটি বর্ণ দিয়ে একটি করে নীতিবাক্য লেখা হয়েছে, চিরায়ত বাক্যগুলোকে কাটছাট করে লিখতে গিয়ে যাচ্ছেতাই করা হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে বানান ভুল এবং শিশুদের জন্য দুর্বোধ্য শব্দ। ‘ঢ’ দিয়ে লেখা হয়েছে, “ঢোলের শব্দ বহুদূর যায়” বইটি কোন বয়সের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, বইটিতে সে নির্দেশনা নেই। দেওয়া হয়েছে নানান কিছু, যা সম্পাদিত নয়, ঠিকমত প্রুফ দেখা হয়নি। রয়েছে এমন কিছু শব্দ, বাক্য, যা শিশুদের বইয়ে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট জনেরা। বইটিতে একটি লাইন রয়েছে, যা আইনত দ-নীয় বলে মত দিয়েছেন দেশের বিজ্ঞ একজন আইনজীবী। বইটির তিন নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে ‘গ’ তে “গান শোনা ভালো নয়”। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ’র কথা বলে একই সাথে ছবি ব্যবহারে ধর্মাবমাননা হয়েছে বলে মনে করেন ইসলামী চিন্তাবিদেরা। ছড়ার ক্ষেত্রে লেখকের নাম না থাকা বা সংকলিত হলে উৎস উল্লেখ না করাও দ-নীয় বলে মনে করেন আইনজীবীরা।
বইটিতে কোনো মূল্য দেওয়া না থাকায়, তা পুস্তক প্রকাশনা নীতিমালা এবং বাণিজ্য নীতি এবং আইন অনুযায়ী দ-নীয়। বইটির শেষ পৃষ্ঠায় "Export from India" বলতে কী বুঝানো হয়েছে, তাও পরিষ্কার নয়, এবং বিষয়টি বিশেষভাবে সন্দেহজনক বলে মনে করেন কাস্টমস’র এক কর্মকর্তা। বইগুলো আসলে কোথায় ছাপা হয় এবং কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এগুলো বাজারজাত করা হচ্ছে সে বিষয়ে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
বইয়ের নাম: ‘অ আ ক খ’
প্রকাশনীর নাম: হিউম্যান পাবলিকেশন্স
প্রকাশনায়:
ঠিকানা: ৪৭/১, বাংলাবাজার (২য় তলা), ঢাকা-১১০০।
ফোন: ০১৭১২ ০১৫৭৭১
বইটির এগারো নম্বর পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘য’ তে “যোদ্ধাগনের কর তারিফ”
এখানে ছবি এবং বাক্য -দুটিই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের, যারা আমাদের দেশ স্বাধীন করেছেন, তাদের আমরা তারিফ করতে পারি। কিন্তু এখানে ‘যোদ্ধা’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে, কাদের বুঝানো হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কোনো বাক্য বা ছবি আগে পিছে না থাকায় বিভ্রান্তি আরো বেড়েছে।
বইয়ের নাম: ‘আমার বর্ণমালা’
প্রকাশনীর নাম: সাজু পাবলিকেশন্স
প্রকাশনায়: মোঃ আতিকুজ্জামান
ঠিকানা: ১৪, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।
ফোন: ০১৬৭৫ ৩১৬৩৭৯, ০১৯৩ ৯৩৬০৫০৪
বইটির ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘য’ তে “যোদ্ধাগণের কর তারিফ” এখানে ছবিটি মুক্তিযুদ্ধের হলেও ‘মুক্তিযুদ্ধ’ না লিখে ‘যোদ্ধা’ লেখার কারণ স্পষ্ট নয়।
বইয়ের নাম: আদর্শ লিপি
প্রকাশনীর নাম: SHAH ALI (R.) LIBRARY
ঠিকানা: ১৬/১৭, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।
ফোন: ০১৭১০৫৬১৬৫৭, ৯৫৬৮৮২০
বইটিতে বাংলাদেশ সরকারের “সবার জন্য শিক্ষা” স্লোগান সম্বলিত লোগো ব্যবহার করা হলেও বইটি মূলত সবার জন্য হয়নি। বইটিতে ‘ঢ’ দিয়ে লেখা হয়েছে, “ঢোল দিয়ে খোকা খেলে” সেখানে ঢোল হিসেবে ড্রামের ছবি দেওয়া হয়েছে।
বইয়ের নাম: একের ভিতর পঁচিশ
প্রকাশনীর নাম: শিশু সাহিত্য সেন্টার
ঠিকানা: ১৬/১৭, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।
ফোন: ০১৭১২৬৩৭৮১৮, ৭১২০০৫৮
বইটিতে মূলত বিভিন্ন বর্ণ দিয়ে একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হয়েছে। “নামাজ পড়” “কোরআন পড়” -এটাই হয়েছে বইটির মূল ভাষ্য। বইটিতে নামাজ পড়ার কথা আছে পাঁচ বার। পঞ্চাশটি বর্ণের মধ্যে ঊনত্রিশটি বর্ণ দিয়ে ধর্মীয় বাক্য গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও যে বাক্যগুলো গঠন করা হয়েছে, তা ছবির সাথে বেমানান। যেমন, ‘ল’ তে “লড়াই হতে বিরত থাক” সেকানে ছবি দেওয়া হয়েছে মুষ্টিযুদ্ধের। ‘ক্ষ’ তে “ক্ষমা করা মহৎ কাজ” সেখানে একটি শিশুকে কান ধরে দাঁড় করানো ছবি দেওয়া হয়েছে। ং তে লেখা হয়েছে “হিংসা বিদ্বেষ দূর কর” সেখানে একটি হাস্যজ্বল শিশুর ছবি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া বইটিতে ব্যবহার করা হয়েছে সরকারের “সবার জন্য শিক্ষা” লোগোটি, বিষয়টিকে অবৈধ বলেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন সাবেক সচিব।
একই প্রকাশনীর আরেকটি বই হচ্ছে ‘শৈশবের পড়া’। নাম আলাদা হলেও বিষয়বস্তু পূর্বেরটির মতই। একই বা একই ধরনের বাক্য এবং ছবি রয়েছে এই বইটিতেও।
খোঁজ নিয়ে ‘বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড’ প্রণীত বর্ণশিক্ষার একটি বইও পাওয়া গেল। মাদ্রাসার বই হলেও এটি বরং তুলনামূলক কম ধর্মসংক্রান্ত। বইটিতে পঞ্চাশটি বর্ণের মধ্যে নয়টি বর্ণ দিয়ে ধর্মীয় বাক্য লেখা হয়েছে। বাজারে স্বাধীনভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রকাশনীর বইয়ে ধর্ম সংক্রান্ত বাক্য এর চেয়ে বেশি রয়েছে, যা উপরে বর্ণনা করা হয়েছে।
বইয়ের নাম: আদর্শ শিশু শিক্ষা
প্রকাশনীর নাম: বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ
প্রকাশকাল: জুলাই ২০১৫
কাজলা (ভাঙ্গাপ্রেস), দনিয়া, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২৩৬
মাদরাসার বই হলেও বইটি যেহেতু বাংলা বর্ণ শিক্ষার জন্য, তাই বইটিতে আরবী বর্ণমালা রাখা হয়রি, কিন্তু ব্যক্তিমালিকাধীন প্রকাশনী হতে প্রকাশিত সকল বাংলা বর্ণশিক্ষার বইয়ে আরবী বর্ণমালা রয়েছে। এমনকি ‘সীতানাথ বসাক প্রণীত’ চিরায়ত বর্ণ শিক্ষার বইটিকেও তারা যে যার মত করে সাজিয়েছে।
বইয়ের নাম: আদর্শ লিপি (সীতানাথ বসাক প্রণীত)
প্রকাশনীর নাম: সোলেমানিয়া বুক হাউস
ঠিকানা: ৩৬, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।
ফোন: ০২ ৭১১৫২৭৩, ০১৭১৫০০৪১০২
বইটির উপরে ‘আদী আসল’ লেখা থাকলেও বইটির কাভার থেকে শুরু ভেতরের বিষয়বস্তুতে সংযোজন বিয়োজন রয়েছে। যেমন, জসীম উদ্দীনের ‘মামার বাড়ি’ ছড়াটি প্রকাশক ‘সীতানাথ বসাক প্রণীত আদর্শ লিপি’ বইটিতে রেখেছেন। এক্ষেত্রে তিনি ‘¯্রষ্টার বন্দনা’ ছড়া-কবিতাটি বাদ দিয়েছেন।
সীতানাথ বসাক প্রণীক ‘আদর্শ লিপি’ বইটি ছিল অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক একটি বই। কোথাও তিনি সাম্প্রদায়িক একটি শব্দও ব্যবহার করেননি। জানা গেল, এমনকি উর্দু বর্ণমালাও তিনি রেখেছিলেন, যেহেতু ভারতবর্ষে উর্দুভাষী ছিল। তবে আরবী বর্ণমালা সীতানাথ বসাক প্রণীত আদর্শ লিপি বইয়ে থাকার কথা নয়, কারণ, যেহেত আরবী ভাষা এই অঞ্চলের ভাষা নয়। কিন্তু বর্তমান প্রকাশকেরা বইটির সাথে সীতানাথ বসাকের নাম রাখলেও বইটিকে তারা অবিকৃত রাখছেন না।
বইয়ের নাম: আদর্শ লিপি (সীতানাথ বসাক প্রণীত)
প্রকাশনীর নাম: আনন্দ পাবলিশার্স
প্রকাশক: নাম নেই
সম্পাদক: শ্রীশিবশঙ্কও চক্রবর্ত্তী
ঠিকানা: ৩৮/৪, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।
আনন্দ পাবলিশার্স এর বইটিতে বিভিন্ন সংযোজন বিয়োজন তো রয়েছেই, পাশাপাশি তিনি শেষ পৃষ্ঠায় বঙ্গববন্ধুর জীবনীও রেখেছেন কিছুটা।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত ‘আদর্শ লিপি’ বইটি বাজারে পাওয়া গেল না। তবে একটি পুরনো বইয়ের দোকান থেকে একটি কপি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত এ বইটিও অত্যন্ত ধর্ম নিরপেক্ষ একটি বই। বইটির কোথাও কোনো ধর্ম তথা সম্প্রদায়কেন্দ্রিক কোনো শব্দ রাখা হয়নি।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক ১৮৮৫ সালে রচিত ক্লাসিকের মর্যাদাপ্রাপ্ত বর্ণপরিচয় বই দুটিও বাংলাবাজারে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। একটি পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বইয়ের দুটি কপি পাওয়া গেল।
বাজারে শিশুতোষ বইয়ের চাহিদা রয়েছে, পাশাপাশি বইগুলো বিক্রী করে ভালো লাভ হয় বলে এ ধরনের বই বিক্রীতে আগ্রহ রয়েছে বিক্রেতাদের। কথা হচ্ছিল, পুরনো ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলের সামনে অবস্থিত একজন বিক্রেতার সাথে। তিনি জানালেন, বিভিন্ন কারণে বই বিক্রী কমে গেছে। গাইড বইয়ের মৌসুম শেষ হলে বিক্রেতাদের হিমশিম খেতে হয়। এমতাবস্থায় এ বইগুলোই একমাত্র ভরসা, কারণ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল অভিভাবক শিশুদের জন্য বই কিনে থাকে।
ঐ এলাকারই একটি মাদরাসায় নূরানীতে পড়ে এমন একজন শিশুর মায়ের সাথে কথা হচ্ছিল। বইগুলো দেখিয়ে ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মাদরাসায় তার সন্তানকে এ বইগুলো পড়ানো হয় কিনা। তিনি জানালেন, “এ ধরনের বই বাচ্চাকে তিনি বিভিন্ন সময়ে নিজে কিনে দিয়েছেন। মাদরাসায় নির্দিষ্ট বই পড়ানো হয়।”
আরেকজন অভিভাবক জানালেন, বই কেনার সময় তিনি বিষয়বস্তু দেখে তারপর সন্তানের জন্য বই কেনেন। তবে বর্তমানে শিশুদের জন্য ভালো বই পাওয়া যায় না বলে তিনি মত দিয়েছেন।
বাংলাজার ঘুরে শিশুদের জন্য গবেষণাধর্মী এবং শিশুদের মননশীলতার কথা মাথায় রেখে তৈরি কোনো বই পাওয়া গেল না। বাংলাদেশে প্রতিবছর ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ লক্ষ শিশু জন্মগ্রহণ করে, অর্থাৎ দেশে সব সময় এক কোটি শিশু থাকে, যাদের জন্য এ ধরনের বই প্রয়োজন হয়। দেখা গেছে, শিশুর বয়স দুই বছর হওয়ার পর থেকেই শিশুর জন্য বই কেনা শুরু হয়। স্কুলে ভর্তি করানোর আগে একটি শিশুর জন্য পরিবারভেদে দুই থেকে দশটি বই কেনা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি। পাশাপাশি নার্সারি এবং কেজি শ্রেণিতে, এমনকি প্রথম শ্রেণিতেও অনেক স্কুলে পাঠ্যতিরিক্ত বই হিসেবে এ বইগুলো পড়ানো হয়। মাথাপিছু চারটি বই ধরলেও বছরে এ ধরনের চার কোটি বইয়ের বাজার রয়েছে দেশে, যে চাহিদা মেটাচ্ছে এ ধরনের প্রকাশনীগুলো।
সব প্রকাশনীর বইয়ে একই ধরনের বাক্য (ধর্মীয় বাক্যগুলো) থাকায় অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছে যে এই বাক্যগুলো হয়ত কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে লিখে দেওয়া হয়। কোনো প্রকাশনীতে কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দেওয়া হতে পারে বলে প্রকাশনা ব্যবসার সাথে জড়িত অনেকে মত দিয়েছেন। বইয়ের বিষয়বস্তু দেখে অনেক প্রকাশক তলে তলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সাথে জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে একটি জোরালো মত হচ্ছে, দেশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো পরিচালনা করছে যারা তারাই মূলত প্রকাশকদের সাথে সমন্বয় করে বইগুলো বের করছে। বইগুলো ঐসব স্কুলে পড়ানো হচ্ছে, পাশাপাশি বাজারজাত হচ্ছে, যা অভিভাবকেরা বাসায় নন-স্কুলগোয়িং বাচ্চাকে পড়ানোর জন্য কিনছে। অন্য কেউ বাজারে টিকতে পারেছে না, কারণ, ভর্তুকি থাকার কারণে এবং সঙ্গবদ্ধতার কারণে তারাই বাজারে টিকে থাকছে। ফলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার বাসায় এই বইগুলোই পৌঁচাচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে আমার কথা হয়েছে সেন্ট গ্রেগরি এবং সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলের দ’ুজন শিক্ষকের সাথে। তারা বলেছেন, “শিশুদের বই নিয়ে যে উদ্দেশ্য, অবহেলা এবং নির্বিচারে ব্যবসায়ী মনোভাব রয়েছে, তা বন্ধ করতে হলে এদিকে সরকারের নজর থাকা যেমন প্রয়োজন, একইসাথে দক্ষ, শিক্ষিত, মননশীল মানুষের শিশুতোষ বই প্রকাশে এগিয়ে আসা দরকার। অন্যথায় বাজারে চাহিদা থাকলে কেউ না কেউ তা পূরণ করবেই।”
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১০