প্রিন্সিপাল সাহেব দেওবন্দের ভক্ত। তার কোরানের সুললিত তেলাওয়াত মাদ্রাসার সকলকেই বিমোহিত করে। আবার তিনি দর্শনেরও পোকা। দেকার্ত, হিউমের ইংলিশ ভার্সনের বইসমূহ তাকভরে সাজানো। এসব বইয়ের পুরুত্ব দেখলে গলা শুকিয়ে যায়, আর তিনি অবলীলায় সময় কাটিয়ে দিতে পারেন পড়ার টেবিলে। আমি যখনি ইসলামের কোনো বিষয়ে জানতে চাই উনি কোরান তুলে দেন। কোরানের লেখাগুলো দুর্বোধ্য, হাদিসের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই তিনি আমাকে বিভিন্ন সীরাত তুলে দেন। উনি এর আগে কিছু বই তুলে দিয়েছিলেন ইসলামী ইতিহাসের ওপর লেখা, সেগুলো পড়তে বড্ড আলসেমী আমার। কি আর করা!
তবু কিছু কিছু ব্যাপার আমাকে দ্বন্ধে ফেলে দেয়। খেলাফতের যুগে আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার অভিযানের সময় উমর রাঃ সব হাদিস সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলেন। তার বক্তব্য ছিলো, কোরানের সামগ্রীকতা বজায় রাখার জন্য হাদিস সংগ্রহ নিষিদ্ধ করেছিলেন স্বয়ং হযরত মোহাম্মদ সাঃ। নইলে মানুষ কোরানকে পাশ কাটিয়ে হাদিসে মেতে উঠবে, ফেতনার সৃষ্টি হবে। তারও আগে আবু বক্কর রাঃ সবার অজান্তে কয়েক হাজার হাদিস সংগ্রহ করেন। সেগুলো এক লহমায় পুড়িয়ে ফেলেন। খোলাফায়ে রাশেদিনের প্রথম তিন খলিফা অঘোষিতভাবেই হাদিস সংগ্রহ নিষিদ্ধ করেছিলেন। কোরানের সংকলন সমূহ পূর্ববর্তি আসমানী কিতাবের ভাগ্য বরন না করতে পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন। খোদ মহানবী সাঃ এর আদেশ তারা কিভাবে অমান্য করবেন, যেখানে তিনি নিজে হাদিস সংগ্রহকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন।
হযরত আলী রাঃ প্রথম হাদিস সংকলন করতে বাধ্য হন। তিনি দেখলেন চারিদিকে নানা ফতোয়ার উৎসব শুরু হয়েছে। একদিকে খারেজীরা তাকে তর্কবিদ্ধ করে অমুসলিম ঘোষনা করে, পুনরায় কলেমা পড়ে মুসলমান হবার ফতোয়া দেয়, আরেক দিকে মুয়াবিয়া রাঃ এর অসহযোগ অভিযানে তিনি দিশেহারা। রাস্ট্র, সমাজসহ নানা ব্যাপারে হযরত মুহাম্মদ সাঃ অনুসৃত ধারা থেকে সবাই দূরে সরে যাচ্ছিলো। শান্তি বজায় রাখতেই তিনি সংকলন শুরু করেন যার ওপর ভিত্তি করে শিয়াদের হাদিস চর্চার শুরু।
এদিকে খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়ে ইরান ইরাক সিরিয়ার অনেক সাহাবী নিজে থেকেই সংগ্রহ শুরু করলেও যা বেশীরভাগ বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেগুলো প্রকাশনার মুখ খুব কম দেখেছে বা দেখতেই পায়নি বলে তাদের অস্তিত্বগত বিশ্বাসযাগ্যতা নিয়ে সন্দিহান। তাই হাদিস সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো বড্ড সংবেদনশীল। যিনি ফতোয়া দেবেন তাকে অবশ্যই মুফতী হতে হবে।বিজ্ঞ হতে হবে। যিনি হাদিসের ব্যাখ্যা করবেন তাকে অবশ্য দাওড়া পাশ করতে হবে আবার যিনি কোরানের তাফসির বা আয়াতের ব্যাখ্যা করবেন তাকে অবশ্যই বেশ কিছু গুন অর্জন করতে হবে যার মধ্যে কোরানিক আরবির ওপর পুরোপুরি দখল থাকতে হবে। হাদিসের ওপর দাওড়া করতে হবে। ইসলামী ইতিহাসের ওপর ডিগ্রী নেয়া তথা হিকমার অধিকারী হতে হবে।
হিকমা বান্দার হাতে নয়। হিকমা ব্যাপারটা পুরোপুরি আল্লাহর হাতে। অনেক পড়ালেখা করেও কেউ হিকমা অর্জন করতে পারবে সেই গ্যারান্টি নেই, আল্লাহ কাকে হিকমা প্রদান করবেন তারও গৎবাধা নিয়ম নাই। যার কথা কাজে কর্মে জ্ঞানে ইসলামী জ্ঞান থাকবে, সমস্যা সমাধানে তওয়াক্কুল ধারন করবেন তারা এর কাছাকাছি যেতে পারে, নিদেনপক্ষে হিকমা অর্জনের যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে।
আজকাল পত্রিকা খুললেই দোররা ফতোয়ার যথেচ্ছ ব্যাবহার দেখা যায়। এমনকি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতিত মানুষ আরও অবিচারের শিকার হয়। যারা এরকম ফতোয়া দেন তারাই উলামায়ে শূ। তাদের নামের আগে থাকে হযরত, পরে থাকে দা. বা. কারো কারো রহ.। শিক্ষাগত যোগ্যতায় সকল ইসলামি ডিগ্রী ঝোলায়, এমনকি বেশভূষা পুরোপুরি আলেমের মতো, কিন্তু তারা শেয়ালের চেয়েও ধূর্ত। তারা বিভেদ সৃষ্টি করে ইসলামের নামে, নিজের ফায়দা অনুযায়ী নির্যাতন করে, বিপদে ফেলে।
এদের মাঝে হিকমা নেই, ঈমানের পরিমান শূন্য গ্লাসের চুইয়ে পড়া পানির চেয়েও কম। দিলে জাররা পরিমান খুজে পাওয়া মুস্কিল। কেয়ামতের সময় দেখা যাবে বড় বড় আলেমের পেছনে বিশাল বড় লাইন এবং তারা সবাইকে নিয়ে জাহান্নামের পথে যাচ্ছে। পুলসিরাতের পথ পর্যন্ত পাড়ি দিতে পারবেন না। এরাই হচ্ছে সেই আলেম
পত্রিকা খুললেই দেখি এসএসসি ফেল কেরানী নিজেই ক্লিনিক খুলে অপারেশন করছেন এবং তাতে রোগী মারা যাচ্ছেন। আপনি লাইসেন্স ছাড়া ডাক্তারী প্রাকটিসের অধিকার নেই এবং আইনত দন্ডনীয়। প্রতিটা পেশাজীবিকেই সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়া সে ফিল্ডে কাজ করতে পারেন না। কিন্তু ব্লগ এবং সমাজে ইসলামই একটি বিষয় যেখানে যে কেউ একটা ফতোয়া বা কোরানের আয়াত আউড়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি বা প্রভাব বজায় রাখছেন এবং ফেতনা ও জুলুমের সৃষ্টি করছেন।
কোরান, সীরাত হাদিস ফিকাহ ইজমা কিয়াসের সে বিশাল লাইন শেষ করেও যদি নিজের মধ্যে ইসলামের মূলনীতিকে ধারন করার ক্ষমতা না থাকে তাহলে মনে রাখবেন আপনি কোনো আলেম নন, আপনি একজন ফাসেক, উলামায়ে শূ।
ব্লগেও এমন মানুষের দেখা মেলে। তারা বিশাল বড় পোস্ট লেখার পর কোরানকে অপমান করে। সে বিষয়ে কথা বললে উল্টো ট্যাগ করে। হাদিসের মোহে এতটাই মশগুল থাকে, তারা হাদিসের ব্যাখ্যার জন্য ফাতলুল বারী, কুরতুবি বা তাবারীর বই গুলো পড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। যখন আপনি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ধরবেন তখন তারা আপনাকেই গালাগাল দেবে অথচ ইসলামে গালাগাল সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। কাউকে মুরতাদ বা কাফের ঘোষনা করার এখতিয়ার ইসলামে নেই (যদি না সে দালিলিকভাবে নিজের রিদ্দার ঘোষনা করে ফেৎনা ছড়ায়), অথচ তারা অবলীলায় নাস্তিক উপাধী দেয়।
কোনো কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সরাসরি গুগল করে একটা লিংক ধরিয়ে দেয়, যেনো তারা উলামায়ে গুগল। গুগল করে আপনি নিদেনপক্ষে কোনো মুফতি বা আলেমের পুরোপুরি বক্তব্য তুলে ধরতে পারেন কিন্তু তার ওপর আপনি নিজে কোনো ফতোয়া দেবার যোগ্যতা রাখেন না। কারন আপনি মুফতি নন। আপনি ঐ আলেমের বক্তব্য যিনি পড়বেন তার বিচার বুদ্ধি ও বিবেকের ওপর ছেড়ে দিতে পারেন। তার নিয়তের ওপর আপনার কোনো নিয়ন্ত্রন থাকতে পারে না। কিন্তু ব্লগে দেখি নিজের অজ্ঞতা লুকাতে ঝগড়ায় মত্ত হন। তাদের ইসলামের সামান্য প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই।
ইসলামী জ্ঞানের জন্য আপনাকে মাদ্রাসা ভর্তি হবার প্রয়োজন নেই, কিন্তু আপনাকে তখন কোনো আলেমের বাইয়াত নেয়া জরুরি। যদি বাইয়াতও নিতে না চান তাহলে নিজে কোরান শরীফ পাঠ করুন তাফসীরের সাথে। তারপর সীরাতগুলো শেষ করুন। সীরাত শেষ হলে হাদিস এবং তার ব্যাখ্যা গুলো পড়ুন। তারপরও আপনি ইসলাম সম্পর্কে জানবেন না। কারন যিনি হেফজ করেন তার পক্ষে সকল হাদিস জানা সম্ভব না। যিনি দাওড়া পাশ করেন তারপক্ষে কোরান পুরোপুরি মনে রাখা সম্ভব না। যিনি মুফতি হন তাকে তার সবগুলো মনে রাখতে হবে কারন কোনো সিদ্ধান্তে আসতে হলে এসবের ওপর পুরোপুরি দখল রাখে অবশ্য কর্তব্য। তার সাথে বিভিন্ন আলেম ওলামার মত ও তাদের দালিলিক ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করতে হবে।
আশ্চর্য্যের ব্যাপার ব্লগে যতগুলো ইসলামী পোস্ট দেখি সবই বেদায়াত সম্বলিত পথভ্রষ্ট লেখা। আমি নিজেও ইসলামের কিছুই জানি না, তাই এসব নিয়ে কথা বলতে ভয় হয় কিন্তু যখন দেখি এসব উলামায়ে শূ ময়ূরের পেখম গেথে মোল্লা মুফতির কাজ করে তখন বুঝতে পারি সুন্নিদের মধ্যে কেন এত ভাগ বিবাদ!
চারিদিকে অলিগলির ছত্রে ছত্রে হৃষ্টপুষ্ট উলামায়ে শূ দুটো লাইক কমেন্টের জন্য ইসলামকে বিকৃত করার মহোৎসবে মেতে আছে।
আল্লাহ সবাইকে সঠিক হিকমা দান করুন এবং উলামায়ের শূয়ের পথভ্রষ্টতা থেকে আমাদের রক্ষা করুন।
আমিন
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:১২