রোজকার মতো আজো টুনি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।সূর্য তখনো উঠি উঠি ভাব,কেবল একটা স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে।জামাল গান গাইতে গাইতে নিজের গামছা দিয়েই গাড়ি মোছে।এতো দামী গাড়ি ,সে কোন ভাবেই ময়লা পুরোন কাপড় ছোঁয়াতে চায় না।অন্য বসরা ড্রাইভারকে গাড়ি বাড়ি অব্দি আনতে দেয় না,কিন্তু রানা স্যারের ব্যাপার স্যাপারী আলাদা।তিনি যতোই রাতে বাসায় ফিরেন না কেন,গাড়ির চাবিটা ঠিকি জামালের হাতে দিয়ে বলেন-যা ,সক্কাল সক্কাল আসিস।জামাল ঠিকি সকাল সাতটায় তার বাড়ির সামনে হাজির হয়,কিন্তু বস বের হতে হতে ৯ টা বেজে যায়।কি আর করা ,লেখক মানুষ।রাত জেগে লিখলে কেউ কি আর অতো সকালে উঠতে পারে।গাড়ি রাখার জন্য আলাদা করে একটা ঘর করে দিয়েছেন স্যার।চোর ছ্যাচড়াদের যা উপদ্রপ।
জামাল বাড়ি না ফেরা অব্দি টুনি ঘুমায় না।প্রতিদিন জেগে জেগে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকে,আসলে সে কার্টুন দেখেনা।অপেক্ষা করে বাবার জন্য,বাবা ফিরলে তাকে হাত মুখ ধোয়ার পর গামছা এগিয়ে দেয় ,তারপর এক সাথে খায়।রাহেলা হাজার বকলেও তাতে তার কিছু যায় আসে না,পরদিন সকালে জামাল গাড়ি নিয়ে চলে যাবার পর কিছুক্ষন ঘুমিয়ে তারপর স্কুলে যায়।আজ অবশ্য তাকে আর স্কুলে যেতে হবে না।কারন,কাল ঈদ।স্কুল বন্ধ দিয়েছে প্রায় সাত দিন।সে বাবাকে প্রশ্ন করে –বাবা ,তুমি নিজের গায়ের গামসা দিয়া সাহেবের গাড়ি মুছো কেন?
জামাল হেসে উত্তর করে-বুঝলিরে ময়না,এই গাড়ি তোর বাপের চেয়েও দামী।
টুনি খুব অবাক হয়,তার এতো ভালো বাবার চাইতে বেশি দামী কি আর হতে পারে।তাই আবার বলে-কেন ,বাবা?
-এই গাড়ির জন্যেই আমরা বেঁচে আছিরে মা,তোরে ভালো স্কুলে পড়াইতে পারতেসি।
টুনি দরজা ছেড়ে গাড়িটার পাশে এসে দাঁড়ায়,তার গায়ে হাত বুলায়।চরম বিস্বয় তার চোখে মুখে।
জামাল এগিয়ে এসে মেয়েকে কোলে নেয়-আইজ তোর কি লাগবোরে মা?
-কিচ্ছু লাগবোনা বাবা।
-কি কস,দৈনিকতো একটা না একটা বায়না থাকেই।আইজ কি লাগবো?
-বাবা,আমরা কুরবানী দিমুনা? শরিফাগো বাড়িতে বড় একটা গরু আনসে।
-না মা,গরুর অনেক দাম।
-তাইলে ছোট্ট দেইখা একটা ছাগল দিবা বাবা?
জামাল হাসে,টুনির ধারনা ছোট ছোট জিনিসের ছোট ছোট দাম।টুনির কৌতুহল জাগে মুখে-
বাবা,আমারেও হাটে নিয়া যাও।আমি একটা সাদা কালো ছাগল কিনুম।তারপর হেরে কলা পাতা খাওয়ামু।
-মাইয়া মানুষ হাটে যায় নারে ময়না।
-কেন যাইবো না?
এবার টুনি কান্না শুরু করে।জামাল তাকে কোল থেকে নামিয়ে কপালে চুমু খায়-আচ্ছা,তোর না গেলেও চলবো ,আমি তোর মন মতোই ছাগল কিনা আনুম।
রাহেলার ডাকে দ্রুত সাড়া দেয় জামাল।দ্রুত গোসল শেষ করে গরম ভাত মাখতে মাখতে বলে-বউ ,আদা রসুন বাইটা রাখসোতো?
রাহেলার মুখে প্রশ্ন-কেন?আইজ আদা রসুনের খবর নিতাসোযে।গত পাঁচ বছরে একটা মুরগী জবাই দিবার পারসো তুমি?
-আহা,যা কইসি তাই কউ।না থাকলে বাইট্যা থুইও।
রাহেলা খুব আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে-তুমি সত্যই কোরবানী দিবা নাকি,মাইয়ারেযে কইলা।প্রতিবছর সাবে যা দেয় তা রানতে এতো আদা রসুন লাগেনা।
-আহা,তুমারে যা কইসি তা কইরো।
-রসুনের কেজি কতো জানো,এক পোয়া দিয়া যাইও।
-আইচ্ছা দিমুনে।কথা শেষ করতে করতে জামালের খাওয়াও শেষ হয়।সে নিজেও জানেনা কেন এতো আয়োজন করতে বলছে বউকে।ছাগলতো দূর,একটা পাখী জবাই করার মতোন পয়সা তার পকেটে নেই।
এ মাসে যা বেতন পেয়েছিল তা অনেকটাই শেষ,বসের লেখা তেমন কোন পত্রিকাতে আসে নাই,তাই এবার আর বোনাস টোনাসো পাওয়া গেল না।কোরবানী দেবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই বস বলেছে-গ্রামে অন্য ভাইদের সাথে দিবে।সুতরাং,মাংস পাওয়ার সম্ভাবনাও জিরো।কারন ,বস গ্রামে যাবে ঈদের দুই দিন পর ট্রাফিক জ্যাম কমলে।এইসব ভাবতে ভাবতেই তার গাড়ি রানা সাহেবের বাড়ির সামনে চলে আসে।
প্রতিদিনকার মতোন জামাল হর্ন দিয়ে জানান দেয়,তার উপরে উঠা নিষধ।বসের বাড়িতে ১৫ কি ১৬ বছরের কাজের মেয়ে আছে,ম্যাডাম নিষেধ করে দিয়েছে তার মুখোমুখিও না হতে।কিন্তু ম্যডাম জানেইনা ,এমন একটি মেয়ে জামালের নিজের ঘরেই আছে।অবশ্য জানলেও ম্যাডাম এই কাজটাই করতো।পরপর দু’বার হর্ন দিলে মেয়েটি বারান্দায় এসে একবার উঁকি দিয়ে ভেতরে চলে যায়।গরম যা পড়েছে তাতে জামাল ভাবে এসিটা ছেড়ে একটু ঠান্ডা হয়ে নেবে,কিন্তু গ্যাস শেষ হবার ভয়ে সে পেপার দিয়েই বাতাস খেতে থাকে।
ঘুমে চোখটা কেবল বুজে গিয়েছিল,ওমনি ম্যাডামের কন্ঠে চোমকে উঠে-কি হলো,রাতে ঘুমাও নি?ডিউটিতে এসে ঘুমাচ্ছো?
জামাল একদম ভূত দেখার মতোন লাফ দিয়ে নামে,এমন ভয় সে নিজের বসকেও করে না।লেখক মানুষ,খুবি ঠান্ডা ।কখনো চিৎকার করেও কথা বলে না,কতো লোক এই গাড়িতে করে লিফট নেয়।একদম শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা চলে যায় তবু স্যার কারো উপর বিরুক্ত হন না।কিন্তু ,এই ম্যাডাম স্কুলে বাচ্চাদের পড়ায় কিভাবে এতো রাগ নিয়ে তাই তার মাথায় ঘুরতে থাকে।সুলতানা এবার ধমক দিয়েই বলে-কি হলো,গাড়ি স্টার্ট দাও না কেন ? জামাল ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে –বস যাবে না ম্যাডাম ?
-না,সে নাকি আজ ঘুমাবে ।তাকে ডাকা যাবে না।সারা রাত কি ছাই পাশ লিখেছে।
জামাল পড়ে গেল টেনশনে।তার আশা ছিল বসের কাছ থেকে পরের মাসের বেতন থেকে কিছু ধার করে একটা বাছুর হলেও সে কিনবে।কিন্তু এখন তো সব ওলোট পালোট হয়ে গেল।এভাবে চুপ করে বসে থাকতে দেখে সুলতানার মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেল-যাচ্ছো না কেন?আমার ক্লাশ শেষ করেই শপিং -এ যেতে হবে।
শপিং –কথাটা কানে আসতেই জামালের মাথা ঝিম ধরে গেল।তার মানে আজ সারাটা দিন রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।ম্যাডামের শপিং সে জীবনে বহুবার দেখেছে,এর শুরু আছে কিন্তু শেষ যে কোথায় তা কেউ বলতে পারবে না।গাড়ি চলছে ধীর লয়ে,ম্যাডামের গলা উঁচু হতে পারে কিন্তু উঁচু লয়ে গাড়ি চালানো তার পছন্দ না।সিডিতে বাজছে রবীন্দ্র সংগীত।জামালের চোখ ঘোলা হয়ে আসছে –টুনিকে সে কথা দিয়েছে,সাদা কালো ছাগল কিনে দেবে।সে চেয়েছিল সাদা রঙের একটা বাচ্চা ছাগল কিনে নিয়ে যাবে।টুনি ভুলেও ওটা কোরবানী দিতে দেবে না।পরের বছর যদি রিষ্টপুষ্ট হয় তখন দেখা যাবে।কিন্তু, এখন সে কি নিয়ে বাড়ি ফিরবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
ম্যাডাম মার্কেটে ঢুকেছে বেলা তিনটায় ,তাহলে রাত আটটা পর্যন্ত সে এখানেই থাকবে।কারন এই এলাকায় এক সাথে চারটা মার্কেট।এর মধ্যে হাটে গিয়ে ফিরে আসা খুব কঠিন না,সাথে গাড়ি আছে।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ,টাকাটা চাইবে কি ভাবে। সুলতানাকে বড় একটা শপিং মলের সামনে নামিয়ে দিয়ে সে বসের মোবাইলে রিং দিল যদিও তাকে ডাকা আজ নিষেধ।বেশ কয়েকবার রিং হবার পর রানা সাহেব মোবাইল কানে ধরেই বললেন-এই তুই আমাকে ঘুম থেকে তুললি কেন?
জামালের কন্ঠে কান্নার সুর-বস,আইজ আপনে বাইর হবেন না,জানি নাতো।আমার মেয়েটা ওয়েট করতেসে একটা ছাগলের জন্য।আমার কাছে এক টাকাও নাই।
এই পর্যন্ত বলতেই বস তার মুখের কথা কেড়ে নেয়-এই বাজারে আমিই কোরবানীর কথা ভাবতে পারিনা ,আর তুই কিনা ১০ হাজার টাকা মাইনে পেয়ে কোরবানী দিবি ?
-না বস,কোরবানী দিমুনা।ওই সামর্থ আমার নাই।মেয়েটা বায়না ধরসে ছাগলরে কলা পাতা খাওয়াইবো,তাই বাচ্চা একটা ছাগল কিনা নিয়া যামু।তারে পাইল্যা বড় করুম।
রানার মাথায় কিছুই ঢোকে না,তার নিজের সন্তান নেই।সে বুঝতেই পারছেনা যে লোকটার কাছে মাস শেষে ভাত খাওয়ার পয়সা থাকে না ,সে মেয়ের জন্য খাসী কিনতে চায় কোন সাহসে।এ কেমন তর বায়না?
সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে-তাহলে আমারে ফোন দিসিস ক্যান,আমি কি খাসী নিয়া বইসা রইসি।
-না বস।আসলে আমার কাছে যে টাকা আছে তাতেতো ছাগল হইবোনা।আরো দশ হাজার লাগবো।আমারে আগামী মাসের বেতন থেইকা এডভান্স দিলেই হইবো।
-ওই ছাগল,তাইলে তুই আগামী মাসে চলবি কি দিয়ে?
-সমস্যা নাই বস,একটা ব্যবস্থা হইবোনে।
-মহা মুশকিলতো,তোর ম্যাডামতো সব কেচে নিয়ে গেসে,আমার পকেটেতো সিগারেট খাওয়ার পয়সাও নাই।
আমি কি করবো?
-স্যার,একটা বুদ্ধি আছে।আমি ম্যডামরে কই একটা টায়ার পুরা নষ্ট হইয়া গেসে ,টের পাইবোনা।ম্যাডামের কাছেতো টাকা আছে।
-হুম,বুদ্ধিতো ভালোই বের করসোশ।কিন্তু যদি টের পায়,তাহলে আমি কিন্তু কিছু বলতে পারবোনা।
-না ,টের পাইবো না।ম্যাডাম থাকলে এতো আসতে গাড়ি চালাই যে চাকা আছে না নাই তাই বোঝা যায় না।
-খুব চালাক হইসিশ,আচ্ছা দেখ তোর ম্যাডাম আবার কি বলে।আমারে আর ফোন দিস না কিন্তু।ছাগল কিনা হলে একটা ছবি তুলে রাখিস তোর মেয়ের সাথে।ঐযে সেলফী টেলফী কি সব করেনা ,ওই রকম।
সুলতানা সবে এক মার্কেট থেকে বের হয়েছে,ওমনি জামাল পথ আগলে দাঁড়ায়-ম্যাডাম,একটা সমস্যা।
-আবার কি হলো?
-একটা টায়ারতো পুরাই পাংচার হইয়া গেসে।
-বলো কি ,কখোন?এক্সট্রা টায়ার নাই?
-না ম্যাডাম।
-কি বলো,কেমন ড্রাইভার তুমি গাড়িতে এক্সট্রা টায়ার রাখবানা?
-সরি ম্যাডাম ভুল হইসে।
-এখন বাড়ি যাবো কিভাবে?
-আপনে কিছু ক্যাশ দেন,আর বাকী শপিং শেষ করেন।আমি যাবো আর আসবো।
-বললেই হলো,মাত্র তিনটা শাড়ি কিনেছি।অর্নামেন্টস কেনা বাকী।আর তুমি এখন চাচ্ছো টাকা?
জামাল গোবেচারার মতোন মাথা নীচু করে থাকে।মিসেস রানা পাশের বুথ থেকে টাকা তুলে এনে জামালের হাতে দেয়-এক দৌড়ে যাবা আর আসবা।আমাকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়।বাড়ি ফিরেই আবার রান্না ঘরে ঢুকতে হবে।
হাট ভর্তি কেবল গরুর মেলা ।ছাগল যা দু’চারটা আছে তা জামালের চার মাসের বেতন একত্র করলেও হবে না।প্রথমটায় সে ভেবেছিল বস সাথে থাকলে বাড়তি কিছু সুবিধা নিয়ে একটা ভালো খাশি কিনতে পারবে ,এখন মনে হচ্ছে একটা দেশি মুরগী নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।সে যখন পুরো হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিল তখোন তার কানে এলো চিকন কন্ঠ-ম্যা ম্যা ম্যা...আহারে কে যেন এই বাচ্চাটির মাকে নিয়ে গেছে।খুব মায়া হলো জামালের,সে বাচ্চা ছাগলটিকে কোলে নিয়ে দাম জানতে চাইলো-কতো ভাই ?
কসাইয়ের মতোন উত্তর বিক্রেতার-জব্বর জিনিস এক খান,গতর দেখলে মনে হয় মাংস নাই,কিন্তু শরীর ভরা টসটসে মাংস।
-এতো কথা কইয়োনা তো মিয়া,কতো রাখবা তাই কউ।
-দিয়েন,বিশ হাজার।
-এই বাচ্চার দাম বিশ হাজার,কি কউ মিয়া।এইটা কেরা কিনবো?শোনো ,আমি আট দিতাসি ,সুন্দর কইরা মুইছা দাও।আমার মাইয়া খেলবো।
বিক্রেতা খুব অবাক হয়,এমন কাস্টমার সে দেখে নি আগে,বলে-আইচ্ছা,আর দুই হাজার টাকা ধরায় দিয়েন।
জামাল রাজি হয়।বাচ্চাটিকে পানি দিয়ে মুঝতেই তার গায়ের কা্লো রঙ সড়ে গিয়ে সাদা চিনহ বেরিয়ে আসে।
জামাল অবাক হয়ে বলে –দুই নম্বরি করো মিয়া?
-কি করুম,বছরে একটাই সিজন।
দোকানীর পকেটে দশ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে ছাগলটিকে গাড়ির ডিকিতে বসায় সে।সমস্যা হচ্ছে ,ডি কি বন্ধ করলে ও তো আর নিশ্বাস নিতে পারবে না।তাই একটা চিকন কঞ্চি দিয়ে ফাঁক করে রাখে।
পুরো রাস্তা ছাগল ম্যা ম্যা করতে থাকে ,সুলতানা প্রশ্ন করে –কি হলো জামাল?ছাগলের ডাক আসলো কোথ থে্কে?
জামালের ভাবলেশ উত্তর-রাত পাইর হইলেই সকালে কোরবানী,ম্যা ম্যা শব্দতো হইবোই।
গাড়ি চলতে থাকে আরো ধীর লয়ে,পথ যেন আর শেষ হতেই চায় না।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১:২৮