কবি কাজি নজরুল ইসলামকে মূলত আমরা দেখেছি বিদ্রোহী রূপেই।তার শক্তিমান কবিতা এবং কালজয়ী গান সর্বদা বাঙ্গালীদের উদ্যোমী করে তুলেছে বিভিন্ন কর্মকান্ডে।কিন্তু এই দ্রোহের ভেতরেও যে প্রেম লুকায়িত ছিল সে ইতিহাস আমরা কয়জনই বা জানি।
নজরুলের জীবনে নারীর প্রতি প্রেম মূলত তিনবার এসেছিল । প্রথম নার্গিস আসার খানম, দ্বিতীয় তার স্ত্রী প্রমিলা দেবী এবং তৃতীয় বেগম ফজিলাতুন্নেসা। মানবপ্রেমে আকৃষ্ট হয়ে নজরুল যেমন লিখেছিলেন বিদ্রোহের কবিতা তেমনি প্রকৃতি ও নারী প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে নিজেকে সমর্পন করেছেন করুন ভাবে ।তাইতো কবি নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন এই ভাবে –
আমি কবি হতে আসিনি,
আমি নেতা হতে আসিনি ;
আমি প্রেম পেতে এসেছিলাম,
আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম।
১৯২১ সালের মার্চ কি এপ্রিল মাসে কবি নজরুলের সাথে কুমিল্লার দৌলতপুরে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় সৈয়দা আসার খানমের সঙ্গে। প্রেমের ছোঁয়ায় দুজনের মন উদ্ভাসিত হয়। ইরানি এক সাদা গুল্মপুষ্পের নামে কবি তার নাম দিলেন নার্গিস। নজরুল দৌলতপুরে বসেই ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা রচনা করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলো হলো ‘বেদনা-অভিমান’, ‘অবেলা’, ‘অনাদৃতা’, ‘পথিক প্রিয়া’, ‘বিদায় বেলা’ প্রভৃতি।
দীর্ঘ দু’মাসের আবেগঘন প্রেমের পর নার্গিসের সাথে পরিণয়ের রাতেই এক অভিমানে কবি তাকে ত্যাগ করে চলে যান। তবে কবির মানসলোকে তিনি ছিলেন দীর্ঘকাল। ১৯৩৭ সালে কলকাতার চিৎপুর থেকে কবি লিখেছিলেন, ‘তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা –এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি । আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা ! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি—তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি । তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না—আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না । তোমার যে কল্যান রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দীরের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে । অন্তরের সে আগুন- বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি ।’
মাত্র দুই মাসের প্রেম ও এক দিনের পরিণয়ের স্মৃতি নিয়ে দীর্ঘ ১৭ বছরের দুঃসহ অপেক্ষার রাত কেটেছে নার্গিসের। ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নজরুল নার্গিসকে আরো একটি চিঠি লেখেন। এর প্রায় বছর খানেক আগেই শিয়ালদহতে নার্গিস ও নজরুলের উপস্থিতিতে উভয়ের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ১৭ বছর পর ১৯৩৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিয়ে হয় নার্গিস খানমের। বিয়ের সংবাদ শুনে নজরুল ‘পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরানপ্রিয়’ গানটি লিখে পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল একটি চিরকুট, তাতে লেখা ছিল, ‘জীবনে তোমাকে পেয়ে হারালাম, তাই মরণে পাব এই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব।’
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কবির প্রেমেও যেমন অপরিসীম টান রয়েছে,অভিমানেও বুঝি অতিমাত্রায় অনুরাগ মেশানো ছিল ,তাইতো কবি নার্গিসকে অপেক্ষায় রেখেছিলেন দীর্ঘ ১৭ বছর।কেবল পাওয়ার আগ্রহটা দুমড়ে কেঁদে গেছে বুকের কোন এক গহীনে।যার সন্ধান আমাদের মতোন সাধারন কোন দিন পাবেনা।