কয়েক বছর আগে ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লীতে সরকারিভাবে একটা প্রশিক্ষণে গিয়েছিলাম। ১৪৮৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দিল্লী একটা বিশাল শহর। এ শহরের সরকারি বাস পরিবহন সংস্থার নাম ’’দিল্লী পরিবহন নিগম’’ এবং সবগুলো বাস সিএনজি চালিত। দিল্লী শহরে ৯৯৮টি রুটে বাস চলে। প্রতিটি বাসের গায়ে হিন্দী ও ইংরেজিতে লেখা আছে ’’পৃথিবীর বৃহত্তম সিএনজি চালিত বাস সার্ভিস’’। আর বাসের অবস্থা আমাদের বিআরটিসির বাসের মতোই। আমাদের প্রশিক্ষণ দাতা প্রতিষ্ঠান টাটা ইনফোটেক লি: তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আমাদেরকে দিল্লী শহরের গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করানোর পাশাপাশি আগ্রা, জয়পুর, আজমীর প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিলো। সে সব ভ্রমণের বিষয়ে লেখার অনেক কিছু আছে। আজ আমি শুধু দিল্লী শহরে সরকারি বাসে আমার ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা লিখবো।
আমাদের দলটি ছিল ৪৪ জনের এদের কেউই আমার পূর্ব পরিচিত ছিল না। তবে দু’একজনের সাথে ৪৫ দিনে ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল এবং বন্ধুত্ব এখনো আছে । এদের কয়েকজনকে দিল্লী শহরে বাস ভ্রমণে আমার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলাম কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। তাই ’যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’ কবি গুরুর আদেশ শিরোধার্য মনে করে এক ছুটির দিন শনিবার সকালে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য হুমায়ুনের সমাধি যা ’হুমায়ুন টম্ব’ নামে পরিচিত, আর নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার।
আমরা ছিলাম দিল্লী শহরের ক্যারোলবাগ এলাকায়। এলাকাটি হোটেলের এলাকা বলা যেতে এখানে থ্রি স্টার মানের কম করে হলেও শ’ পাঁচেক হোটেল আছে। আমাদেরকে যে হোটেলে রাখা হয়েছিল তার নাম ইউরেকা ক্রাউন, এর জেনারেল ম্যানেজার মানজিত সিং। মানজিত এর সাথে ভাল খাতির হয়ে গিয়েছিল। এখনো ইমেইল চালাচালি হয় তার সাথে। যাই হোক, বাস ভ্রমণের কথায় ফিরে আসি। মানজিতের কাছে জেনে নিয়েছিলাম বাস স্টপেজ কোথায় এবং কত নম্বর বাস নিজামউদ্দিন আউলিয়ায় যায় ইত্যাদি। আমাদের হোটেলের কাছেই পুষা রোড স্টপেজ। স্টপেজে প্রায় ৪৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর নিজামউদ্দিনগামী ৮৪৫ নম্বর বাস এলো। ছুটির দিন ভিড় নেই তবুও দেখলাম সবাই লাইন ধরেই বাসে উঠছে, আমিও উঠলাম। দিল্লী শহরের দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে গন্তব্যে পৌঁছে গেছি টের পেলাম না তড়িঘড়ি করে বাস থেকে নামলাম। নিজামউদ্দিন আসতে সময় লেগেছে ৫০ মিনিট। নেমেই খেয়াল হলো আমি বাস ভাড়া দেইনি, অবশ্য আমার কাছে কেউ ভাড়া চায়ওনি। একটু হেঁটে প্রথমে গেলাম নিজামউদ্দিনের আউলিয়ার মাজারে। আমাদের দেশের মাজারের পরিচিত যাবতীয় দৃশ্যই দেখলাম সেখানে। মাজার দর্শন শেষে মাজারের কাছেই অবস্থিত হুমায়ুন টম্ব এ গেলাম পায়ে হেটেই। লাল পাথরে তৈরি হুমায়ুনের সমাধির অট্টালিকা। সামনে বিস্তৃত বাগান। কিছু সময় ঘুরে বসে আবার নিজামউদ্দিন বাস স্টপেজে। আবারো বাসের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা। অপেক্ষার এক ফাঁকে লক্ষ করলাম পুটলা পুটলি কাঁধে কতগুলো লোক বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে, ঠিক আমাদের তবলিগ জামাতিদের মতো, আরো অবাক হলাম এদের বাংলা কথা শুনে। বাংলা ভাষী লোক পেয়ে কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। ভেবেছিলাম এরা বাংলাদেশী, আলাপ করে জানলাম, এরা আসামের, আর হ্যাঁ, এরা তবলিগ জামাতেরই হুজুর। এদের কাছেই জানলাম ভারতের তবলিগ জামাতের হেড কোয়ার্টার নিজামউদ্দিনের পাশেই। এবার প্রায় এক ঘন্টা পর ৮৪৫ নম্বরের দেখা মিললো। বাসে উঠে এবার লক্ষ করলাম উঠার সময় বাসের দরজার পাশে বসা একজন কন্ডাক্টরের কাছ থেকে সবাই টিকিট কিনছে, আমিও পুষা রোডের টিকিট কাটলাম পাঁচ রুপি দিয়ে, গিয়ে বসলাম একটা খালি সিটে। আবারো দিল্লী শহর দেখার পালা। এক স্টপেজ পরেই জিনসের প্যান্ট ও লাল রঙের টি শার্ট পরা ২২/২৩ বছরের এক তরুনী বাসে উঠে আমার পাশের খালি সিটটাতে বসলো। পুলকিত হলাম। আলাপের ছুতো খুঁজলাম। পাশে একটা বড় শপিং মল দেখে মেয়েটির কাছে অবশ্যই ইংরেজিতে জানতে চাইলাম এটা কী ’কোনাট প্লেস’ ? (কোনাট প্লেস দিল্লীর একটি বড় শপিং এরিয়া)। মেয়েটি কিছুটা অনিচ্ছা সত্বেও জবাব দিল ’ইয়া’। আর কোন কথা নয়। আর কী আলাপ করা যায়? প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যয়ের ’’ফুলের মূল্য’ গল্পের কথা মনে পড়লো। সেভাবে ইংরেজি কায়দায় জিজ্ঞেস করলাম ’তুমি কতদুর যাবে’? প্রশ্ন করেই বুঝতে পারলাম ভুল করেছি। মেয়েটা ভ্র“ কুঁচকে কিছুটা উষ্ণ গলায় বললো ’এটা কেন জিজ্ঞেস করছো?’। আমি ধাতস্থ হয়ে বললাম, ’দিল্লীতে আমি নতুন এসেছি যাব পুষা রোড, পুষা রোড এর অবস্থান আমি জানি না তাই জানতে চাইছিলাম।’ সে গম্ভীর কণ্ঠে বললো ’কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করো’! এমন সময় অন্য সিটে বসা রাজস্থানী পোষাক পরা একজন হিন্দীতে বললো ’তুমি অপেক্ষা করো পুষা রোড এলে আমি তোমায় জানাবো’। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা বাসের দরজার দিকে এগিয়ে গেলো একটু পর বাস থামলো, এমন সময় রাজস্থানী লোকটা বললো এটাই পুষা রোড। আমি তাড়াতাড়ি নামলাম। নেমে দেখলাম মেয়েটা খুব দ্রুত হেঁটে উল্টো দিকে চলে যাচ্ছে। আমি অবাক হলাম নিজে পুষা রোড নামবে তবুও আমাকে জানালো না! তখনই আমার উপলব্ধি হলো মেয়েটা একজন বিদেশীর গায়ে পড়ে আলাপচারিতা পছন্দ করেনি এবং যেকোন কারণেই হোক ভয় পেয়েছে, তাই পুষা রোড কোথায় জেনেও বলেনি। তা ভেবে এবার আমিও ভয় পেলাম। পুলিশ কিংবা বড় ভাই ডেকে নিয়ে এসে আমায় হেনস্থা করে কীনা ভেবে আমিও দ্রুত পা চালালাম হোটেলের দিকে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০০৯ ভোর ৫:২৫