যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতির মতোই ‘সরগরম’ হয়ে উঠেছে কূটনীতিক-মহল। বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যে কয়েকজন এতে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করলেও পেছনে রয়েছেন আরো বেশ ক’জন। বিভিন্ন ইস্যুতে এদের ‘দৌড়ঝাঁপ’ বাড়তে শুরু করেছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতিক, সুশীল সমাজের মানুষদের সঙ্গে আলোচনা-সমালোচনা ছাড়াও বিদেশি কূটনীতিকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য প্রায়ই একে অপরের বাসায় নৈশভোজে আমন্ত্রিত হচ্ছেন। এসবি এনএসআই ও ডিজিএফআই কূটনীতিকদের গতিবিধির দিকে বিশেষ নজর রাখছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কূটনীতিকদের এসব তৎপরতা সর্ম্পকিত একটি প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে জমা দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সর্ম্পকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে। সংশিশ্লষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরকারি দায়িত্বশীল একটি সূত্র এবং একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী দাবি করেছেন, কাদের মোল্লার বিচারের রায় মৃত্যুদন্ড না দিয়ে যাবৎজীবন কারাদণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপে বিচারক প্রভাবিত হয়েছে কিনা তা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত ও আগামী নির্বাচ নিয়ে কূটনীতিকদের তৎপরতার বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের কূটনীতিক-রাজনীতির মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি ‘সক্রিয়’ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা। সক্রিয় রয়েছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন। তবে ব্রিটেনের কূটনীতিকদের আপাতত এ থেকে বিরত রয়েছেন। এছাড়াও ফ্রান্স, জার্মানি ও ভারতের কূটনীতিকরাও রয়েছেন সক্রিয়তার তালিকায়। তবে ইউরোপিয় দেশগুলোর কূটনীতিকদের নিয়ে গঠিত ‘টুয়েসডে গ্রুপ’ এখন এতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়।
বিদেশি কূটনীতিকদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণকারী সরকারের একটি সংস্থার সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে নিয়েই মূলত এসব বিদেশি কূটনীতিক নানাভাবে আলোচনা করছেন। বিরোধী দল ও সিভিল সোসাইটির সদস্যরা ছাড়াও খোদ সরকারের মন্ত্রীরাও বিভিন্ন সময় কূটনীতিকদের বাসায় বা অন্য কোনো ‘গেট টুগেদার’ এর মতো স্থানে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। এসব আলোচনায় নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা, যুদ্ধাপরাধের বিচার, মানবাধিকার পরিস্থিতি, তৈরী পোশাক কারখানায় আগুনের মতো বিষয় আলোচনা উঠছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে নির্বাচনী পদ্ধতিই হয়ে উঠেছে মুখ্য বিষয়।
সূত্রটি জানায়, এখন শুধু রাষ্ট্রদূতের বাসাতেই নয়, বরং কোনো কোনো দূতাবাসের প্রথম সচিবের বাসার আমন্ত্রণেও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম সারির নেতারা সময় মতোই উপস্থিত হচ্ছেন। গুলশান ও বারিধারা এলাকায় বসবাসকারী কূটনীতিকদের বক্তব্য ও আলোচনার তথ্য সংরক্ষণ রাখেন এমন একজন দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে জানান, আগামী নির্বাচনের একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বের করতে গত বছরের মাঝামাঝিতে প্রভাবশালী দু’টি দেশের তরফ থেকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বকে এটাও বলা হয়েছিল, ২০১২ সালের মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে পুনরায় ফেরা বা সে ধরনের কোনো সরকারের ব্যবস্থা করতে সরকারকে রাজি করানো যাবে। এই বিষয়টি পর্যালোচনা করতে বিএনপির তরফ থেকে গত নভেম্বর মাসে একটি দেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় বৈঠক হয়। সেখানে ওই বিদেশি কূটনীতিককে বলে দেওয়া হয়, আশ্বাস পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা তো দেখা যাচ্ছে না! এসব বিষয় সরকারের জানার পর এবং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে লাগাতার বক্তব্য দেওয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওপর সরকারের ‘নাখোশ’ হওয়ার বিষয়টি অনেকটাই প্রকাশ্য হয়ে গেছে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত বুধবার মজিনার কঠোর সমালোচনা করেন। যদিও সমালোচনার মূল বিষয় ছিল গার্মেন্টস খাত; তবুও তিনি রাজনৈতিক বিষয়টিকেও ইঙ্গিত করেন।
কূটনীতিকদের নিজেদের মধ্যে ধারাবাহিক এসব দৌড়ঝাঁপের তথ্য জানিয়ে একটি সূত্র জানায়, গত ৯ ডিসেম্বর ইউএনডিপির কান্ট্রি ডিরেক্টর স্টিফেন প্রিজনারের গুলশানের বাসায় রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নৈশভোজে উপস্থিত হন ব্রিটিশ হাইকমিশনার, স্পেন, সুইডেন, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, জার্মান রাষ্ট্রদূত। ওই অনুষ্ঠানে মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধিত্ব করেন উপ-রাষ্ট্রদূত। এর আগের বড় আয়োজনটি হয় ২১ নভেম্বর। সেদিন বিকালে ঢাকায় ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূতের বাসায় মিলিত হন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, ইউরোপিয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতসহ ১১ রাষ্ট্রদূত। উলে¬খযোগ্য আরেকটি নৈশভোজের অনুষ্ঠান হলো রাষ্ট্রদূত মজিনার বাসায় ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরনের দাওয়াত। গত ৫ নভেম্বর বিকাল পৌঁনে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত তিনি মজিনার বাসায় অবস্থান করেন। বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে এই দুই বিদেশি কূটনীতিকের কুশল বিনিময় হলেও এই প্রথম একজনের বাসায় অন্যজন যান।
কূটনীতিক পাড়ায় গতমাসে ঘটে যাওয়া আরও একটি উল্লেখযোগ্য নৈশভোজের ঘটনা ঘটে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আওয়াল মিন্টুর বাসায়। ১৭ নভেম্বরের ওই অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে মজিনার সঙ্গে যান মার্কিন দূতাবাসের উপ রাষ্ট্রদূত জন ড্যানিলোউইজ। কূটনীতিকদের নিয়ে বিএনপির সর্বশেষ বৈঠকটি হয় চলতি মাসের ৫ তারিখে। সেদিন সন্ধ্যায় গুলশানের এক হোটেলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে রাত সাড়ে ন’টা পর্যন্ত চলে বৈঠক। বৈঠকে বিএনপির পক্ষে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর, উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও সাবিহ উদ্দিন আহমেদ অংশ নেন। এছাড়া ৫ ডিসেম্বর মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার বাসায় সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত এক নৈশভোজে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের স্ত্রী, ফজলে হাসান আবেদের মেয়ে তামারা হোসেন আবেদ, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক এমডি নূরজাহান বেগম উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গত ২৩ নভেম্বর গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় এক নৈশভোজে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আব্দুল আউয়াল মিন্টু, অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সাংবাদিক এনায়েত উল¬াহখান, পাকিস্তানের হাইকমিশনার মিয়া আফরাসিয়াব কোরেশি, ইউরোপিয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা অংশ নেন।
Click This Link