এই যৌবনজলতরঙ্গ রুধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ? কাজী নজরুল ইসলামের এই পঙিক্ত ১৯৬৯ সালে ইত্তেফাক-এর শিরোনাম করেছিলেন তখনকার বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে তিনি আলবদর ও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হন।
ওই লাইন বারবার মনে পড়ছে। আমি এক্ষুনি হেঁটে এলাম শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ বা প্রজন্ম চত্বর থেকে। তার আগে মঞ্চে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাই। আমার সামনে ওই রূপসী বাংলা পর্যন্ত মানুষ আর মানুষ। ডান দিকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন পর্যন্ত শুধু মানুষের মাথা। বাঁ দিকে কাঁটাবন। আমার সামনের তরুণ-তরুণীরা আজ চার দিন ধরে এই চত্বরে মাটি কামড়ে পড়ে আছে। তারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জায়গা ছাড়বে না।
প্রতি মুহূর্তে গগনবিদারী স্লোগান—তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, জয় বাংলা। বাঁশের লাঠি তৈরি করো, রাজাকারদের খতম করো।
আমি কি ১৯৭১ সালে ফিরে এসেছি? এই তো আমাদের খুব কাছে রেসকোর্স ময়দান, যেখান থেকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বাধীনতাসংগ্রামের। এই তো সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখান থেকে ১৪৪ ধারা ভেঙে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিল নিয়ে বেরিয়েছিল ৫২-এর তরুণেরা। সেই চত্বরে তরুণেরা ডাক দিয়েছে প্রতিবাদী সমাবেশের। তাদের কোনো দল নেই। তাদের পকেটে টাকা নেই। তারা টেলিভিশনের পরিচিত মুখ নয়, বড় নেতা নেয়, তারকা নয়। তারা কেবল ফেসবুকে, ব্লগে ডাক দিয়েছে প্রতিবাদ সমাবেশের। তারা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় মানে না, তারা চায় কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি।
কী যে টগবগ করছে এই বিশাল সমাবেশ। সবার মুখে স্লোগান—ফাঁসি চাই। অনেকের মাথায়, বুকে, হাতে জাতীয় পতাকা। শিশু কোলে এসেছেন মা, ক্রাচ নিয়ে এসেছেন বৃদ্ধ। এসেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁরা স্লোগান দিচ্ছেন—রগ কাটার রাজনীতি আইন করে বন্ধ করো। মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর বক্তৃতায় যা বললেন, আমার নিজেরও তা-ই মনে হচ্ছে, শেষ শীতের বিকেলের এই আকাশের টুকরো টুকরো সাদা মেঘের গায়ে ভর দিয়ে তাকিয়ে আছেন আমাদের ৩০ লাখ শহীদ, তাকিয়ে আছেন জাহানারা ইমাম, আজ তাঁদের মুখে হাসি। তাঁরা বলছেন, আমাদের প্রত্যাশার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ তোমরা তাহলে আবার ফিরিয়ে এনেছ। নতুন প্রজন্ম, তোমাদের ধন্যবাদ, অভিনন্দন।
মঞ্চ থেকে নেমে টিএসসির দিকে হাঁটি। মানুষের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই। সমস্ত পথ হাঁটতে গিয়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠছে। গোল হয়ে বসে ছেলেমেয়েরা স্লোগান দিচ্ছে, গান গাইছে। কেউ বা ফুল দিয়ে রাস্তায় এঁকেছে বাংলাদেশের মানচিত্র। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাকিয়ে দেখি, পুরোটা মানুষে ভরা। এরা সাধারণ দর্শনার্থী নয়, অনেকের মাথায় ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই’ লেখা পট্টি, অনেকের হাতে জাতীয় পতাকা। ট্রাক ভাড়া করে এদের আনতে হয়নি। এরা সবাই এসেছে নিজের গরজে। এ রকম স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ আমি জীবনেও দেখিনি।
১৯৫২ সালে তরুণেরা যখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন প্রবীণেরা তাতে সায় দেননি। কিন্তু তাদের আত্মদান পাকিস্তানের কবর রচনা করেছিল। ১৯৭১ সালে তরুণেরা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরেছিল স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছু মানি না বলে, তারা জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল। আর একটা প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপরিণামদর্শী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাই তো পেয়েছি স্বাধীনতা। এই তরুণ প্রজন্ম যেন ১৯৫২ আর ১৯৭১-এর উত্তরাধিকার। তারা আবার ফিরিয়ে এনেছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে। এরা কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। এদের একটাই পক্ষ—বাংলাদেশ। এদের আমি কিছুটা দেখেছি স্টেডিয়ামে, বাংলাদেশের জয়ের দিনগুলোতে। আজ যা দেখছি, এত সুন্দর বাংলাদেশ আমি আর কখনো দেখেছি কি?
তরুণেরা যখন প্রতিবাদ করে, তখনই বাংলাদেশকে সুন্দর দেখায়। তরুণ প্রজন্ম, তোমাদের সালাম।
আর নীতিনির্ধারকদের বলি, এই যৌবনজলতরঙ্গ থামানো যাবে না। বাংলাদেশের হূদয়ের কথন শুনুন। তাদের চাওয়াকে ধারণ করুন। বাস্তবায়ন করুন।
Click This Link