A book is a dream that you hold in your hand.
স্বপ্নের স্পর্শ মেলে বইয়ে... কিংবা স্বপ্নের সাহচর্যে থাকা যায়। সামান্য কিছু অক্ষরের মাধ্যমে মানব মনের এক বিস্তীর্ণ জগত লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে এতে। কী অদ্ভুত...তাইনা? গতকালকে দুটো বইয়ের রিভিউ দিয়েছিলাম... এর আগের পর্বে আরও দুটো...আজকে সেই সূত্র ধরে আরও দুটো দেবো। প্রিয় বই... প্রিয় লেখনী... প্রিয় অনুভূতিগুলো।
প্রথম বই:
বিভূতিভূষণ বন্দোপ্যাধায়…বাংলা সাহিত্যে বাস্তবধর্মি উপন্যাসের রুপকার ছিলেন যিনি। প্রকৃতি এবং বাস্তবতাকে তিনি তাঁর লেখনিতে যেভাবে উপস্থাপন করে গেছেন, খুব কম জনই তা পেরেছেন। তাঁর লেখনিতে কখনও বাবুসমাজের আভিজাত্য কিংবা জমিদারির ঐশ্বর্য স্থান পায়নি বরং তাঁর সৃষ্টিগুলোর মূল উপজীব্য বিষয় ছিল হৃতসর্বস্ব মানুষের সামাজিক চিত্র। বাবুসমাজ যেসব বিষয়ে নাক কুঁচকাতেন, বিভূতিভূষণ সেগুলোকে এক অনবদ্য দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করে গেছেন। তিনি মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা এবং তাদের ছোট ছোট মানবিক দিকগুলো তুলে ধরার পটশিল্পী ছিলেন। বিভূতিভূষণের বইগুলোতে বিভিন্ন সময়ের অর্থনৈতিক চিত্র যেমন ফুটে উঠেছে, ঠিক একইভাবে মানুষের সাথে প্রকৃতির এক অন্য ধরনের সম্পর্কও তাঁর সুবাদেই জানা সম্ভব হয়েছে। তাঁর এমনই এক বইয়ের নাম অশনি সংকেত। যে ঘটনার জন্য কেউ প্রস্তুত থাকে না কিংবা যে অবস্থার মুখোমুখি হবার জন্য মানসিকভাবে কেউ তৈরি থাকে না...অশনি তো তাই-ই। বইটাও ঠিক তাই। মানসিকভাবে আপনি অনেক কিছুর জন্যই তৈরি থাকবেন না...কিন্তু পাঠক হিসেবে তা প্রতিনিয়ত অনুভব করবেন। অশনি সংকেত বইটিতে ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে মন্বন্তরকে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ বলা হয়ে থাকে। এই মন্বন্তরে লাখ লাখ মানুষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল এবং তিন বছরব্যাপি এই দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩৮ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। অশনি সংকেত বইটিতে এর একটি বাস্তব এবং লোমহর্ষক চিত্র ফুটে উঠেছে। বইটির মুখ্য চরিত্র গঙ্গাচরণ এবং অনঙ্গ বউ। গঙ্গাচরণের মাধ্যমে লেখক যেখানে সময়বিশেষে স্বার্থপর এবং অসহায় মানুষের প্রতিচ্ছবি উপন্যাসের পুরোটা জুড়ে তুলে ধরেছেন, ঠিক তার উল্টো অনঙ্গ বউকে সৃষ্টি করেছেন অসহায়ত্বের মাঝেও সহমর্মি এবং সহানুভূতিশীলতার প্রতিমূর্তি হিসেবে। ভাতছালা থেকে গঙ্গাচরণ স্ত্রি এবং দুই ছেলেকে নিয়ে নতুনগাঁতে অন্ন সংস্থানের ভালো ব্যবস্থা করার জন্য আসে এবং পন্ডিত হিসেবে নিম্নঘরের হিন্দুদের মাঝে একছত্র আধিপত্য করে। সম্মান, আর্থিক সংস্থান সবকিছুই তার ভালোভাবে চলছিল যতদিন না দেশে যুদ্ধের প্রভাব পড়লো এবং গ্রামে খাদ্যের সংকট দেখা দিল। অনঙ্গ বউ এবং সে-ও তখন নেমে এলো অন্যান্যদের কাতারে। উপন্যাসটিতে গঙ্গাচরণের মধ্যে দিয়ে লেখক এমন এক মানুষের চিত্র এঁকেছেন যে খারাপ অবস্থায় পড়ার পরেও নিজের মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিতে পারে না এবং অনঙ্গ বউ অন্নহীনা সংসারের অন্নপুর্ণা যে নিজে উপোস করে থেকে পরের পাতে নিজের খাবার বেড়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। সেই সাথে এই একই উপন্যাসে বিশ্বাসমশায় কিংবা দুর্গা ভট্টাচার্যের মতো কিছু বুভুক্ষু মানুষও আছে যাদের জাগতিক ক্ষুধা বাড়ন্ত এবং চক্ষুলজ্জাবোধ শূন্যের কোটায় । দু মুঠো ভাতের মূল্য যে কী হতে পারে এই বইয়ে তার ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের সম্ভ্রম, মর্যাদা, মনুষ্যত্ব, সহমর্মিতা কীভাবে ক্ষুধার কাছে পরাজয় স্বীকার করে তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত অশনি সংকেত। বইটির প্রত্যেক পাতায় কিছু হতভাগ্য মানুষের জীবনগাঁথাই শুধু না, সেই সাথে এক অব্যক্ত কষ্টও লুকিয়ে আছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সেই দুর্ভিক্ষের ছবিগুলোর মতো যেখানে একটা কাককে মৃতপ্রায় এক মানুষের বুকের উপর বসে তার মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকতে কিংবা কৃশকায় মাকে তার শিশুকে নিজের খাবার দিয়ে দিতে দেখা যায়। অশনি সংকেতে এই রুঢ় বাস্তবতার কিয়দাংশ প্রতিচ্ছবি আছে যা এককথায় লোমহর্ষক। সামান্য দুই মুঠো ভাতের প্রয়োজনীয়তা মানুষের জীবনে যে কী ডেকে আনতে পারে এই বইয়ের প্রত্যেক পৃষ্ঠা তা বোঝাবে। হাহাকার, আর্তি এবং অসহায়ত্বের বর্ণনাগুলো কিছুটা হলেও পাঠক মনকে কাঁদাবে। তৎকালীন সময়ে দুর্ভিক্ষটা মানব সৃষ্ট ছিল। বাস্তবতার মতো মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার বিষয়টি বইটিতেও আছে। বইটিতে একদিকে যেমন মানুষের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা দেখতে পাবেন, তেমন কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের বিরুপ চিত্রও রয়েছে। এরই সাথে বর্ণবৈষম্যের এক গুপ্তচিত্রও প্রোথিত আছে কিছু কিছু জায়গায়। মরে যাচ্ছে মানুষ...তাকে ছোঁয়াটাও যেন পাপ...বিষয়টা সমাজের কুসংস্কারাছন্ন দিকটাতেই আলোকপাত করে। মনুষ্যত্বের থেকে কী বর্ণবৈষম্য বড়...কথাটা আরও একবার ভাবাবে অশনি সংকেত। এই বইয়ের বিশেষত্ব কী? কিংবা অজপাড়াগাঁয়ের মানুষের দুর্বিষহ জীবন পড়ে লাভটা কী? একবার ভাবুন তো, আপনার অর্থ আছে, সম্পদ আছে, কিন্তু খাদ্যের কোন সংস্থান নেই...ব্যাপারটা কেমন লাগবে? আপনার একার সামান্য রোজগারে চার-পাঁচজন ক্ষুধার্ত মানুষ তাকিয়ে আছে...একটু অনুভব করুন তো। পারছেন? বাস্তবতা কখনও কখনও কল্পনার থেকেও ভয়াবহ হয়। বিভূতিভূষণের অসাধারণ সৃষ্টি অশনি সংকেত পড়ুন...এই কথাটির দৃশ্যকল্প এমনিই দেখতে পাবেন।
বইয়ের নাম: অশনি সংকেত
লেখক: বিভূতিভূষণ বন্দোপ্যাধায়
দ্বিতীয় বই:
আত্মার আত্মীয়তা থেকেই সম্পর্ক তৈরি হয়... রক্তের সম্পর্ক থেকে আত্মীয়তা নয়। কথাটা কত সাধারণ তাইনা? অথচ, এই একটা সাধারণ কথার মাঝেই যে অসাধারণ অনেক কিছু লুকিয়ে আছে...সেটা শুধুমাত্র অনুভবের মাধ্যমেই বোঝা সম্ভব। মানব জীবন আবর্তিত হচ্ছে যে জিনিসটিকে ঘিরে...তা আর কিছু না...বরং সম্পর্ক। যে যেভাবেই দেখুক, বলুক কিংবা ভাবুক...কখনও না কখনও মানুষ কারও ছায়াতলে, কাউকে আঁকড়ে ধরে কিংবা কারও সংস্পর্শে বাঁচতে চায়। সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে কেউ বটবৃক্ষ হয়...আবার কেউ মাধবিলতা। গল্পটা এমনই কিছু সম্পর্কের যেখানে অভিমান আছে, ক্ষোভ আছে, চাপা কিছু কষ্ট আছে, সেই সাথে খুব প্রিয় কারও জন্য হাহাকারও আছে। গল্পটা...সম্পর্কের দায়েরা ভুলে গিয়ে নিঃস্বার্থভাবে কারও প্রতি গভির টানেরও। আকর্ষণের জন্য হয়ত কারণের প্রয়োজন হয়, মায়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারগুলো নিরর্থক...মায়া মানব অনুভূতির এমন একটা দিক যা ব্যাখ্যাতীত। আবেগী মন নিজের সীমারেখাটা হয়ত এভাবেই টানে...যুক্তিহীন সে, কাউকে কারণ দর্শানোর প্রয়োজন বোধ করে না। গল্পটা মায়ার.....যেখানে লিলি ,রানু, মনা মিয়া, তপু, জহিরের মতো চরিত্রগুলোর মধ্যে দিয়ে এই ব্যাখ্যাতীত জিনিসটারই কাব্যিক কোন রুপ তুলে ধরা হয়েছে। এর মাত্রা অনির্ণেয়...ছত্রে ছত্রে প্রাণের ভাবটা প্রখর। চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও কেন জানি আবেগ, অনুভূতির ব্যাপারগুলো মনের গভিরে গিয়ে লেগেছে। হ্যা আমিও তো দেখেছি এমন...কিংবা এই চরিত্রগুলোর কেউ কেউ তো আমার পরিচিত ছিল! এতে থাকা আবেগগুলো বড় বেশি বাস্তব। ভাঙা জোছনা...পূর্ণতার মাঝে শুন্যতার গল্প, ভালোবাসার মাঝে অভিমানের গল্প, অপেক্ষার প্রহরে ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাসের গল্প যার প্রতিটা অংশ খুব তীব্রভাবে অনুভব করেছি। অনুভূতিগুলোর মধ্যে কষ্টের একটা ভালো দিক আছে জানেন? কষ্ট অন্য অনেক অনুভুতিকে রাঙিয়ে তুলতে সাহায্য করে। এই বইটাতে শুধু যে কষ্ট আছে তা না...কষ্টের আবডালে এত সুন্দর কিছু ছোট বড় অনুভূতি আছে যেটা মাত্র কয়েকটা শব্দের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। আর এতে থাকা গীতগুলো...ভীষণ ভীষণ ভালো লেগেছে।
আহারে মোর চন্দ্র আলো
সেই দূরেতে ওড়ো
তুমিই আবার কেমন কইরা
গায়ের মাঝে ঝরো?
মনের সুখরে ঘর বানাইয়া
দুঃখ দিলাম ছাড়ি
সেই সুখই আজ কেমন কইরা
দিল আমায় আড়ি...
বড় বেশি অর্থপূর্ণ এর কথাগুলো...বড় বেশি তাৎপর্যপূর্ণ এর আবহ। অতিরঞ্জিত কিছু নাই, কিন্তু তারপরেও গল্পের ক্যানভাসটা শৈল্পিক। নামকরণের পেছনেও একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি... অনেকে মেঘের মাঝে হরেক রকমের অবয়ব দেখতে পায়... কেউ দেখে শুধু কুন্ডলিকৃত অংশ, কেউ বা তেড়ে আসা ঘোড়া। পার্থক্য...দৃষ্টিভঙ্গি। বইটাও ঠিক তাই...আশা- নিরাশা, ম্লান হতে থাকা স্নিগ্ধ কিছু অনুভূতির গল্পই...ভাঙা জোছনা।
কাছে আছে দেখিতে না পাও,
তুমি কাহার সন্ধানে দূরে যাও।
মনের মতো কারে খুঁজে মরো,
সে কি আছে ভুবনে--
সে তো রয়েছে মনে।
ওগো, মনের মতো সেই তো হবে,
তুমি শুভক্ষণে যাহার পানে চাও।
তোমার আপনার যে জন, দেখিলে না তারে।
তুমি যাবে কার দ্বারে।
যারে চাবে তারে পাবে না,
যে মন তোমার আছে, যাবে তাও॥
ব্যাপারটা অনেকটাই হয়ত এমন...কাছে থাকলে অনেক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় আমাদের নজরে আসে না। কিছু কিছু সম্পর্কের গুরুত্ব মানুষ দূরে চলে গেলে বোঝে কিংবা অভাববোধটা প্রখর হয়। ভাঙা জোছনা এই অভাববোধেরও গল্প। বইয়ের প্রত্যেকটি অংশ মনে থাকবে মেলাদিন...লেখকের সরল কিন্তু মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখনী মুগ্ধ এবং দগ্ধ দুটোই করেছে।
বইয়ের নাম: ভাঙ্গা জোছনা
লেখক: তানিয়া সুলতানা
বইয়ের কথা..... মনের কথা (প্রথম পর্ব)
বইয়ের কথা..... মনের কথা (দ্বিতীয় পর্ব)
**** এই লেখা সম্পূর্ণ রূপে আমার… পূর্বের কোন লেখার সাথে মিলে গেলে তা একান্তই co-incidence….no resemblance. আশা করি পোস্টটি ভালো লাগবে !!!!