“Books are a uniquely portable magic.”
স্টিফেন কিং এই ছোট কথাটির মাধ্যমে বইয়ের আসল রহস্য বলেই দিয়েছেন। বইয়ের পৃথিবী জাদুময়... কিংবা যাদুময় (যে যেটা মনে করে আর কী)!! বেশ কয়েকমাস আগে বইয়ের কথা...মনের কথা নামের একটা সিরিজ লিখতে শুরু করেছিলাম। ব্লগে ইদানিংকালে বেশ খানিকটা অনিয়মিত হয়ে পড়ায় ইচ্ছা থাকার পরেও সিরিজটাকে বেশ কয়েকমাস চালাতে পারিনি। তো যাই হোক, আবারও এই পর্বের দ্বিতীয় ভাগ দেবো আজকে।
প্রথম বই:
আমি বীরাঙ্গনা বলছি...এমন একটা বই নিয়ে যেটাকে অনেকেই হয়ত বিসিএসের বাংলার এমসিকিউ হিসেবে অন্য অনেক মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বইয়ের নামের মধ্যে শুধুমাত্র নাম কে ওয়াস্তে খেয়াল করে...পড়ার উপযোগী কোন বই হিসেবে নয়! বইটির নাম মেলা আগে দেখলেও সত্যি বলতে পড়ার সৌভাগ্য এতদিন পরে এসে হয়েছে। কিছুটা দুর্ভাগ্যই বলতে হয়; সময়ের হিসাব খুটিয়ে খুটিয়ে রাখলেও এই ক্ষেত্রে বেশ দেরি করে ফেলেছি। আমি বীরাঙ্গনা বলছি পড়তে শুরু করেছিলাম স্বাদ পরিবর্তনের অংশ হিসেবে কিন্তু পড়া শেষ করার পর এটা আমার পড়া বেস্ট বইগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। অনেকে ইতিমধ্যে হয়ত পড়েও ফেলেছেন...কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এই অসাধারণ বইটা পড়া হলো এতটা কাল গিয়ে! স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে...এই ভিত্তিক গল্প অনেকভাবে আমরা ফিকশনের মাধ্যমে জেনেছি, দেখেছি...... তাহলে অন্য কোন বই না, এটাই এত মনে ধরলো কেন? এই বই মনে ধরার অন্যতম কারণ, ড. নীলিমা ইব্রাহিমের বইয়ের চরিত্রগুলো বাস্তব, জলজ্যান্ত...সাতজন বীরাঙ্গনার হাহাকার, আক্ষেপ এবং অভিমান আছে এতে। এবার প্রশ্ন আসবে সব বাদ দিয়ে ড. নীলিমা ইব্রাহিম এই বীরাঙ্গনা নিয়েই লিখেছিলেন কেন ! বইয়ের ভূমিকাতে উল্লেখ করেছেন তিনি, ধানমন্ডির নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে বীরাঙ্গনাদের যুদ্ধ পরবর্তীকালীন অবস্থা সরেজমিনে দেখতে গিয়ে লেখিকা এমন অনেক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে তাঁর মনে ভীষণ প্রভাব ফেলেছিলো। ব্যাক্তিগতভাবে তিনি যেসব বীরাঙ্গনাদের সাথে কথা বলেছিলেন তাদের স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতার আলোকেই রচিত আমি বীরাঙ্গনা বলছি। বইটা দুই খন্ডে লিখেছিলেন তিনি যার প্রথমটা ১৯৯৪ সালে এবং দ্বিতীয়টা ১৯৯৭ সালে বেরিয়েছিল। তৃতীয় খন্ড লেখার চিন্তা করলেও শারীরিক অসুস্থতা এবং অভিমানের কারণে পরে সেটা আর সম্পূর্ণ করেননি। আমি বীরাঙ্গনা বলছি একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ যেখানে জাতির সবথেকে উপেক্ষিত অংশ বীরাঙ্গনা এবং তাদের করুণ গল্পগুলোকে নিজস্ব আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন ড. নীলিমা ইব্রাহিম। বইয়ের শুরুর দিকের কিছু অংশ তুলে দিলাম.....শব্দগুলো খেয়াল করে দেখুন অনেক চাপা অভিমান যেন ব্যক্ত করা হয়েছে।
“এ জীবনে সবকিছুর স্পর্শই আমি পেয়েছি; কখনও মৃদু কোমল স্পর্শ বা আঘাত আবার কখনো অশনি পতনের দাবদাহ। সেকথা, আমার সে অনুভূতির গভিরতাকে কখনও দ্বিতীয় ব্যাক্তির শ্রবণগোচর করবো এমন সাহস আমার ছিল না। কারণ এ সাহস প্রকাশের শিক্ষা শৈশব থেকে কখনও পেয়ে আসিনি। নামতা পড়ার মতো শুধু আউড়িয়েছি আমি মেয়ে, আমাকে সব সইতে হবে; আমি হবো ধরিত্রীর মতো সর্বংসহা। প্রতিবাদের একটিই পথ, সীতার মতো অগ্নিপরীক্ষা বা পাতাল প্রবেশ। সীতা ছিলেন দেবী। তাই ও’দুটোর কোনটারই সদ্ব্যব্যবহার আমি করতে পারি নি। যখন চারিদিকে শুধু ছিঃ ছিঃ ধ্বনি শুনেছি, সমাজপতি এবং অতি আপনজন বলেছেন, ‘মরতে পারলি না হতভাগী, আমাদের মারবার জন্য এই কালোমুখ নিয়ে ফিরে এসেছিস?’ তাদের মুখ ফুটে বলতে পারি নি, ‘না মরতে আর পারলাম কই? তার পথও তো তোমরা করে দিলে না। বাঁচাবার জন্য হাত বাড়াও নি, মরবার পথেও তো সহায়তা করো নি। না সে কথা মুখে বলতে পেরেছো, না কাজে পরিণত করবার মতো সৎসাহস সেদিন তোমাদের ছিল, আজও নেই, ভবিষ্যতের কথা ভবিতব্যই জানেন।”
তারা, মেহেরুন্নেসা, রিনা, শেফা, ময়না, ফতী পাগলী এবং আমিনার মাধ্যমে লেখিকা বীরাঙ্গনাদের সামগ্রিক অবস্থার একটা ক্ষুদ্র চিত্র তুলে ধরেছেন। বীরাঙ্গনা শুধু যেন উপাধিই ছিল না, তাদের সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের একটা নিয়ামকও ছিল। ধানমন্ডির নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে যখন তারা ছিল, তাদের মধ্যে অনেকেরই পরিবার তাদের সাথে দেখা করতে আসত কিন্তু তাদেরকে কখনও নিজেদের সাথে নিয়ে যাবার কথা বলত না কিংবা নিয়ে যেত না। অনেকের তো পরিবার তাদের বলেই দিয়েছিল যেন তারা যোগাযোগ না করে। কারও কারও সংসার সারা জীবনের মতো ভেঙে গেছিলো। মনে মনে একটু প্রেক্ষাপটটা কল্পনা করুন তো....অনুভব করতে পারছেন? দুঃখের কথা তো এটাই...আমরা তাদেরকে অনুভব করতে পারি না। বুক ফুলিয়ে আমরা বলতে পছন্দ করি আমি রক্ষা করব, আমি পাশে থাকব...কিন্তু কাজের সময় আমরা নিরব দর্শক কিংবা কাপুরুষ হয়ে যায়। সম্ভ্রমও হারিয়েছে তারা, সমাজের কাছে লজ্জার বিষয়ও হয়েছে তারাই। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী...এর অর্থ হলো জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গ অপেক্ষা পবিত্র। আমরা জন্মভূমিকে রক্ষা করতে পারলেও জননীকে পারিনি এবং প্রাপ্য সম্মানের জায়গায় ‘কলঙ্কিনী’ অ্যাখ্যায়িত করেছি। বিশ্বকবি হয়ত আক্ষেপের সুরে ভবিতব্যের কথা আগেই বলে গেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি।’ বইটাতে এমন কিছু প্রশ্ন আছে যার উত্তর কেউ দিতে পারবে না, উত্তর দেয়া হয়ত সম্ভবও না। সামাজিক প্রেক্ষাপটেই বলি বীরদেরকে মানুষ যেভাবে সদর্পে গ্রহণ করে, বীরাঙ্গনাদের কথা মানুষ উল্লেখ করতে যেন কুণ্ঠাবোধ করে। বীরাঙ্গনারা যেন সমাজের লজ্জা, কলঙ্ক কিংবা জাদুঘরে রাখার মতো বিষয়। ‘ও... বীরাঙ্গনা.....এখনও বেঁচে আছে’...ভ্রু কুঁচকে দেখে অনেকেই, শ্রদ্ধার চোখে নয়! যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই সম্মানের সাথে সামনে আসলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। আমরা হলাম বিবেকমান জাতি আর এটা আমাদের বিবেকের দৃষ্টান্ত...বীরাঙ্গনারা নষ্টা, পাপিষ্ঠা...তাদের কথা উল্লেখ করাও পাপ! তারা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শত্রু শিবিরে অত্যাচারিত, নির্যাতিত হয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে সমাজ সংসারের হাতে তারা বারবার নিহত হয়েছেন। তাদের বেঁচে থাকাটাই যেন অখন্ডনীয় পাপ। গল্পটা সেসব মানুষেরই...যাদের সত্ত্বাকে উপেক্ষা করে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। বইয়ে উল্লেখকৃত আক্ষেপের কিছু দৃষ্টান্ত দেখুন-
“আমি নিজে সচেতন ও দৃঢ় বিশ্বাসী যে আমি একজন বীরাঙ্গনা। আমার রাষ্ট্র আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমার পিতামাতা হাত বাড়িয়ে আমাকে বুকে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমাজের জুলুমবাজির ভয়ে আমি তাদের ঘরে যেতে পারি নি। তবে আপনারা বিশ্বাস করতে পারেন আপনাদের দৃষ্টিতে আমি বীরাঙ্গনা না হলেও নিঃসন্দেহে বারাঙ্গনা নই।”
বুদ্ধি হবার পর থেকে খুব সামান্যই বই পড়া হয়েছে। সেসবের মধ্যে কিছু কিছু বই মুগ্ধ করেছে, কিছু কিছু বই স্বপ্ন দেখিয়েছে, আবার কিছু বই চরম বিরক্তও করেছে। কিন্তু...এই প্রথম কোন বই মনের গভিরে গিয়ে বিঁধেছে। কষ্ট লেগেছে...তারপরেও আচ্ছন্নের মতো পড়েছি। বেশিক্ষণ পড়তে গেলে নিজের অজান্তেই ফুঁপিয়েছি। তারপরেও আমি বীরাঙ্গনা বলছি’র আবহ থেকে মুক্ত হতে পারিনি।
বইয়ের নাম: আমি বীরাঙ্গনা বলছি
লেখক: নীলিমা ইব্রাহিম
দ্বিতীয় বই:
কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট !
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
হেলাল হাফিজের ফেরিওলা দিয়ে শুরু করলাম কেন, তাইতো? লাল কষ্ট, নীল কষ্ট, কাঁচা হলুদ রঙের কষ্টের সাথে আজকে নতুন একটা কষ্ট যোগ হয়েছে। এই কষ্ট শঙ্খরঙা। হয়ত বলবেন, আবেগ অনুভূতির আবার রং হয় নাকি। উত্তর...হ্যা হয়। এই যেমন ক্রোধের রং লাল, চনমনে ভাবের রং সবুজ, বিষণ্ণতার রং ধূসর...ঠিক তেমন কষ্টগুলো শঙ্খরঙা। শঙ্খ স্নিগ্ধতার প্রতীক, বিষাদের রংটাও নাহয় নীল শঙ্খের মতো হোক। রুপকধর্মী নামটার আড়ালে গভির কিছু লুকিয়ে রেখেছেন লেখক...যা পড়ার পরেই শুধুমাত্র বোঝা যায়। শুধু হাহাকার কিংবা শুধু বিষাদ নয়...শঙ্খরঙা জল ছোট্ট ছোট্ট বিশুদ্ধ অনুভূতিরও গল্প। বইয়ের একটা লাইন ধরেই বলি,“ মানুষ শব্দে অভ্যস্ত ‘নীরবতায়’ নয়।অথচ নৈশব্দেও কত কথা থাকে, তা যদি লোকে উপলদ্ধি করত।” সকল অনুভূতি প্রকাশের জন্য শব্দের প্রয়োজন পড়ে না, নিস্তব্ধতা বাকিটুকু বলেই ফেলে...বিষাদ এখানে প্রকট, সুখানুভূতি প্রচ্ছন্ন। বিষাদের আড়ালে লুকিয়ে থাকা টিমটিমে সুখানুভূতিটাও কিন্তু শঙ্খরঙা জল। সাধারণত মূল চরিত্রকে লেখকরা একটু গ্ল্যামারাস কিংবা ভাবগম্ভির দেখাতে ভালোবাসে...কোমল কিংবা কুমু একেবারেই সাদামাটা যার কায়িক কিংবা মুখশ্রীর বর্ণনা হয়ত সেভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনে থাকবে না বঙ্কিমের সেই কুন্দের ‘অনিন্দিতগৌরকান্তিস্নিগ্ধজ্যোতির্ময়রূপিণীর’ মতো কিন্তু অন্তঃস্থলে সে নিজের জায়গা করে নিয়েছে তার অনুভূতিগুলো গিয়ে। কুমু বিশেষ নিজস্ব আঙ্গিকে...তার ভাবগুলো বিশেষায়িত। একাকীত্বে নিজের সাথে কথা বলাই হোক কিংবা বিভিন্ন সম্পর্কের প্রতি তার আকুলতার মাধ্যমেই হোক...কুমু এক অজানা ভালোলাগা নিয়ে অন্তর্ধানপটে থেকে যাবে মেলাদিন। প্রকৃতির সাথে সাথে সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম মানব অনুভূতিগুলোর বর্ণনা ভালো লেগেছে ভীষণ। কনক্রিটময় পরিপার্শ্বে প্রথম বৃষ্টির গন্ধ কিংবা সোঁদা মাটির গন্ধের মতো শঙ্খরঙা জলটাও এক অন্য ধরনের অনুভূতি এনে দিয়েছে...এখনও পুরোপুরি যান্ত্রিক হয়নি সবকিছু, অনুভূতিগুলো জাদুঘরে যায়নি। ভালো লেগেছে...ভীষণ ভীষণ ভালো লেগেছে...এই বিষয়টা স্মরণ করানোর জন্য। গল্প বলার কায়দা অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে... মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো কেউ গল্প শোনাচ্ছে...আমি পড়ছি না। গল্প কথকের সাথে কঙ্কনাগরের পথে হেঁটেছি আমিও কিংবা নীল-সাগরির তীরে। আরেকটা বিষয় খুব খুব ভালো লেগেছে...কুমুর গুনগুন করে আওড়ে যাওয়া শব্দরুপ অনুভূতিগুলো—
ওগো আমার একলা আকাশ
চান্নিপসর গাড়ি
একটু আলো দিয়া যাইও
আইসা আমার বাড়ি...
বাড়ি তো নয় বাবুই বাসা
খড়কুটোতে গড়ি
শঙ্খরঙের নদী আছে
নাম নীল-সাগরি।
ওগো আমার দুঃখ বাতাস
ডুমুর পাতার কথা
ভাসাই নিও তোমার লগে
মনের যত ব্যাথা।
একবাক্যে সোজা কথা...শঙ্খরঙা জল আমাকে মুগ্ধ করেছে।
বইয়ের নাম: শঙ্খরঙা জল
লেখক: তানিয়া সুলতানা
বইয়ের কথা..... মনের কথা (প্রথম পর্ব)
**** এই লেখা সম্পূর্ণ রূপে আমার… পূর্বের কোন লেখার সাথে মিলে গেলে তা একান্তই co-incidence….no resemblance. আশা করি পোস্টটি ভালো লাগবে !!!!