“I try to capture reality, nothing else.” --- Roberto Rossellini
জন্ম হোক যথা তথা.... কর্ম হোক ভাল! কথাটির মাধ্যমে মানুষের সামগ্রিক অবস্থা যেন বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। জন্ম যেখানে, যে পরিবেশেই হোক না কেন....একজন মানুষের সাথে অন্য মানুষের পার্থক্য নিরূপণ করে তার কর্ম। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা মৃত্যুর পরেও নিজেদের কর্মের মধ্যে দিয়ে আরও কয়েক দশক এমনিই বেঁচে থাকবেন। ঠিক এমনই মানুষ ছিলেন, রবার্তো রোজেলিনি। আজকে সেই বিখ্যাত মানুষটির জীবনকালের অংশগুলো নিয়েই আলোচনা করব।
ইতালিয়ান নিওরিয়্যালিজমের জনক রবার্তো রোজেলিনির জন্ম হয়েছিল রোমে। সংরক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেয়া এই মানুষটির পিতা অ্যাঞ্জিলো গিউসিপ্পে বেপ্পিন্নো রোজেলিনি কন্সট্রাকশন ফার্মের মালিক ছিলেন এবং মা এলেট্রা গৃহিণী। রোজেলিনির বাবা, রোমে প্রথম থিয়েটার বানিয়েছিল যার নাম ছিল “বারবেনি” যেখানে সিনেমা দেখানো হতো এবং এভাবেই অনেক কম বয়সেই সিনেমা জগতে দর্শক হিসেবে পদচারণা ঘটেছিল রবার্তোর। তাঁর বাবা এবং এই থিয়েটারের মাধ্যমেই মুভি ইন্ডাস্ট্রির অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিল রোজেলিনির। ১৯৩২ সালে বাবার মৃত্যুর পরে রোজেলিনি এ সকল পরিচিত মানুষের মাধ্যমেই মাত্র ২৬ বছর বয়সে রুপালী পৃথিবীকে নিজের জীবিকার জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ফিল্মে সাউন্ডমেকার হিসেবেই কাজ করতে শুরু করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন রবার্তো এবং বাস্তব কোন ইফেক্ট সৃষ্টির অংশ হিসেবেই ব্যবহার করতেন সেগুলোকে। ১৯৭৩ সালে এক সাক্ষাতকারে নিজের পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “যেমন ধরুন, মুচড়ে থাকা খবরের কাগজ দিয়ে দরজায় বাড়ি দিলে যে সাগরের ইফেক্ট খুব সুন্দরভাবে তৈরি হয়, সে বিষয়টি একদিন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করেছিলাম আমি।” একে একে তিনি সেসব কাজ নিজস্ব দক্ষতায় শিখে গিয়েছিলেন যা একটি সিনেমা তৈরিতে প্রয়োজন হয় যেমন স্ক্রিন এডিটিং, ডাবিং এবং সেট ডিজাইনিং। এসব সঞ্চয়কৃত অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৩৭ সালে, রোজেলিনি নিজের প্রথম ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিলেন যার নাম ছিল ‘প্রিলুড অ্যা ল্যাপ্রিস মিডি ডান ফন’ যা প্রাণীদের উপরে নির্মিত ছিল। পরে এক সাক্ষাতকারে এই ব্যাপারে বলেছিলেন তিনি, “আমি ডকুমেন্টারি বানাতে ভীষণভাবে ভালবাসতাম। সবসময়েই ডকুমেন্টারি তৈরি করার জন্য একটা ঝোঁক কাজ করত আমার, তবে তা মোটেও ভাসাভাসা ভাবে নয় বরং গবেষণা হিসেবে”। এরপরে আরও দুইটি ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন তিনি, ‘ইল রাসসেল্লো ডি রিপাসোট্টিলে’ এবং ‘ফ্যান্টাস্টিয়া সট্টোমারিনা’। এরপর, গফ্রেডো অ্যালেসান্ড্রিনির সহযোগী হিসেবে ডাক পড়েছিল তাঁর ‘লুসিয়ানো সেরা পাইলটা’ তৈরির জন্য, বিশ শতাব্দির অর্ধেক সময় পর্যন্ত যা ইতালির সবথেকে ব্যবসাসফল সিনেমা ছিল। ১৯৪০ সালে, ফ্রান্সেস্কো ডি রবার্তিসের ‘ইউমিনি সাল ফন্ড’ সিনেমাতে সহযোগী হিসেবে ডাক পেয়েছিলেন তিনি। কিছু কিছু লেখক, তাঁর জীবনের প্রথম অংশকে ট্রিলজির সিক্যুয়েন্স হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করে থাকে। তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম, ‘লা ন্যাভি বিয়াঙ্কা (১৯৪১)’ রোজেলিনির ফ্যাসিস্ট ট্রিলজির প্রথম সিনেমা, যার পরের দুই অংশ যথাক্রমে ‘উন পাইলটা রিটর্না (১৯৪২)’ এবং ‘উমো ডাল্লা ক্রসি (১৯৪৩)’। এই সময় থেকেই তাঁর সাথে ফ্রেডেরিকো ফেল্লিনি এবং অ্যালডো ফ্যাবরিজির সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ১৯৪৩ সালে ফ্যাসিস্টদের শাসনামলের অবসান ঘটলে রোজেলিনি নিজের অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ফিল্ম “রোমা সিট্টা আপার্তা (রোম, ওপেন সিটি ১৯৪৫)” তৈরির কাজ সম্পন্ন করেন। ফেল্লিনি তাকে স্ক্রিপ্ট লেখার কাজে সাহায্য করেছিলেন যেখানে ফ্যাব্রিজি প্রিস্টের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। তুমুল জনপ্রিয়তা পাবার পর রোজেলিনি নিওরিয়্যালিস্টিক ট্রিলজির দ্বিতীয় সিনেমা ‘পাইসা (১৯৪৬)’ কাজ শুরু করেছিলেন যাতে কিছু অপেশাদার অভিনেতা অভিনয় করেছিল এবং এর তৃতীয় ভাগের নাম ছিল ‘জার্মানিয়া আন্নো জিরো (১৯৪৮)’। নিওরিয়্যালিস্টিক ট্রিলজি তৈরির পরে, রোজেলিনি দুইটি সিনেমা তৈরি করেছিলেন এখনকার ভাষাতে যাকে “ট্রানজিশনাল ফিল্ম” বলা হয়ে থাকে, ‘ এল’আমোরে (১৯৪৮)’ এবং ‘লা ম্যাসিন্না আম্মাজ্জাক্টিভি (১৯৫২)” যেখানে বাস্তব এবং সত্য কিছু ঘটনাকে আগের সিনেমাগুলোর তুলনায় কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। এ বাদে আরও বেশ কিছু সিনেমা নির্মাণের পর, কিংবদন্তী এই পরিচালক ১৯৭৭ সালে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন।
রোজেলিনি এবং দ্য ফ্যাসিস্ট ট্রিলজি:
ডি রবার্টিসের সাথে কাজ করার পর থেকে রোজেলিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন তিনি এবং মুসোলিনির ছেলের সাথে তাঁর ভালো সখ্যতা থাকাতে বিষয়টাতে কিছুটা সুবিধাও পেয়েছিল। অবশেষে ১৯৪১ সালে তিনি প্রথম সুযোগটি পেয়ে যান। সেন্ট্রো সিনেমাটোগ্রাফিও ডেল মিনিস্টেরো ডেল্লা ম্যারিনা ইটালিয়ান নৌবাহিনীর উপরে সিনেমা বানানোর জন্য অর্থের যোগান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ডি রবার্টিস রোজেলিনিকে সেই সময় পরিচালক হিসেবে সুপারিশ করে। অবশেষে এভাবেই তৈরি হয়েছিল ‘লা ন্যাভি বিয়াঙ্কা (দ্য হোয়াইট শিপ, ১৯৪১)’। ফিকশনাল এই ডকুমেন্টারি যুদ্ধে নৌবাহিনীর ভূমিকা উপস্থাপনের জন্য এবং যেসব নৌবাহিনীর সদস্য নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশকে প্রতিদিনের জন্য রক্ষা করে গেছে তাদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘস্বরূপ ছিল। লা ন্যাভি বিয়াঙ্কাকে ইতালির অন্যতম ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল মোস্ট্রা ডি ভেনেজিয়ার নবম আসরে দেখানো হয়েছিল যেখানে তা ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির তরফ থেকে পুরস্কার জিতে নেয়। এই পুরস্কারের মাধ্যমে রোজেলিনি তাঁর দ্বিতীয় সিনেমাটি তৈরি করার যথেষ্ট সুযোগও পেয়ে গিয়েছিল। ফ্যাসিস্ট ট্রিলজির দ্বিতীয় সিনেমা, ‘উন পাইলটা রিটর্না (এ পাইলট রিটার্নস, ১৯৪২)’ তৈরি হয়েছিল এয়ার ফোর্সের অর্থায়নে এবং প্রথম ফিল্মের মতোই এতে দেশমাতৃকার জন্য পাইলটদের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছিল। যদিও এই পর্যায়ে সেন্সরশিপ বোর্ডের সাথে রোজেলিনি র কিছুটা মতভেদ তৈরি হয়েছিল, যুদ্ধের কিছু অংশকে অযাচিতভাবে অলঙ্কৃত করতে অস্বীকার করেছিলেন তিনি। এই কারণে কিছুটা সমালোচিত হয় সিনেমাটি এবং তাকে সেই সিনেমার সংলাপ আবারও নতুনভাবে প্রথম কপির আদলে লিখতে বলা হয়েছিল। রোজেলিনি ফ্যাসিস্ট ট্রিলজির তৃতীয় সিনেমা “উমো ডাল্লা ক্রসি (ম্যান অফ দ্য ক্রস, ১৯৪৩)” তৈরি করেছিলেন সশস্ত্রবাহিনীর কোন সাহায্য কিংবা অর্থায়ন ছাড়ায়। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে সিনেমার শ্যুটিং শুরু হয়েছিল যখন ইতালিয়ান সৈন্যদের অপরিমিত অস্ত্র, যন্ত্রপাতি, খাদ্য এবং বস্ত্র দিয়ে রাশিয়ান ফ্রন্ট থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। সিনেমার ফোকাস পয়েন্ট ছিল রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে ইতালিয়ানদের বিজয় যেখানে বাস্তবে তারা পরাজিত হয়ে এবং কিছু সৈন্য হারিয়ে দেশে ফিরেছিল। সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল তখন যখন মিত্রশক্তির সৈন্যরা সিসিলি দখল করে নিয়েছিল এবং দখলদারিত্ব নেবার এক মাসের মাথাতে সিনেমাটি থিয়েটার থেকে সরেও গিয়েছিল।
রোজেলিনি এবং দ্য নিওরিয়্যালিস্ট ট্রিলজি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে যখন পারিপার্শ্বিক পরিবেশে মানুষের আর্ত চিৎকার এবং শত্রুপক্ষের বোমা পতনের শব্দ পাওয়া যেত, সেই সময় ইতালিতে অপরাধ এবং সামাজিক নৈরাজ্য আধিপত্য বিস্তার করেছিল। সমাজকে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে এবং দমনাত্মক শাসনাবস্থা উপেক্ষা করেই ফিল্মমেকাররা সেসময় পুনর্জন্ম নেয়া ইতালিয়ান সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টায় রাস্তায় নেমে পড়েছিল। কঠোর বাস্তব ঘটনাগুলোতে অনুপ্রাণিত হয়ে ফিল্মমেকাররা এগুলোকে তাদের ক্যামেরাতে ধারণ করে ফিল্মমেকিং এর দুনিয়ায় নতুন এক স্টাইলের সূচনা করেছিল, যা নিওরিয়্যালিজম নামে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। ফ্রেঞ্চ ফিল্ম তত্ত্ববিদ এবং সমালোচকের মতে, নিওরিয়্যালিজম সত্য, বাস্তব, অকৃত্রিম এবং বেশ কিছুটা ব্যাপ্তিকালের সিনেমারই নামান্তর। ইতালিয়ান সিনেমাতে এই নিওরিয়্যালিজমের ঘটনার সূত্রপাত ঘটে তখন, যখন ফ্যাসিস্টদের শাসন মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ইতিপূর্বে ফিল্মমেকারদের স্বাধীনভাবে নিজেদের শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা প্রায় বিশ বছর অবধি ছিল। দমনাত্মক ফ্যাসিস্ট যুগের পরিসমাপ্তির মাধ্যমেই ইতালিয়ান নিওরিয়্যালিজমের পথ চলাটা শুরু হয়েছিল। নিওরিয়্যালিজম সিনেমাগুলো তারা তৈরি করত অপেশাদার কলাকুশলীদের নিয়ে, যেখানে স্থানীয় ভাষা ব্যবহৃত হতো এবং মূলত তৎকালীন সময়ে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার দিক ফুটিয়ে তোলা হতো। অকৃত্রিম উপস্থাপন ভঙ্গিতে সামাজিক বার্তা প্রদানের মাধ্যম ছিল এই নিওরিয়্যালিস্টিক সিনেমা। ১৯৪৫ সালের দিকে, সেই নিওরিয়্যালিজমের পথ ধরেই সিনেমা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের জন্ম হয়েছিল, রাতারাতি যে “নিওরিয়্যালিজমের জনক” হিসেবে অ্যাখ্যাও পেয়ে যায়। যুদ্ধ শেষের পর মুসোলিনির দমনাত্মক শাসনকালের অস্তমিত পর্যায়ে, রোজেলিনি নিজের কাজের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা লাভ করেছিলেন যা আগে কখনো পেয়েছিলেন না তিনি। ফ্যাসিস্টদের বিশ বছরের শাসনামলের পর অলঙ্করণ নির্ভর সিনেমা বানানো থেকে মুক্তি লাভ করে নৈতিকতা নির্ভর সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। রোমের স্বাধীনতা লাভের দুই মাস পরে, একটি সিনেমা বানানোর কাজে হাত লাগায় সে যা তাঁর ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ সাফল্যমন্ডিত সিনেমাতে পরিণত হয়েছিল পরবর্তীতে এবং ‘রোমা সিট্টা অ্যাপার্তা (রোম ওপেন সিটি, ১৯৪৫)’ নাম ছিল তার। কোন প্রযোজক না পাওয়ায় নিজের বাড়ির আসবাব বিক্রি করে, কিছু ঋণ নিয়ে এবং বন্ধু-বান্ধবের সহায়তায় তিনি প্রায় সাত-আট মিলিয়ন লিরা যোগাড় করে ফেলেছিলেন। প্রডাকশন কস্ট কমানোর লক্ষ্যে এবং কয়েকশো লিরা বাঁচানোর অংশ হিসেবে তিনি পোস্ট-সিনক্রোনাইজেশন সাউন্ডের কাজ করে সেটিকে সাইলেন্ট ফিল্মে রুপান্তর করেছিলেন। সারা বিশ্বের বক্স অফিসে তুমুল সাড়া ফেলেছিল তাঁর এই সৃষ্টি এবং সমালোচক ও ফিল্মবোদ্ধাদের কাছ থেকে অনেক সুখ্যাতি কুড়িয়েছিল। এবং এভাবেই রোজেলিনি র হাত ধরে সিনেমাজগতের বিপ্লবও এসেছিল। নিওরিয়্যালিস্ট ট্রিলজির দ্বিতীয় সিনেমা, ‘পাইসা (পাইসা, ১৯৪৬)’ সিনেমার বিপ্লবের পথে অন্যতম অংশ ছিল। তিনি তাঁর ক্যামেরাম্যানকে সরগরম নগরীর মূল রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিতো এবং তাঁর অভিনেতা বাহিনীকে পছন্দ করতো সাধারণ মুখগুলোর মধ্যে থেকে যারা আগ্রহী দর্শক হিসেবে সিনেমার কাজ দেখার জন্য এগিয়ে আসত। আমেরিকান প্রযোজক রড গেইজার তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাঁর স্ক্রিপ্টে সে বিখ্যাত অভিনেতা গ্রেগরি পেক এবং অভিনেত্রী লানা টার্নারকে দিয়ে অভিনয় করাবে। কিন্তু তাঁর বদলে সে যখন কিছু থিয়েটার অভিনেতাদের নিয়ে আসে রোজেলিনি নিরাশ হয়েছিল তাতে। যেহেতু সিনেমাটির মূল থিম ছিল দুইটি ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতাবোধ, তাই যখন তিনি তাঁর অভিনেতাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধের ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলেন, একমাত্র তখনই স্ক্রিপ্ট চূড়ান্ত হয়েছিল। নিওরিয়্যালিস্ট ট্রিলজির তৃতীয় এবং শেষ সিনেমা “জার্মানিয়া আন্নো জিরো (জার্মানি ইয়ার জিরো, ১৯৪৭)” একটি ট্রাজিক ঘটনা নির্ভর ছিল। ১৯৪৬ সালে তাঁর পুত্র মার্কো রোমানোর মৃত্যুর পরে তিনি সেটিকে বানিয়েছিলেন কষ্ট, জুলুম এবং দুঃখবোধের আলোকে। তাঁর পুত্রের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে জীবনের গুরুত্বের বিষয়টি অন্যভাবে উপলদ্ধি করেছিলেন তিনি। ফ্রেঞ্চ প্রডাকশন হাউজের অর্থায়নে সিনেমাটি তৈরি হয়েছিল, যার শ্যুটিং হয়েছিল বার্লিন সেক্টরে। তাঁর আগের সিনেমাগুলোর মতো, রোজেলিনি প্রথমে তাঁর অভিনেতাদের বার্লিনের রাস্তাতেই খুঁজে পেতে চেয়েছিল। টাউন স্কোয়ারে তিনি তাঁর ক্যামেরাম্যানকে এই কারণে বসিয়েও রাখতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে উৎসুক বা অনুসন্ধিৎসু সেরকম কোন মানুষ এগিয়ে না আসায় রোজেলিনি সফল হয়েছিল না। মানুষের খাদ্য অন্বেষণের বিষয়টি সেই সময় ফিল্মমেকিং দেখার আগ্রহের থেকে বেশি প্রকট ছিল। অবশেষে, লোকাল সার্কাসে তিনি তাঁর সিনেমার মূল চরিত্র এডমন্ডকে পেয়েছিল যেখানে তাঁর বাবা-মা ঘোড়সওয়ার ছিল। এডমন্ডের বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছিল যে সে আগের বছরগুলোতে কিছু নির্বাক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিল, যাকে রোজেলিনি আবিষ্কার করেছিল এক পাবলিক হাসপাতালে। সিনেমাতে তাঁর ভাইয়ের চরিত্রে যে অভিনয় করেছিল, সে এক ইউনিভার্সিটির সম্মানজনক পরিবার থেকে এসেছিল এবং বাস্তবজীবনেও যুদ্ধের সময় গেস্টাপোদের কাছে বন্দি ছিল! এডমন্ডের বোনের চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রীকে রোজেলিনি আবিষ্কার করে ব্রেড লাইনে, যেখানে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়েছিল সে...প্রাক্তন ব্যালেরিনা ছিল সে, যার মুখশ্রীর হতাশাভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল রোজেলিনি এবং এভাবেই তৈরি হয়েছিল তাঁর নিওরিয়্যালিস্ট ট্রিলজির সর্বশেষ কিস্তি...‘ জার্মানিয়া আন্নো জিরো’।
রোজেলিনি এবং তাঁর ট্রানজিশনাল ফিল্ম:
নিওরিয়্যালিস্ট ট্রিলজির পরে রোজেলিনি বাস্তবতাকে তুলে ধরার জন্য আরও কিছু মৌলিক এবং উদ্ভাবনী তত্ত্ব খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় নেমে পড়েছিল। ‘এল’ আমোরে’ এবং ‘লা ম্যাসিন্না আম্মাজ্জাক্টিভি’ এমন দুই সিনেমা যাদের মাধ্যমে রোজেলিনি তাঁর নিওরিয়্যালিস্ট সিনেমাগুলোর ইতি টানেন। এগুলো তাঁর ফিল্ম ক্যারিয়ারের বিবর্তনমূলক নতুন পদক্ষেপের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল যেখানে মনোস্তত্ত্ববিষয়ক বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন তিনি। এই সূত্র ধরেই সে প্রথমে ‘এল’ আমোরে’ বানিয়েছিল। টু এপিসোডের এই সিনেমা নায়িকা কেন্দ্রিক ছিল এবং এতে আন্না ম্যাগনানি অভিনয় করেছিল। এই সিনেমাতে রোজেলিনি সর্বপ্রথম তাঁর সাবজেক্টকে প্লান-সিক্যুয়েন্স টেকনিকে ফিল্মিং এর কাজ করে। এই তত্ত্ব অনুসারে সাবজেক্টকে প্রাথমিক ফোকাস রুপে গন্য করে এক্সট্রিম ক্লোজ আপ শট নিয়ে পরবর্তীতে সাবজেক্টের আশেপাশের পারিপার্শ্বিকতাকে ক্যাপচার করা হতো। এরপরে ‘লা ম্যাসিন্না আম্মাজ্জাক্টিভি’ তৈরি করেছিলেন তিনি যা বাস্তব এবং সত্য ঘটনা চিত্রায়নের ক্ষেত্রে এক অন্যতম ভূমিকা রেখেছিল। অন্যান্য সিনেমার মতো রোজেলিনি এতেও নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। দুটো ভিন্ন ধরনের পথ সংমিশ্রণ করে, রোজেলিনি তাঁর এই ট্রানজিশনাল ফিল্মকে অতিরঞ্জিত অ্যাকশন এবং অর্থহীন রসবোধে সাজিয়েছিলেন।
রোজেলিনি এবং ইংগ্রিড বার্গম্যান:
১৯৪৮ সালে রোজেলিনি বিখ্যাত এক অভিনেত্রীর কাছ থেকে তাঁর সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশের অংশ হিসেবে একটি চিঠি পেয়েছিলেন:
“ডিয়ার মিস্টার রোজেলিনি ,
আমি আপনার ওপেন সিটি এবং পাইসা দেখেছি এবং সিনেমাদুটো অনেকবেশি উপভোগ করেছি আমি। যদি আপনার কোন সুইডিশ অভিনেত্রীর দরকার পড়ে যে ইংরেজি খুব ভালোভাবে বলতে পারে, জার্মান ভাষাশিক্ষা সেভাবে ভুলেনি, ফ্রেঞ্চ খুব ভালোভাবে বোঝে না এবং ইতালিয়ান বলতে শুধুমাত্র ‘তে আমো’ বোঝে, সেক্ষেত্রে আমি আপনার সাথে একই ফিল্মে কাজ করতে প্রস্তুত।
ইংগ্রিড বার্গম্যান ”
সিনেমার ইতিহাসের সবথেকে আলোচিত প্রেম কাহিনীটার শুরুটা হয়েছিল এভাবেই, যখন রোজেলিনি এবং বার্গম্যান উভয়েই নিজেদের ক্যারিয়ারের শিখরে অবস্থান করছিলেন। যৌথভাবে তাদের প্রথম কাজ ছিল ‘স্ট্রোমবলি টেরা ডি ডিও (১৯৫০)’। তাদের এই প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক তৎকালীন সময়ে অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল কারণ তারা উভয়েই আলাদা আলাদা ভাবে বিবাহিত ছিল। তাদের এই সম্পর্কের ব্যাপার আরও বেশি কেলেঙ্কারির সূচনা ঘটিয়েছিল যখন ইংগ্রিড অন্তঃসত্ত্বা হয়। তাদের দুজনের তিনটি ছেলেমেয়ে ছিল, রবার্তো ইংমার রোজেলিনি , ইসাবেলা রোজেলিনি এবং তাঁর জমজ বোন ইংগ্রিড ইসোট্টা। যৌথভাবে এই জুটি আরও কিছু সিনেমা করেছিল যাদের মধ্যে ‘ইউরোপা’৫১ (১৯৫২)’, ‘সিয়ামো ডন্নি (১৯৫৩)’, ‘জার্নি টু ইতালি (১৯৫৪)’, ‘লা পৌরা (১৯৫৪)’ এবং ‘গিওভান্না ডি’ আর্কো আল রোগো (১৯৫৪)’ অন্যতম। ১৯৫৭ সালে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর আমন্ত্রণে তিনি ভারতে ‘ইন্ডিয়া’ নামের একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করতে আসেন এবং ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কিছু সময় কাটিয়ে যান। বার্গম্যানের সাথে বিবাহিত সম্পর্ক থাকার পরেও চিত্রনাট্যকার সোনালি দাসগুপ্তের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তাঁর, যা সে সময়ে ভারত তথা হলিউডে কেলেঙ্কারি হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিল। নেহেরু এই কারণে রোজেলিনিকে ভারত ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল এবং এরপর পরই বিচ্ছেদ ঘটে বার্গম্যান এবং রোজেলিনি জুটির।
রোজেলিনি এবং দ্য সলিচ্যুড ট্রিলজি:
১৯৪৮ সালে বিখ্যাত সুইডিশ অভিনেত্রী ইংগ্রিড বার্গম্যানের সাথে পরিচয়ের পরের বছরে যৌথভাবে তারা সলিচ্যুড ট্রিলজির প্রথম ফিল্ম “স্ট্রোম্বলি টেরা ডি ডিও” তৈরির কাজ শুরু করেছিল। সিসিলিয়ান এক ছোট্ট দ্বীপে শ্যুটিং হয়েছিল সিনেমাটির যার কারণে, অভিনেত্রী বার্গম্যানকে সেসব সুযোগ সুবিধা ছেড়ে আসতে হয়েছিল যা আমেরিকাতে পেতেন তিনি। যেহেতু রোজেলিনি স্বাভাবিকভাবে উত্থিত আবেগ ধারণ করতে পছন্দ করতো, সেহেতু এসব কারণে এই সিনেমার কোন শ্যুটিং স্ক্রিপ্ট পর্যন্ত তৈরি করেছিলেন না তিনি। এমনকি পুরো সিনেমাতে কোন স্ট্যান্ট ডাবল ছাড়ায় বার্গম্যানকে পুরো সিনেমার স্ট্যান্ট করতে হয়েছিল সেইসময়। তাদের চলায়মান ব্যাক্তিগত এবং বিষয়গত সম্পর্কের দ্বিতীয় সিনেমা এবং সলিচ্যুড ট্রিলজির দ্বিতীয় মুভি ‘ইউরোপা’৫১’ আসে ১৯৫২ সালে। রোজেলিনি এই সিনেমাটি তৈরি করেছিল মাত্র ৪৬ দিনে এবং মাত্র ১৬০০০ মিটার ফিল্ম ব্যবহার করেছিল যাতে তাঁর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নবীনত্ব বজায় থাকে। ১৯৫৩ সালে রোজেলিনি ‘ভিয়াজ্ঞিও ইন ইতালিয়া’ তৈরি করে যা ইতালিতে সমালোচিত হলেও ফ্রান্সে সমাদৃত হয়েছিল। ইতালিয়ান বামপন্থি সমালোচকরা বলেছিল রোজেলিনি র পরবর্তী সিনেমাগুলো সামাজিক ইস্যু অথবা সামাজিক কোন থিম বাদ দিয়ে অন্য দিকে মোড় নিয়েছিল, যেখানে ডানপন্থিরা তাঁর ব্যাক্তিগত জীবন তথা বার্গম্যানের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে ক্রোধান্বিত ছিল। এবং এভাবেই সলিচ্যুড ট্রিলজিটা তাঁর অন্য দুই ট্রিলজির তুলনায় একটু কম প্রশংসিত হয়েছিল।
ফিল্মোগ্রাফি:
কিংবদন্তি এই পরিচালকের সমগ্র জীবনের সৃষ্ট কর্মের সংখ্যা কম নয়। ডকুমেন্টারি দিয়ে শুরু হলেও তাঁর ক্যারিয়ারের গাড়ি শেষ পর্যন্ত সিনেমাতে এসে আটকে গিয়েছিল। তাঁর সৃষ্ট কর্মগুলো হচ্ছে...
ড্যাফনি (১৯৩৬)
প্রিলুড অ্যা ল্যাপরিস মিডি ড’উন ফৌন (১৯৩৭)
লা ফসা ডেগলি অ্যাঞ্জেলি (১৯৩৭)
লুসিয়ানো সেরা, পাইলট (১৯৩৮)
লা ভিস্পা টেরেসা (১৯৩৯)
ইল টাচ্চিন্নো প্রিপোটেন্টে (১৯৩৯)
ফ্যান্টাসিয়া সট্টোম্যারিনা (১৯৪০)
ইল রাসচেল্লো ডি রিপাসট্টিলে (১৯৪০)
দ্য হোয়াইট শিপ (১৯৪১)
এ পাইলট রিটার্ন্স (১৯৪২)
দ্য ম্যান উইথ এ ক্রস (১৯৪৩)
রোম, ওপেন সিটি (১৯৪৫)
ডেসিডেরিও (১৯৪৬)
পাইসা (১৯৪৬)
এল’ আমোরে (১৯৪৮)
জার্মানি ইয়ার জিরো (১৯৪৮)
এল’ ইনভাসোর (১৯৪৯)
স্ট্রোম্বলি টেরা ডি ডিও (১৯৫০)
ফ্রান্সেস্কো, গিউল্লারে ডি ডিও (১৯৫০)
দ্য ওয়ে’স অফ লাভ (১৯৫০)
লেস সেপ্ট পেচেস ক্যাপিটক্স (১৯৫২)
লা মাসিন্না আম্মাজ্জিক্টিভি (১৯৫২)
ইউরোপা’৫১ (১৯৫২)
সিয়ামো ডণ্নে (১৯৫৩)
আমোরি ডি মেজ্জো সেকোলো (১৯৫৪)
ডো’ভে লা লিবার্তা ?? (১৯৫৪)
ভিয়াজ্ঞিও ইন ইতালিয়া (১৯৫৪)
লা পৌরা (১৯৫৪)
গিওভান্না ডি’ আর্কো আল রোগো (১৯৫৪)
ইন্ডিয়া : মাতৃ ভূমি (১৯৫৯)
ইল জেনেরালি ডেল্লা রোভারি (১৯৫৯)
এরা নট্টি এ রোমা (১৯৬০)
ভিভা ল’ ইতালিয়া (১৯৬১)
ভানিনা ভানিনি (১৯৬১)
উনো গার্ডো ডাল পন্টে (১৯৬১)
অ্যানিমা নেরা (১৯৬২)
বেনিতো মুসোলিনি (১৯৬২)
রো.গো.পা.জি (১৯৬৩)
লেস ক্যারাবিনিয়ার্স (১৯৬৩)
দ্য টেকিং অফ পাওয়ার বাই লুইস XIV (১৯৬৬)
ডা গেরুসালেম্মি এ দামাস্কো (১৯৭০)
রাইস ইউনিভার্সিটি (১৯৭১)
ইন্টারভিস্তা এ সালভদর আলেনডে: লা ফর্জা এ লা রাগিওন (১৯৭১)
আগস্টিনো ডি’ইপ্পোনা (১৯৭২)
কন্সার্টো পার মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো (১৯৭৪)
দ্য ওয়ার্ল্ড পপুলেশন (১৯৭৪)
আন্নো উনো (১৯৭৪)
ইল মেসিয়া (১৯৭৫)
বিউবর্গ, সেন্টারি ডি’আর্ট এট ডি কালচার জর্জেস পম্পিডৌ (১৯৭৭)
ভিভা ল’ ইতালিয়া (১৯৬১)
ভানিনা ভানিনি (১৯৬১)
উনো গার্ডো ডাল পন্টে (১৯৬১)
অ্যানিমা নেরা (১৯৬২)
বেনিতো মুসোলিনি (১৯৬২)
রো.গো.পা.জি (১৯৬৩)
লেস ক্যারাবিনিয়ার্স (১৯৬৩)
দ্য টেকিং অফ পাওয়ার বাই লুইস XIV (১৯৬৬)
ডা গেরুসালেম্মি এ দামাস্কো (১৯৭০)
রাইস ইউনিভার্সিটি (১৯৭১)
ইন্টারভিস্তা এ সালভদর আলেনডে: লা ফর্জা এ লা রাগিওন (১৯৭১)
আগস্টিনো ডি’ইপ্পোনা (১৯৭২)
কন্সার্টো পার মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো (১৯৭৪)
দ্য ওয়ার্ল্ড পপুলেশন (১৯৭৪)
আন্নো উনো (১৯৭৪)
ইল মেসিয়া (১৯৭৫)
বিউবর্গ, সেন্টারি ডি’আর্ট এট ডি কালচার জর্জেস পম্পিডৌ (১৯৭৭)
**** এই লেখা সম্পূর্ণ রূপে আমার… পূর্বের কোন লেখার সাথে মিলে গেলে তা একান্তই co-incidence….no resemblance. আশা করি পোস্টটি ভালো লাগবে !!!!