“What is next to ecstasy?
Pain.
What is next to pain?
Nothingness.
What is next to nothingness?
Hell.”
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তাহা বহুদূর...মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর। শেখ ফজলুল করিমের এই কথা চিরন্তন সত্য...স্বর্গ বলতে আদৌতে কিছু আছে কী নাই তা নিয়ে বিতর্ক দাঁড় করাতে চাইছি না...তবে নরক তো আছেই। পৃথিবীতে এমন কিছু জায়গা আছে, যা আর কিছু না হলেও নরকের পর্যায়ে তো যাবেই...এবং সেই জায়গার হর্তা কর্তা বিধাতা স্বয়ং মানুষ। এরকমই এক জায়গা কলোনিয়া ডিগনিদাদ। জায়গাটির অবস্থান সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে। চিলির প্যারাল শহর থেকে দক্ষিণ পূর্বে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দুরত্বে এর অবস্থান। কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের নাম শুনলে আমরা যেমনভাবে শিউরে উঠি, এটাও ঠিক তাই। কিছু কিছু জায়গা চোখের অগোচরেই থেকে যায়...এই জায়গা ঠিক সেরকম...বিভীষিকার অপর নাম। আজকের ব্লগে এই কলোনিয়া ডিগনিদাদ এবং সেই সংশ্লিষ্ট মুভি নিয়ে আলোচনা করব।
কলোনিয়া ডিগনিদাদ সম্পর্কে কিছু তথ্য :
• দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চিলিতে অভিবাসী জার্মানদের জন্য তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি বিস্তারের জায়গা হিসেবে কলোনিয়া ডিগনিদাদ নির্মাণ করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালের দিকে চিলিতে যাবার পর পল শেফার নামের এক নাৎসি জায়গাটি দখল করে নিয়েছিলো। সে সেই জায়গাটিকে নিজস্ব ধাঁচে তৈরি করার ফলে জার্মান সংস্কৃতি বিস্তারের জায়গা হয়ে পড়েছিলো এক ছোটখাট কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প। এই কলোনির পূর্ণ নাম ছিলো সোসাইডেড বেনেফ্যাক্টরা ই এডুকেশনাল ডিগনিদাদ (ডিগনিটি চ্যারিটিবল অ্যান্ড এডুকেশনাল সোসাইটি)। কলোনিয়া ডিগনিদাদ প্রায় তিনশ জার্মান এবং চিলিয়ানদের আবাসস্থল ছিলো। কলোনিয়া ডিগনিদাদ তৎকালীন সময়ে গোপন জায়গা ছিলো যা নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘিরে রাখা থাকত।
• পল শেফার...কলোনিয়া ডিগনিদাদের সাথে যার নাম ভালোভাবে সম্পৃক্ত...তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে শিশু নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত ছিলো। পল জার্মানির বন শহরের নিকট সিয়েগবার্গে ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলো। প্রথম জীবনে সে জার্মানিতে স্থানীয় চার্চের অধীনস্থ শিশুদের ওয়েলফেয়ার ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করত। ১৯৪০ সালে চাকরি থেকে বহিষ্কৃত করার পর তাকে তার আওতায় থাকা শিশুদের উপরে যৌন নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো। এরপর সে নিজ উদ্যোগে যাজক হয়েছিলো। গ্রোনাও- এ একটা কমিউনিটি গঠনের মাধ্যমে সে আবারও খারাপ অবস্থাসম্পন্ন শিশুদের জন্য কাজ করার মধ্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলো। রাতারাতি সে অনেককেই নিজের মতে উদ্ভুদ্ধ করে ফেলেছিলো। এরপরে আবারও তার উপরে পেডোফিলিয়ার আরোপ লাগলে সে তার কমিউনিটির শ’ খানেক সদস্য নিয়ে চিলিতে অভিবাসিত হয়ে চলে গিয়েছিলো।
• পল শেফার তার অধীনস্থ কলোনিয়াকে কাল্ট অর্গানাইজেশনে রুপান্তরিত করেছিলো যাকে বাইরে থেকে শান্ত, সুস্থ পরিবেশের দেখালেও ভেতরের ঘটনাটা পুরো বিপরীত ছিলো। রেসিডেন্টদের খুশি খুশি ভাব জনসম্মুখে প্রেসের মাধ্যমে দেখানো হলেও ভেতরের অবস্থা যে ভিন্ন ছিলো তা প্রকাশ করেছিলো সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া কিছু নিবাসী। ১৯৬৬ সালে উলফগ্যাং মুলার নাম্নী একজন কলোনিয়ার বদ্ধ অবস্থা থেকে পালিয়ে এসে এর ভেতরের নির্মমতার কথা প্রকাশ করে দিয়েছিলো। মুলার পরবর্তীতে জার্মান নাগরিকত্ব পেয়ে কলোনিয়া ডিগনিদাদের বিপক্ষ আক্টিভিস্ট হয়েছিলো। পরের বছরে সে আরও একজনকে কলোনিয়া থেকে বিমুক্ত করেছিলো। হেইঞ্জ কুন নামের সেই ব্যাক্তি কলোনিয়াতে হওয়া নির্যাতনের সপক্ষে আরও তথ্য দিয়েছিলো।
• কলোনিয়া ডিগনিদাদ রাজনৈতিক ভাবে অভিযুক্ত আসামিদের ডিটেনশন ক্যাম্প ছিলো এবং তা তৎকালীন চিলির সরকারের সহায়তাতেই চলত।
• সাংবাদিক জন ডিঙ্গেসের মতে কলোনিয়া জার্মান ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের সহায়তায় তৈরি হয়েছিলো। সেখানে বাঙ্কার, টানেল, হাসপাতাল, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য রাস্তা ছিলো। পরবর্তীতে আর্জেন্টিনার সাথে সংশ্লিষ্ট এক সমস্যার কারণে এই তথ্য ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিলো।
• কলোনিয়ার নিবাসীদের অস্বাভাবিক সব নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে জীবন চালাতে হত। বাইরের পৃথিবীর সাথে খুব কমই যোগাযোগ করতে পারত তারা। শেফারের আদেশে পরিবারের এক এক সদস্যকে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থাকতে হত। বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়ের সাথে কথা বলতে পারত না, এমনকি ভাই বোনদেরকে একে অপরের সংস্পর্শে আসতেও দেয়া হত না। যে কোন ধরনের সম্পর্কের উপরে সেখানে নিষেধাজ্ঞা ছিলো, সেটা আবেগীয় হোক কিংবা বৈবাহিক হোক। নারী পুরুষকে সেখানে আলাদা আলাদা জায়গায় রাখা হত। জার্মান ডাক্তার গিসেলা সিওয়াল্ডের মতে শেফার সেখানকার বাচ্চাদেরকে যৌন নির্যাতন করত। সেখানকার সদস্যদের উপরে ইলেক্ট্রোশক থেরাপি এবং সিডেটিভ দিয়ে নির্যাতন করা হত।
• অগাস্টো পিনোসের শাসনকালে কলোনিয়া ডিগনিদাদকে স্পেশাল টর্চার সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হত। ১৯৯১ সালে চিলির ন্যাশনাল কমিশন ফর ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশনের মতে ডিনার দেয়া তথ্য মতে কিছু মানুষকে কলোনিয়া ডিগনিদাদে আসামি হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, কিছুদিন তাদেরকে সেখানে রাখাও হয়েছিলো এবং কিছু মানুষকে নির্যাতন করা হয়েছিলো।
• কিছু দলত্যাগি সদস্য কলোনিকে কাল্ট হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন যেখানে লিডার পল শেফার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি ছিলো, নিজেকে সে সবার সামনে ঈশ্বর হিসেবে উপস্থাপন করেছিলো। তাদের মতে সেখানকার অধিবাসিদের কখনও কলোনি ছেড়ে বাইরে যেতে দেয়া হত না এবং কঠিন নিয়মকানুনের মধ্যে দিয়ে তাদেরকে আলাদা থাকতে হত। টেলিভিশন, টেলিফোন এবং ক্যালেন্ডার সেখানে ব্যান করা হয়েছিলো। রেসিডেন্টদের সেখানে ব্যাভারিয়ান কৃষকদের পোশাক পরে কাজ করতে হত এবং জার্মান লোকসঙ্গিত গাইতে হত। সেখানে যৌন সম্পর্কের উপরে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা ছিলো এবং কিছু কিছু রেসিডেন্টদের সেখানে জোরপূর্বক প্রবৃত্তি নিবারণের জন্য ওষুধ খাওয়ানো হত। তরুণীদের এবং পুরুষদের অনুত্তেজিত করার জন্য ড্রাগও দেয়া হত। কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার জায়গাটিতে চরম পর্যায়ের নির্যাতন নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় ছিলো। শেফারের মতে শৃঙ্খলা রক্ষা আধ্যাত্মিকতার অংশ ছিলো।
• ধারণা করা হয়, চিলির প্রায় ১১০০ জন নিরুদ্দেশ ব্যাক্তির অধিকাংশকেই এই কলোনিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সেখানে তাদেরকে নির্যাতন করে পরবর্তীতে মেরেও ফেলা হয়েছিলো। ইউএসের নাগরিক বরিস উইজফেইলার ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে চিলি এবং আর্জেন্টিনার বর্ডার এলাকায় হাইকিং ট্রিপে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলো। বরিস পেনিসিলভেনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গণিতের প্রফেসর ছিলেন। ধারণা করা হয়, উইজফেইলারকে অপহরণ করে কলোনিতে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে পরবর্তীতে মেরে ফেলা হয়।
• ২০০৫ সালের জুন এবং জুলাই মাসে চিলির পুলিশ কলোনির আশেপাশে অস্ত্রের চালানের বিষয়টি আবিষ্কার করে। ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে চিলির সিক্রেট পুলিশ অপারেটিভ মাইকেল টাউনলি স্বীকার করে ডিনা এবং কলোনিয়া ডিগনিদাদের সম্পর্ক রয়েছে। টাউনলি এও বলেন, কলোনিয়া ডিগনিদাদ এবং এবং চিলির আর্মির ব্যাক্টেরিওলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারের ল্যাবরেটরিও রয়েছে। টাউনলির কাছে কলোনিয়া ডিগনিদাদের রাজনৈতিক বন্দিদের উপরে হওয়া বায়োলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্টের প্রমাণও রয়েছে বলে স্বীকার করেন।
• ১৯৯৬ সালে পল শেফারকে চিলিতে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলেও ২০০৫ সাল অবধি তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। এর পরের বছর তার অনুপস্থিতিতে চিলির কোর্ট তাকে ছাব্বিশ জন কাল্ট সদস্যদের সহযোগে শিশুদের উপরে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে দোষী স্যাব্যাস্ত করে। ২০০৬ সালে তাকে ২০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। কিন্তু ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল ঊননব্বই বছর বয়সে সে হার্টের রোগে মারা যায়।
কলোনিয়া ডিগনিদাদের বর্তমান অবস্থা:
২০০৫ সালের পরে কলোনিতে লিডার পরিবর্তিত হয়। তাদের মতে সেখানকার পরিবেশে তারপর থেকে বিস্তর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমানের লিডাররা কলোনিকে আধুনিকীকরণের কাজে মনোনিবেশ করেছে এবং এই উদ্যোগে তারা সেখানকার রেসিডেন্টদের ইউনিভার্সিটিতে পড়ার এবং কলোনিকে ট্যুরিজমের অংশ হিসেবে পরিণত করার কাজ করেছে। বর্তমানে জায়গাটি ভিলা ব্যাভিয়েরা নামে পরিচিত।
কলোনিয়া-- দ্য মুভি:
সাল ১৯৭৩, এয়ার হোস্টেস লেনা চিলিতে যাবার পর রাস্তায় জনসমাগমের মাঝে তার প্রেমিক ড্যানিয়েলের দেখা পায়। ড্যানিয়েল বিদ্রোহী, মিলিটারি বাহিনীর বিপক্ষে গিয়ে প্রেসিডেন্ট স্যালভাদর অ্যালেন্ডের প্রচার প্রচারণার কাজ করে সে। এভাবেই একদিন মিলিটারি ক্যু ঘটলে অন্যান্য অনেকের মত লেনা এবং ড্যানিয়েল ধরা পড়ে যায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হাতে। জেনারেল পিনোসের বিপক্ষে যাবার অপরাধে ড্যানিয়েলকে আলাদাভাবে নিয়ে যাওয়া হয়। লেনাকে মুক্ত করে দেয়া হয়। সে ড্যানিয়েলকে খুঁজতে থাকে এবং একসময় সে জানতে পারে তাকে পাঠানো হয়েছে মিলিটারি বাহিনীর গোপন আস্তানা কলোনিয়া ডিগনিদাদে। কলোনিয়া ডিগনিদাদ...যে জায়গায় একবার গেলে ফিরে আসার নজির বলতে গেলে নেই। লেনা ড্যানিয়েলকে ফিরিয়ে আনার জন্য সেই রহস্যময় জায়গার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। লেনা কী তার ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরিয়ে আনতে পারে? কলোনিয়াতে তার জন্য কী অপেক্ষা করে থাকে? ঘটনা শুনে গড়পড়তা কাহিনী মনে হলেও...গ্যারান্টি দিচ্ছি একফোঁটাও মিল পাবেন না। সিনেমাটি মস্তিস্কপ্রসূত কোন গল্প থেকে তৈরি হয়নি, বরং বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে। সিনেমার পরিচালক ফ্লোরিয়ান গ্যালেনবার্জারের শ্যাডোজ অফ টাইম দেখেছিলাম অনেক আগে। কলোনিয়া ডিগনিদাদ তার একেবারে বিপরীতধর্মি কাজ। সিনেমা দেখার পুরোটা সময় উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে কেটেছিল...কী হচ্ছে, কী হবে। বাস্তব ঘটনার আধারে নির্মিত হওয়ায় আগ্রহটা আরও দ্বিগুণ ছিলো। হারমিয়ন গ্রেঞ্জারকে (এমা ওয়াটসন) এরকম একটা সিনেমায় অভিনয় করতে দেখে আমি যারপরনাই খুশি। সিনেমার প্রত্যেকটি চরিত্র এককথায় দারুণ ...বলে রাখা ভালো এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে মিলেনিয়াম সিরিজের (সুইডিশটা) ব্লুমকোভিস্টের (মাইকেল ন্যুকভিস্ট) দেখাও পাবেন। সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি এই জার্মান সিনেমা দেখা না থাকলে নির্দ্বিধায় দেখে নিতে পারেন...আর কিছু না হলেও কিছু অজানা সত্যের মুখোমুখি হবেন।
The Colony 2015 (Original Title: Colonia)
IMDB rating: 7.1/10
Genre: Drama/ Romance/ Thriller
Cast: Emma Watson, Daniel Brühl, Michael Nyqvist
Country of Origin: Germany
কলোনিয়া ডিগনিদাদকে নিয়ে ডকুমেন্টারির লিংক:
কলোনিয়া ডিগনিদাদ ১
কলোনিয়া ডিগনিদাদ ২
**** এই লেখা সম্পূর্ণ রূপে আমার… পূর্বের কোন লেখার সাথে মিলে গেলে তা একান্তই co-incidence….no resemblance. আশা করি পোস্টটি ভালো লাগবে !!!!