-কি করছো?
– ছবি আকঁছি।
– ওটা তো একটা বিন্দু।
– তুমি ছুঁয়ে দিলেই বৃত্ত হবে। কেন্দ্র হবে তুমি। আর আমি হবো বৃত্তাবর্ত।
– কিন্তু আমি যে বৃত্তে আবদ্ধ হতে চাই না। আমি চাই অসীমের অধিকার।
– একটু অপেক্ষা করো। . . . এবার দেখো।
ওটা কি? ওটা তো মেঘ।
– তুমি ছুঁয়ে দিলেই আকাশ হবে। তুমি হবে নি:সীম দিগন্ত। আর আমি হবো দিগন্তরেখা।
– কিন্তু সে তো অন্ধকার হলেই মিলিয়ে যাবে। আমি চিরন্তন হতে চাই।
– আচ্ছা, এবার দেখো।
– একি! এ তো জল।
– তুমি ছুঁয়ে দিলেই সাগর হবে। তিনভাগ জলের তুমি হবে জলকন্যা। আর আমি হবো জলাধার।
– আমার যে খন্ডিতে বিশ্বাস নেই। আমার দাবী সমগ্রের।
– একটু অপেক্ষা করো। এবার চোখ খোল।
– ওটা কি আঁকলে? ওটা তো একটা হৃদয়।
– হ্যাঁ, এটা হৃদয়। যেখানে তুমি আছো অসীম মমতায়, চিরন্তন ভালোবাসায়। এবার বলো আর কি চাই তোমার?
– সারাজীবন শুধু ওখানেই থাকতে চাই।
আজকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে পুর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন দিয়েই শুরু করলাম। কয়েকটা ছত্রের মাধ্যমেই সামান্য সম্পর্কের অসামান্য দিকগুলো তুলে ধরেছিলেন তিনি। হ্যাঁ...কথা বলছি প্রিয়জনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে। প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মতো এই সম্পর্কগুলোতেও কিন্তু জোয়ার ভাটা, অমানিশা, গ্রহণ লাগে কখনো কখনো। কিন্তু বাধা বিগ্ন ব্যাতিরেকে সম্পর্কটা ঠিক নক্ষত্রের মতোই...নিজের আলোতে প্রজ্বলিত থাকে যে। মেঘ অনেকসময় ঢেকে ফেললেও, তার অস্তিত্ব কিন্তু পুরোপুরি মিটিয়ে ফেলতে পারে না। অন্তরীক্ষলোকের স্পষ্টভাবের সাথে দ্যুতির মাত্রা সমানুপাতিক। স্পষ্টভাব থাকলে দ্যুতি বাড়ে, অস্পষ্টভাবে দ্যুতি কমে। আজকে আলোচনা করবো এই সম্পর্কেরই উপর তৈরি দুটো সিনেমা নিয়ে যেখানে ভিন্ন আঙ্গিকে একই সম্পর্কের দুটো ভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রথম মুভি:
তুমি মোরে পার না বুঝিতে?
প্রশান্ত বিষাদভরে
দুটি আঁখি প্রশ্ন ক'রে
অর্থ মোর চাহিছে খুঁজিতে,
চন্দ্রমা যেমন ভাবে স্থিরনতমুখে
চেয়ে দেখে সমুদ্রের বুকে।
কিছু আমি করি নি গোপন।
যাহা আছে সব আছে
তোমার আঁখির কাছে
প্রসারিত অবারিত মন।
দিয়েছি সমস্ত মোর করিতে ধারণা,
তাই মোরে বুঝিতে পার না?
এ যদি হইত শুধু মণি,
শত খণ্ড করি তারে
সযত্নে বিবিধাকারে
একটি একটি করি গণি
একখানি সূত্রে গাঁথি একখানি হার
পরাতেম গলায় তোমার।
এ যদি হইত শুধু ফুল,
সুগোল সুন্দর ছোটো,
উষালোকে ফোটো-ফোটো,
বসন্তের পবনে দোদুল,
বৃন্ত হতে সযতনে আনিতাম তুলে--
পরায়ে দিতেম কালো চুলে।
এ যে সখী, সমস্ত হৃদয়।
কোথা জল, কোথা কূল,
দিক হয়ে যায় ভুল,
অন্তহীন রহস্যনিলয়।
এ রাজ্যের আদি অন্ত নাহি জান রানী--
এ তবু তোমার রাজধানী।
কী তোমারে চাহি বুঝাইতে?
গভীর হৃদয়-মাঝে
নাহি জানি কী যে বাজে
নিশিদিন নীরব সংগীতে--
শব্দহীন স্তব্ধতায় ব্যাপিয়া গগন
রজনীর ধ্বনির মতন।
এ যদি হইত শুধু সুখ,
কেবল একটি হাসি
অধরের প্রান্তে আসি
আনন্দ করিত জাগরূক।
মুহূর্তে বুঝিয়া নিতে হৃদয়বারতা,
বলিতে হত না কোনো কথা।
এ যদি হইত শুধু দুখ,
দুটি বিন্দু অশ্রুজল
দুই চক্ষে ছলছল,
বিষণ্ণ অধর, ম্লান মুখ,
প্রত্যক্ষ দেখিতে পেতে অন্তরের ব্যথা,
নীরবে প্রকাশ হত কথা।
এ যে সখী, হৃদয়ের প্রেম,
সুখদুঃখবেদনার
আদি অন্ত নাহি যার--
চিরদৈন্য চিরপূর্ণ হেম।
নব নব ব্যাকুলতা জাগে দিবারাতে,
তাই আমি না পারি বুঝাতে।
নাই বা বুঝিলে তুমি মোরে!
চিরকাল চোখে চোখে
নূতন নূতনালোকে
পাঠ করো রাত্রি দিন ধরে।
বুঝা যায় আধো প্রেম, আধখানা মন--
সমস্ত কে বুঝেছে কখন?
কবিগুরুর এই কবিতাটার মাধ্যমেই বেলাশেষের সারমর্ম বুঝিয়ে দিয়েছি। দ্বন্ধ সমাসের একটা চিরাচরিত উদাহরণ রয়েছে...জায়া ও পতি =দম্পতি। দ্বন্ধ সমাস...দম্পতি...বৈপরীত্যের প্রকাশ ঘটালেও সম্পর্কটা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। মানূষের ক্ষেত্রে সম্পর্কগুলো তৈরি হয় বেশ কিছু উপাদান দিয়ে...ঐ যে পঞ্চব্যঞ্জনের মতো...তেল থাকবে, ঘি থাকবে, পাঁচ ফোড়ন, একটু খানি চিনি, স্বাদমতো লবণ আর বিভিন্ন রঙের সবজি। মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই উপাদানগুলো হলো শ্রদ্ধা, আনুগত্য, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, ভালোবাসা আর কিছুটা অভিমান। লাইফ পার্টনার...জীবনসঙ্গি...আবারও সমাস করি...জীবনের সঙ্গি= জীবনসঙ্গি। সঙ্গি হবার শর্তগুলো কী হতে পারে?? দেয়ালঘড়ির মতো জীবনের দেয়ালে লেগে থাকলেই কী জীবনসঙ্গি হওয়া যায়? সহজ উত্তর....যায় না। সঙ্গি হতে গেলে প্রথমত তাকে সঙ্গ দিতে হবে, তাকে জীবনের একটা অংশ বানাতে হবে। ঐ যে বললাম...আমাদের প্রত্যেকের জীবনে বেশ কয়েকটি উপাদান আছে...যেগুলোর একটার অভাবে পুরো পঞ্চব্যঞ্জনটাই ঘন্ট হয়ে যায়! দাম্পত্য জীবনের প্রধান উপাদান পারস্পরিক বোঝাপড়া, বিশ্বাস, আস্থা, ভালোবাসা...যেখানে জেনে বুঝে পাশ কাটিয়ে যাবার প্রবণতা মুল্যবান সময়গুলোকে তিতো করার কাজ করে। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিতো এই অংশটাই পুরো অংশটাকে যেন নিজের মতো করে রূপান্তর করে ফেলে। ঠিক এমনই এক সম্পর্কের আড়ালে তৈরি হয়েছে...বেলাশেষে...জীবনের শরৎকালের গল্প। কিছু কিছু গল্প আছে যেগুলো ভূমিকা, বর্ণনা, উপসংহার এই প্যাটার্নে বলা খুব খুব কঠিন। কারণ...গল্পগুলোর ভূমিকা কিংবা বর্ণনার থেকে উপসংহার বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। বেলাশেষের গল্পটা বয়স্ক এক দম্পতিকে ঘিরে শুরু হলেও বেশ কিছু সম্পর্ককেও এই একই গল্পের সমান্তরালে উপস্থাপন করা হয়েছে। মুখ্য একটা গল্পের সাথে গৌণ অনেকগুলো গল্প সংযুক্ত...সম্পর্কগুলোর মাহাত্ম্য এখানে গভির। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার তরীর সেই “দুর্বোধ” কবিতাটার মতো দাম্পত্যের ক্ষেত্রেও সমস্ত কে বুঝেছে কখন? কথাটা খাটে। আর এই বোঝা, না বোঝার আড়ালে জীবনের বেশ কিছুটা সময় হয়ত নিজেদের অজ্ঞাতে হারিয়েও যায়। বেলাশেষেতে এমনই এক গল্প আছে। যে গল্প পুষে রাখা কিছু অভিমানের, কিছু আনুগত্যের। পুরো সিনেমাটা দেখে মনে হয়েছে, নাহ সত্যি তো টকমিষ্টি মিলিয়েই তো জীবনের সম্পর্কের স্বাদগুলো তৈরি...এবং পাওয়া, না পাওয়ার মাঝেই জীবনের আসল মজা প্রোথিত আছে! বেলাশেষে এই দিকটাতেই আলোকপাত করেছে। শরতের আকাশ নির্মল, পেঁজা তুলোর মতো দেখতে মেঘে যেমন আচ্ছাদিত হয়ে থাকে, জীবনের শরৎকালও ঠিক তাই। সম্পর্ককে যারা ভালবাসেন, সম্পর্কের মুল্য যাদের কাছে অসামান্য...তারা বেলাশেষের মর্মটাও বুঝবেন। সিনেমার দুই মুখ্য চরিত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত প্রায় ৩০ বছর আগে অভিনয় করেছিলেন “ঘরে বাইরে”তে। আবারও তারা একত্রিত হয়েছেন সম্পর্কের সিনেমা বেলাশেষেতে। বহুদিন পর কোন বাংলা সিনেমা আমার কাছে আউটস্ট্যান্ডিং পর্যায়ের মনে হয়েছে। এ মাস্ট সি।
বেলাশেষে (২০১৫)
রেটিং: ৮.৬/১০
অভিনয়ে: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, অপরাজিতা আঢ্য।
দ্বিতীয় মুভি:
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা ,
ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন ।।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লাল রঙের শাড়িতে --
দালিম-ফুলের মত রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলন-চাঁপার মত চিকন-গৌর মুখখানি ঘিরে ।
মনে হল, কাল রঙের একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে ।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা :
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে ।।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার ।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে :
আলাপ করলেম শুরু --
'কেমন আছো', 'কেমন চলছে সংসার ' ইত্যাদি ।
সে রইল জানালার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে ।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব ,
কোনটা বা দিলেই না ।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় --
কেন এ-সব কথা ,
এর চেয়ে অনেক ভাল চুপ ক'রে থাকা ।।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে ।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে ।
মনে হল কম সাহস নয় --
বসলুম ওর এক বেঞ্চিতে ।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে ,
'কিছু মনে কোরো না ,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার !
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই ;
দূরে যাবে তুমি ,
তাই, যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে ,
শুনব তোমার মুখে ।
সত্য করে বলবে তো ?'
আমি বললাম ,'বলব' ।
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
'আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে --
কিছুই কি নেই বাকি?'
একটুকু রইলেম চুপ করে ;
তার পর বললেম ,
'রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে' ।
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম নাকি ।
ও বললে, 'থাক এখন যাও ও দিকে'
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে ।
আমি চললেম একা ।।
সিনেমার গল্প ঠিক এমনই...চেনা মানুষ যখন অচেনা হয়ে যায় এবং পরিচিত এই পৃথিবীর যান্ত্রিক কলেবরে যখন তাদের 'হঠাৎ দেখা' হয়। আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেল...কত সুর, কত গান মনে পড়ে গেল...বলো ভালো আছো তো....ঠিক মান্না দের এই গানটার মতো। গল্পটা চারটে ভিন্নধর্মী জীবনের আলোকে শুরু হলেও ফোকাস এক জোড়ার উপরেই থাকে। উজান আর সুদীপা...নামের মত উজানের সম্পর্কের স্রোত সময়বিশেষে পরিবর্তিত হয়। সুদীপা আর উজানের সম্পর্কে ভাটার সময়টাই যেন চিরস্থায়ী হয়ে যায়। বিবাহিত জীবনে ফাটল আসলে সাধারণ ক্ষেত্রে আমরা একে অপরকে দোষারোপ করি...ওর কারণে আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়েছে, আমি তো রক্ষা করতেই চেয়েছিলাম...কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে সম্পর্ক উভয়ের গরিমার আড়ালেই চিরতরে হারিয়ে যায়। এই সিনেমা সেই চিরতরে হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কের গল্প যেখানে হঠাৎ একদিন সম্পর্কহীন মানুষ দুটো চিরচেনা এই পৃথিবীর আবর্তে একে অপরের সামনে এসে পড়ে এবং তৈরি হয় কিছু অসম্পর্কের গল্প। বেলাশেষে যদি জীবনের শরৎকালের গল্প হয়ে থাকে তাহলে প্রাক্তন হবে হেমন্তের বিকেল...যেখানে টিমটিমানি কিছু স্মৃতি ছাড়া সম্পর্কের আর কোন অবশিষ্টাংশ খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রাক্তনে আমার, আপনার এবং আমাদের সকলেরই এক পরিচিত কাহিনী আছে...যা অব্যক্ত থাকে কিংবা অগ্রাহ্য। সিনেমার প্লট ভাল লেগেছে...আর কিছু হলেও মেইনস্ট্রিম ধুমধাড়াক্কা সিনেমার মত মেজাজ খিচড়ে দেবার কাহিনী নাই। আমার ব্যাক্তিগতভাবে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে কখনই ভালো লাগত না (দহনে ভালো লেগেছিল অভিনয়, আর দ্বিতীয়ত এটা)। কিন্তু ভালো পরিচালকের হাতে পড়লে সুজন সখি স্মিতা পাতিল হয়ে যায়!! সোজাসাপটা কাহিনী অ্যান্ড ইনডিড এ গুড মুভি টু ওয়াচ।
প্রাক্তন (২০১৬)
রেটিং:৭.৯/১০
অভিনয়ে: প্রসেনজিত, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপরাজিতা আঢ্য।
**** এই লেখা সম্পূর্ণ রূপে আমার… পূর্বের কোন লেখার সাথে মিলে গেলে তা একান্তই co-incidence….no resemblance. আশা করি পোস্টটি ভালো লাগবে !!!!