গত দুই-তিনদিন ধরে ব্লগে বৈশাখ সম্বলিত বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোকপাত করে প্রাণের বৈশাখকে ব্লগার ভাই ও আপুরা নিজেদের বিচক্ষণতায় তুলে ধরেছেন। আমার অভিপ্রায় বেশি কিছু নয়, প্রাণের উৎসব বৈশাখসহ বাঙ্গালীর বিভিন্ন উৎসবে তাদের মনের এক অন্য অংশের ছবি তুলে ধরা। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের বাঙ্গালীর একটি বিশেষ দিক খেয়াল করেছি যা পৃথিবীর আর সব জাতি থেকে আলাদা করে আমাদের...সেটি কি জানেন?? আমাদের মনের রঙ্গিন সত্ত্বা...আমাদের স্বাধীনতার রং রয়েছে, খুশির রং রয়েছে, অনুভূতিগুলোর রং রয়েছে একই সাথে উৎসবগুলোরও রং রয়েছে। বলতে পারবেন পৃথিবীর কোন জাতি স্বাধীনতার রঙে নিজেকে লাল-সবুজে রাঙায় বা বসন্তের বর্ণময়তার প্রকাশ হিসেবে নিজেদের রাঙায় হলুদ-কমলা-সবুজে? কেউ রাঙায় না...। সবাই বিভিন্ন মতবাদ তুলে ধরেছেন পান্তা ইলিশের বা পোশাক সাজসজ্জার- শাড়ি নাকি পাঞ্জাবি, ফতুয়া নাকি কামিজ; বৈশাখের বিষয়ের মধ্যে খাদ্য এবং পোশাকের হাল ফ্যাশন অনেক চর্চিত একটি বিষয়...। কিন্তু আমরা বাঙ্গালীরা কি এটা কিছু সময়ের জন্য হলেও বলতে পারি না... আমরা পৃথিবীর আর সবার থেকে আলাদা কিছু ক্ষেত্রে । কাল পহেলা বৈশাখ-- বাচ্চা, বুড়ো, যুবক, যুবতী বৈশাখকে বরণ করবে লাল-সাদার এক অপরূপ সাজে। আমরা বাঙ্গালীরা ছাড়া কিন্তু পাশ্চাত্যের অনেক জায়গায় বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন ক্ষণে নববর্ষ হয়ে থাকে...বলতে পারবেন কোন জায়গায় কোন মানুষটি এভাবে লাল-সাদা ভূষণে বছরের একটি ক্ষণকে বরণ করে নেয়?? বরণ বলতে যা বোঝায় তারা সেটি করে না..... বরং তারা celebrate নামের “cheers cheers” করে থাকে! :-< :-< বছরের অন্যান্য দিন কেরোসিন যাক না কেন বছরের প্রথম দিন সবার কাছেই মোটামুটিভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে থাকে। বর্ষ বরণের পর আসে বর্ষা বরণ...পৃথিবীতে মানুষ বর্ষাবরণ প্রথমদিন থেকেই করে ছাতা নিয়ে, আমরা সেটিকেও দুইটি রঙে রাঙিয়েছি—সাদা এবং সবুজ। গ্রীষ্মের গরমের পর প্রকৃতি নিজেকে যেমন সবুজাভ রঙে সজ্জিত করে, আমরা নিজেরাও সেই প্রকৃতিকে কিন্তু নিজের মত করে বরণ করি এই সাদা-সবুজে তাই নয় কি...? পরের দিনগুলো হাতে ছাতা আর পায়ে রাবারের স্যান্ডেল আমাদেরও চলে আসে...! কিন্তু প্রকৃতিকে নিজেদের একটা অংশ মনে করি কিনা একদিনের জন্য হলেও? এরপর আসে শরৎ বন্দনা... শরতের আকাশের সাথে শ্বেত শুভ্রের যোগসূত্র করা কিন্তু শুধু বাঙ্গালীর পক্ষেই সম্ভব হয়েছে... সাদা-নীল দিয়ে তাই সে তৃতীয় এই ঋতুটিকেও বরণ করে নেয়। তিনটা ঋতু এবং একটি স্বাধীনতার রং কি যথেষ্ট নয়...আমাদের নিজেকে বিশ্বের দরবারে আলাদা করতে?? অন্যান্য উৎসব গুলো নাহয় বাদই দিলাম...প্রত্যেকটির একেকটি বিশেষত্ব রয়েছে আমাদের বাঙ্গালীদের জীবনে। ইলিশ, পান্তা অথবা নির্দিষ্ট দিনে কোন খাদ্য আমাদের কি প্রতিনিধিত্ব করে? না আমরা আমাদের বিশ্বের দরবারে তুলে ধরি এক অন্য রূপে নিজেদের প্রতিনিধি হিসেবে...আমরা অনন্য বাঙ্গালী? অনেকে কাল সামনাসামনি দেখবেন বা টিভিতে দেখেবেন অথবা পেপারে ছবি দেখবেন বেশ কিছু বিদেশী মানুষ লাল-সাদাতে নিজেদের রাঙিয়ে মানুষের ভেলায় ভেসে যেতে বেরিয়েছে... তারা তো কমলা বা সবুজও পড়তে পারত তাইনা? তারা পর্যন্ত নিজেদের গেঞ্জিটা হলেও লাল পড়বে... অথবা সাদা রঙের জামা গায়ে দিয়ে মাথায় লাল রঙের মঙ্গলশোভা যাত্রার ব্যান্ড বাঁধবে। কারণ তারা জানে ঐতিহ্য টাকা দিয়ে কেনা যায় না...সংস্কৃতি রক্ষার জন্য মানসিকতার দরকার পড়ে এবং যে কোন দেশের সংস্কৃতি অনেক বেশি মুল্যবান হয়ে থাকে। আমাদের যে ঐতিহ্য রয়েছে তা আর কিছু হলেও ফেলনা নয়... এটা সবাই বুঝলেও, আমরা নিজেরাই সেটাকে হেয় বানিয়ে দিই মাঝে মাঝে বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে... এক হাতের পাঁচ আঙ্গুলই খারাপ এটা ভাবতে থাকি !! বছরের অন্যান্য দিন আমরা এক হতে ব্যর্থ হয়, আজকে মতামত মিলে না তো কাল চিন্তা চেতনা নিয়ে দ্বন্ধ...! বছরের কিছু নির্দিষ্ট দিনে আর কিছু না হলেও আমাদের বহিরাবরণ তো মেলে...কিছুটা হলেও তো একাত্মবোধের অনুভব হয়....আমরা এক, আমরা বিশ্বের আর সবার থেকে আলাদা... আমরা রঙিন বাঙ্গালী। সবশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই প্রভাত সঙ্গীত কবিতাটি দিয়ে পোস্টটির ইতি টানতে চাই—
“হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি!
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি!
ধরায় আছে যত মানুষ শত শত
আসিছে প্রাণে মোর,হাসিছে গলাগলি।
এসেছে সখা সখী বসিয়া চোখাচোখি,
দাঁড়ায়ে মুখোমুখি হাসিছে শিশুগুলি।
এসেছে ভাই বোন পুলকে ভরা মন,
ডাকিছে, "ভাই ভাই' আঁখিতে আঁখি তুলি।
সখারা এল ছুটে, নয়নে তারা ফুটে,
পরানে কথা উঠে-- বচন গেল ভুলি।
সখীরা হাতে হাতে ভ্রমিছে সাথে সাথে,
দোলায় চড়ি তারা করিছে দোলাদুলি।
শিশুরে লয়ে কোলে জননী এল চলে,
বুকেতে চেপে ধরে বলিছে "ঘুমো ঘুমো'।
আনত দু'নয়ানে চাহিয়া মুখপানে
বাছার চাঁদমুখে খেতেছে শত চুমো।
পুলকে পুরে প্রাণ, শিহরে কলেবর,
প্রেমের ডাক শুনি এসেছে চরাচর--
এসেছে রবি শশী,এসেছে কোটি তারা,
ঘুমের শিয়রেতে জাগিয়া থাকে যারা।
পরান পুরে গেল হরষে হল ভোর
জগতে যারা আছে সবাই প্রাণে মোর।
প্রভাত হল যেই কী জানি হল এ কী!
আকাশপানে চাই কী জানি কারে দেখি!
প্রভাতবায়ু বহে কী জানি কী যে কহে,
মরমমাঝে মোর কী জানি কী যে হয়!
এসো হে এসো কাছে সখা হে এসো কাছে--
এসো হে ভাই এসো,বোসো হে প্রাণময়।
পুরব-মেঘমুখে পড়েছে রবিরেখা,
অরুণ-রথ-চূড়া আধেক যায় দেখা।
তরুণ আলো দেখে পাখির কলরব--
মধুর আহা কিবা মধুর মধু সব!
মধুর মধু আলো, মধুর মধু বায়,
মধুর মধু গানে তটিনী বয়ে যায়!
যে দিকে আঁখি চায় সে দিকে চেয়ে থাকে,
যাহারি দেখা পায় তারেই কাছে ডাকে,
নয়ন ডুবে যায় শিশির-আঁখি-ধারে,
হৃদয় ডুবে যায় হরষ-পারাবারে।
আয় রে আয় বায়ু, যা রে যা প্রাণ নিয়ে,
জগৎ-মাঝারেতে দে রে তা প্রসারিয়ে।
ভ্রমিবি বনে বনে, যাইবি দিশে দিশে,
সাগরপারে গিয়ে পুরবে যাবি মিশে।
লইবি পথ হতে পাখির কলতান,
যূথীর মৃদুশ্বাস, মালতীমৃদুবাস--
অমনি তারি সাথে যা রে যা নিয়ে প্রাণ।
পাখির গীতধার ফুলের বাসভার
ছড়াবি পথে পথে হরষে হয়ে ভোর,
অমনি তারি সাথে ছড়াবি প্রাণ মোর।
ধরারে ঘিরি ঘিরি কেবলি যাবি বয়ে
ধরার চারি দিকে প্রাণেরে ছড়াইয়ে।
পেয়েছি এত প্রাণ যতই করি দান
কিছুতে যেন আর ফুরাতে নারি তারে।
আয় রে মেঘ, আয় বারেক নেমে আয়,
কোমল কোলে তুলে আমারে নিয়ে যা রে!
কনক-পাল তুলে বাতাসে দুলে দুলে
ভাসিতে গেছে সাধ আকাশ-পারাবারে।
আকাশ, এসো এসো, ডাকিছ বুঝি ভাই--
গেছি তো তোরি বুকে, আমি তো হেথা নাই।
প্রভাত-আলো-সাথে ছড়ায় প্রাণ মোর,
আমার প্রাণ দিয়ে ভরিব প্রাণ তোর।
ওঠো হে ওঠো রবি,আমারে তুলে লও,
অরুণতরী তব পুরবে ছেড়ে দাও,
আকাশ-পারাবার বুঝি হে পার হবে--
আমারে লও তবে, আমারে লও তবে।
জগৎ আসে প্রাণে, জগতে যায় প্রাণ
জগতে প্রাণে মিলি গাহিছে একি গান!
কে তুমি মহাজ্ঞানী, কে তুমি মহারাজ,
গরবে হেলা করি হেসো না তুমি আজ।
বারেক চেয়ে দেখো আমার মুখপানে--
উঠেছে মাথা মোর মেঘের মাঝখানে,
আপনি আসি উষা শিয়রে বসি ধীরে
অরুণকর দিয়ে মুকুট দেন শিরে,
নিজের গলা হতে কিরণমালা খুলি
দিতেছে রবি-দেব আমার গলে তুলি!
ধূলির ধূলি আমি রয়েছি ধূলি-'পরে,
জেনেছি ভাই বলে জগৎ চরাচরে। ”
শুভ নববর্ষ ১৪২২ সকলকে... বাঙ্গালী সাদা-লালে আবার একটি নতুন বৈশাখকে তাদের প্রাণের উৎসব হিসেবে বরণ করুক... সকলের জন্য অনেক অনেক প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৩:০৭