গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনাভাইরাস যখন প্রথম দেখা দেয় তখন চীন ছাড়া বাকি দেশগুলোর তেমন গরজ ছিল না। চীনে যখন মানুষ মরছিল তখন বেশির ভাগ দেশের ধারণা ছিল "আমাদের এখানে আসবে না"। এমন ভাবনার কিছু যৌক্তিক কারণ ছিল। কারণ এর আগের কোন ভাইরাসই এভাবে দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়েনি। সেজন্য সবার মধ্যে একটা গা-ছাড়া ভাব ছিল। যাইহোক তখন কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি সামনে কি ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে।
চীন প্রথমে ভড়কে গেলেও খুব দ্রুত তারা ঘুরে দাড়ায়। একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পুরো সুবিধা পায় দেশটি। লকডাউন মানে লকডাউন। কোন ধানাইপানাই চলবে না। সরকার নিজেই ঘরে ঘরে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া কিট এবং অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী যথেষ্ট ছিল চীনের। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই তারা একটা ভালো অবস্থানে পৌঁছে যায়। তবুও করোনা চীনকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ৫হাজারের কাছাকাছি মানুষ মারা যায়। যদিও আমেরিকা এ সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার বলে ধারণা করে।
করোনার বিশ্বযাত্রাঃ
চীন থেকে ভাইরাস প্রথমে যায় ইউরোপে। ইউরোপ শুরুতে গুরুত্ব দেয়নি। এর মাশুল খুব দ্রুতই দিতে হয়। একে একে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, বেলজিয়াম, জামানীসহ অনেক দেশ টালমাটাল হয়ে যায়। ইউরোপ উন্নত বিশ্ব হিসেবে পরিচিত। কিন্তু করোনা তাদের একেবারে ৩য় বিশ্ব বানিয়ে ছেড়েছে। মনে হচ্ছে করোনা আমাদের দেশীয় নকশাল আন্দোলনের মত "ধনীক শ্রেণিকে খতম করো" মতবাদে বিশ্বাসী। যাইহোক করোনার ছোবলে এখনো ইউরোপ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। মোট মৃত্যুর ৮০% ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নতবিশ্বে। সত্যি তাদের এমন বেহাল দশা এর আগে কবে হয়েছিল তা এক গবেষণার বিষয়।
ইউরোপ থেকে করোনার নেক্সট গন্তব্য আমেরিকা। যদিও ট্রাম্প বারে বারে চীনকে দোষারোপ করছে; ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে জলঘোলা করছে। ষরযন্ত্র তত্ত্ব পুরোটা রাজনৈতিক এবং প্রতিহিংসা। কিন্তু সত্যি হলো আমেরিকায় করোনার বিস্তার ঘটেছে ইউরোপ থেকে। সিএনএন এর একটা প্রোগ্রামে আমি নিজ কানে শুনেছি এটা। যাইহোক, ট্রাম্প প্রথমে এটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। নরমাল ফ্লু হিসেবে চিহ্নিত করে একে। সেজন্য প্রস্তুতিও যথেষ্ট ছিল না। অবশ্য কিটসহ অন্যান্য সামগ্রী তাদের ছিলও না। পরে সেই চীন থেকেই এনেছে। নরমাল ফ্লু এর মত সেই করোনা আমেরিকার মাটিতে রীতিমতো প্রলয়নাচন দেখাচ্ছে। এখনো আমেরিকার অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। মোট মৃত্যুর প্রায় ২৫% আমেরিকার। প্রায় লাখখানেক মানুষ ইতিমধ্যে মারা গেছে। সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও বাড়বে।
এরপর একই সাথে করোনা ল্যাতিন আমেরিকা এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশে প্রবেশ করে। এভাবে সুপাসনিক গতিতে বিশ্বের প্রতিটি কোণে কোণে পৌঁছে গেছে করোনাভাইরাস। কোন দেশই প্রাথমিকভাবে একে গুরুত্ব দেয়নি। যখন বুঝতে পেরেছে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ এবং করোনাঃ
বাংলাদেশও অন্যান্য দেশের মতোই প্রথম দিকে গুরুত্ব দেয়নি। তবুও অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে শুরুর দিকে আমাদের রেসপন্স ভালো ছিল। মার্চের একুশ তারিখে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। ভালোই চলছিল। কিন্তু গরীব দেশ হলে যায়। জীবন জীবিকা এবং সরকারের নিজের প্রয়োজনে লকডাউন শিথিল করে দিল। এটা এমন সময় করা হলো যখন পরিস্থিতি সবচেয়ে জটিল। প্রতিদিন গড়ে দেড় দুই হাজার করে শনাক্ত হচ্ছে; মারা যাচ্ছে গড়ে বিশজন মানুষ। এহেন পরিস্থিতি উপেক্ষা করে রাস্তায় প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষ বের হচ্ছে তাতে করোনার 'কাকে রেখে কাকে ধরব' অবস্থা। বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে করোনা নিজে লকডাউনে আছে; আর মানুষ করোনাকে খুঁজছে। আল্লাহ রহম করো।
পতন কবে?
করোনা নিয়ে সারাবিশ্বের সবার প্রেডিকশন ভুল ছিল। প্রথমে কেউই গুরুত্ব দেয়নি। এর মাশুল দিতে হচ্ছে সবাইকে। এখন আবার করোনা কখন শেষ হবে এই নিয়েও দ্বিধায় পরেছে। একবার বলা হলো 'এই তো মাস কয়েকের মধ্যে চলে যাবে'। কিন্তু করোনা যাওয়ার নামগন্ধ নেই। বরং আরও ছড়িয়ে যাচ্ছে। করোনা নিয়ে সবশেষ কথা হলো এটা সহসা যাবে না। একে নিয়েই চলতে হবে। ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে উঠে পরে লেগেছে গোটা বিশ্বের বাঘা বাঘা সব চিকিৎসা বিজ্ঞানী। কিন্তু একটা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য মিনিমাম ৯-১৮ মাস সময় লাগে। তবুও কোন কিছুই নিশ্চিত না। এর আগের অনেক ভাইরাসের টিকা এখনো পাওয়া যায়নি।
এত উৎকর্ষতা, এত উন্নত প্রযুক্তি নিয়েও কেন মানুষ পারছে না? গোটা বিশ্বে অন্তত কয়েকশো নোবেল লরিয়েট চিকিৎসা বিজ্ঞানী আছেন। কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালা হচ্ছে। তবুও পারছে না কেন? এর একটাই কারণ; মানুষের সীমাবদ্ধতা। মানুষ চাইলেই সব পারে না। ইচ্ছে করলেই হয় না। বরং মানুষ বেশিরভাগ সময়ই প্রকৃতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে। তিক্ত হলেও এটাই সত্যি।
তবে মানুষের প্রচেষ্টা অব্যহত আছে। হয়তো একদিন এসেও যাবে ভ্যাকসিন। ততদিনে হয়তো আরেকটি ভাইরাস এসে বিশ্বকে অস্থির করে তুলবে। এটা অনেকটা এমন যে, একজন সুপার ট্যালেন্ট শিক্ষক তার অনুগত, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষার্থীকে একটা অংকের সমাধান করতে দেয়। শিক্ষার্থী সেটার সমাধান করতে না করতেই আরেকটা সমস্যা এসে হাজির। এভাবে চলছে তো চলছেই। এই খেলার যেন শেষ নেই।
শেষ কথাঃ
মানুষ যেটা ভাবে, যেটা প্রেডিকশন করে সেভাবে কিছু হয় না। মানুষ শুধু বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অনুমান করতে পারে, ধারণা দিতে পারে। কিন্তু এটা 'ঘটবেই' বা 'হবে না' এটা জোর দিয়ে বলতে পারে না। বরং মহান স্রস্টা যেটা ভাবেন সেভাবেই সব হয়। পবিত্র কুরআনের সুরা আল্লাহ বলেছেন, "
“তোমাদের ইচ্ছে করলেই হবে না, যদি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ ইচ্ছে না করেন"। [সূরা তাকবীর, আয়াত: ২৯
আল্লাহর ইচ্ছেগুলো অন্যরকম। সূরা আল বাকারা (البقرة), আয়াত: ১১৭ এ আল্লাহ বলেনঃ
অর্থঃ তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোন কার্য সম্পাদনের সিন্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে একথাই বলেন, ‘হয়ে যাও’ তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়।
করোনার ছোবল থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করো প্রভু!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২০ রাত ১০:২০