“১০ বছরের এক ফুটফুটে মেয়ে অনামিকা। কঠিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত সে। জরুরী ভিত্তিতে তার ‘ও’ নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন। সে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। আপনার দেয়া এক ব্যাগ রক্ত বাঁচিয়ে দিতে পারে ফুলের মত নিস্পাপ, মৃত্যুপথযাত্রী এই শিশুটির জীবন। আসুন হাত বাড়িয়ে দেই একজন শিশুর জন্য”।
উপরের বিজ্ঞাপনটি নমুনা মাত্র। কিন্তু এ রকম বিজ্ঞাপন বা আকুতি আমরা নিয়মিত দেখতে পাই। সংকটময় সময়ে প্রয়োজনীয়, কাংখিত এক ব্যাগ রক্ত পাওয়া যে কত কঠিন তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। আর সে রক্ত যদি নেগেটিভ (-ve) গ্রুপের হয় তাহলে তো রক্ষাই নেই। বর্তমানকালে রক্তদাতা একেবারে ‘নাই’ বলা না গেলেও একে ‘সুলভ’ অবশ্যই বলা যাবে না। আর এটা যখন নেগেটিভ রক্ত হয় তখন তা সত্যি তা দুর্মূল্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কারণ নেগেটিভ রক্ত খুব কম। অনেক সময় দেখা যায় কঠিন রোগের সুচিকিতসার জন্য অনেক ব্যাগ নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন হয়।
আমাদের দেশে রক্ত নিয়ে কাজ করে এমন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে। তবে শুধুমাত্র নেগেটিভ O(-ve) গ্রুপের রক্ত নিয়ে কাজ করে এমন কোন সংগঠনের ব্যাপারে কেউ জানেন কি? সেই খবর দিতেই আজকের আয়োজন।
আপনারা জেনে খুব আনন্দিত হবেন যে, শুধুমাত্র নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত নিয়ে কাজ করে এমন একটা সংগঠন আপনাদের দোড়গোড়ায় হাজির। গত ৫/৬ বছর যাবত কাজ করছে Centre for Negative Blood-Group Response and Research (CNBRR) নামের প্রতিষ্ঠানটি। অনেকেই হয়ত এই এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির নামও জানেন না। এটাই স্বাভাবিক। তবে বিগত সময়গুলোতে বেশ সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
শুরুর কথাঃ
এই সংগঠনের একজন অন্যতম রুপকারের একবার এক কঠিন অসুখ হয়। এক পর্যায়ে তার অনেক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে এত নেগেটিভ রক্ত? এক চরম, কঠিন সময় পাড় করতে হলো তাকে। নেগেটিভ রক্ত আর পাওয়া যায় না। ডাক্তার আশা প্রায় ছেড়েই দিলেন। কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সেড়ে উঠলেন। এই অসুখই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। তিনি নেগেটিভ রক্ত সহজলভ্য কিভাবে করা যায় তাই নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। সেই চিন্তার ফসলই CNBRR ।
বর্তমান সময়ের সংকটময় রক্ত সম্পর্কিত রোগের সম্প্রসারণ এবং মুমূর্ষু অবস্থায় প্রয়োজনীয় রক্তের যোগান দেয়ার মানবিক প্রেক্ষাপটে Centre for Negative Blood-Group Response and Research (CNBRR) বাংলাদেশ-র আত্বপ্রকাশ। উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জরিপে দেখা যায় যে, শতকরা ৯৫% মানুষের রক্ত পজিটিভ গ্রুপের এবং বাকী ৫% নেগেটিভ গ্রুপের। ‘এ’, ‘বি’, ‘এবি’ এবং ‘ও’ পজিটিভ গ্রুপের মধ্যে ‘ও’ সর্বাধিক এবং ‘এবি’ সর্বনিম্ন হারে বিদ্যমান। দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ও রোগের বা সার্জিক্যাল অপারেশনের কারণে রক্তের প্রয়োজন হলে, বিশেষ করে নেগেটিভ রকের অপ্রতুলতার জন্যে আমাদের অনেক প্রিয়জনকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়।
নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত সুপ্রাপ্ততার জন্য বাংলাদেশে CNBRR ভিন্ন অন্য কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তাই যে কোন সংকটময় মুহূর্তে বিনামূল্যে রক্তদান করা ও রক্তদানে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ তাদের সুচিকিতসার বন্দোবস্ত করার পাশাপাশি মানব কল্যাণে অবদান রাখা এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য।
সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ
সদস্যদের একে অপরের মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব গড়ে তোলা।
কোন মানুষের সংকটময় মুহূর্তে রক্ত সংগ্রহে সহায়তা করা।
রক্তদানের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ তাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া।
রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, রক্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য একটি সংরক্ষণাগার প্রতিষ্ঠা করা।
রক্ত পরিসঞ্চালন সম্পর্কিত একটি বিশেষায়িত চিকিতসা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা।
স্বাস্থ্য ও পুস্টি সম্পর্কিত তথা স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, গবেষণামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা ইত্যাদি।
কোন কোন ক্ষেত্রে রক্তের প্রয়োজন হয়:
যেকোন দুর্ঘটনায় অত্যধিক রক্তক্ষরণ হলে, যেমন সড়ক দুর্ঘটনা, প্রসবোত্তর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি। বিভিন্ন রোগ, যেমন লিউকেমিয়া, ক্যান্সার, ডেঙ্গু, অতিরিক্ত রক্তশুন্যতা, বড় ধরণের অপারেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষভাবে রক্তের প্রয়োজন হয়। যা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে সুস্থ্য করা দুরহ হয়ে ওঠে।
রক্তদানে যারা সক্ষম
যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা মহিলা সুস্থ, স্বাভাবিক শরীরে ৩ থেকে ৪ মাস পর পর একবার করে রক্ত দিতে পারে। রক্ত দিতে চাইলে রক্ত দাতাকে অবশ্যই নিচের তথ্যগুলো জানতে হবে:
• বয়স ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে হতে হবে
• শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে
• রক্ত দেওয়ার মধ্যে ৪ মাস বিরতি থাকতে হবে
• শারীরিক ওজন কমপক্ষে ৪৫ কেজি বা এর বেশি হতে হবে
• রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ, পালস ও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকতে হবে
• শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ থেকে মুক্ত হতে হবে
• চর্মরোগ মুক্ত থাকতে হবে, রক্তবাহিত রোগের বাহক হলে রক্ত নেওয়া যাবেনা।
এছাড়াও, হৃদরোগ, ক্যান্সার, রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা, ডায়াবেটিস, হেপাটাইটিস-বি, এইডস, যক্ষা, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা অন্যদের রক্ত দিতে পারবেন না।
তবে কিছু রোগ আগে যেগুলোতে আক্রান্ত রোগীরা নির্দিষ্ট সময় পর রক্ত দিতে পারেন। যেমন, টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগী-১২ মাস, ম্যালেরিয়ার রোগী-তিন মাস পর রক্ত দিতে পারবেন।
রক্ত দেওয়ার সময় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যেন জীবানুমুক্ত সুই ব্যবহার করা হয়। রক্ত দেওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে হবে এবং বেশি পরিমাণে স্বাভাবিক পানি এবং পানীয় খেতে হবে।
রক্তের গ্রুপ জানার প্রয়োজনীয়তা এবং সতর্কতাঃ
রক্তের গ্রুপ জানা থাকলে পরিবার, আত্বীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথেও রকের গ্রুপের মিল আছে কি না তা আগে থেকেই অবগত হওয়া যায়, যার ফলে আকস্মিক দুর্ঘটনা অথবা যে কোন ধরণের জরুরী পরিস্থতিতে রক্তের প্রয়োজন মেটাতে সহজেই রক্তদাতার সহযোগিতা পাওয়া যায়। পাশাপাশি নানাবিধ ঝামেলা এড়ানো সম্ভব হয়।
সদস্য হওয়ার উপযুক্ততা:
যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ, যার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ তিনি এই সংগঠনের সদস্য হতে পারেন [রক্তদানে যারা সক্ষম দ্রস্টব্য]। উপযুক্ত সদস্য অন্যের প্রয়োজনে রক্তদানে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবেন এবং সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রমে সাধ্যানু্যায়ী সক্রিয় অংশগ্রহণ করবেন। একটা নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে এর সদস্যপদ লাভ করতে হবে। নতুন সদস্যকে একটা কার্ড প্রদান করা হয়। উপযুক্ত সকলকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি নিজের সদস্যপদ নিশ্চিত করার জন্য।
CNBRR এর বর্তমান কার্যক্রমসমূহঃ
মানুষের প্রয়োজনে আপদকালীন সময়ে রক্ত সংগ্রহে সাহায্য করা ও সার্বিক চিকিত্সায় সহযোগিতা করা; সমাজে সকল শ্রেণির মানুষকে রক্তের গ্রুপ জানতে ও রক্তদানে উত্সাহিত করা; সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লিফলেট, সাময়িকী প্রকাশ করা ও সেমিনারের আয়োজন করা; সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ করার নিমিত্তে বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্যাম্পেইন করা; সংগঠনটির শাখা বিস্তারের জন্য বিভিন্ন জেলা কমিটি গঠনের কাজ এগিয়ে নেয়া ইত্যাদি।
কাজের ধরণঃ
মূলত সম্মানিত সদস্যদের একটি ডেটাবেজ সংরক্ষণ করা এবং প্রয়োজনের সময়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করাই এর মূল কাজ।
পরিশ্রমের সুফলঃ
গত কয়েক বছরের প্রাণান্ত পরিশ্রমের সুফল পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘২৫০ শয্যা বিশিস্ট টিবি হাসপাতাল’ শ্যামলীতে (পুরাতন ভবনে) CNBRR এর জন্য স্থায়ীভাবে তিনটি রুম বরাদ্দ দিয়েছেন। গত কয়েকদিন আগে মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এটি উদ্ভোদন করেছেন। এখন চলছে অফিসটাকে সুন্দর করে গোছগাছ করার প্রক্রিয়া।
কিভাবে চলে CNBRR?
এটা পুরোপুরি ভলান্টারি সার্ভিস। এখন অবধি এর সম্মানিত উদ্যোক্তা, সদস্য ও কিছু দানশীল ব্যক্তিদের নিজস্ব টাকায় এর কার্যক্রম চলছে। সরকারীভাবে এর আগে কোন সাহায্য সহযোগিতা (বিশেষ করে আর্থিক) এখনো পাওয়া যায়নি। তবে চেস্টা করা হচ্ছে। কারণ এই প্রতিষ্টানের অন্যতম লক্ষ্য মানুষকে সেবাদানের পাশাপাশি রক্ত পরিসঞ্চালন সম্পর্কিত একটি বিশেষায়িত চিকিত্সা কেন্দ্র ও গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। কাজেই এর বাস্তবায়নের জন্য সরকারী সাহায্য-সহযোগিতা অপরিহার্য। এ ব্যাপারে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
আপনাদের অপেক্ষায় আছিঃ
সামু-র মাধ্যমে দেশের সকল মানুষের প্রতি আমাদের উদাত্ত আহবান, যাদের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ তারা অতি সত্তর নিজের সদস্যপদ নিশ্চিত করুন, আপনার অন্যদের উত্সাহিত করুন। আপনার অতি বিপদের সময়ে আমাদের সংগঠন আপনার পাশে থাকবে।
আমাদের সাথে যোগাযোগের ঠিকানাঃ
সেন্টার ফর নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপ রেসপন্স এন্ড রিসার্স (সিএনবিআরআর)
১/১ মাহবুব মোরশেদ সরণী, আগারাগাও
২৫০ শয্যা বিশিস্ট টিবি হাসপাতাল
শ্যামলী, ঢাকা।
(হাসপাতালে ঢুকতেই বাম দিকের প্রথম রুমটাই। আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি আমাদের অফিস ‘২৫০ শয্যা বিশিস্ট টিবি হাসপাতাল’-র পুরাতন বিল্ডিং-এ)।
আপনারা ফোনেও যোগাযোগ করতে পারেনঃ
মোবাইলঃ ০১৭৬১৮৯৮৩৮৫
০১৭৪০৫৭৩১৬৪ (দেবাশিষ)
রক্ত দেয়া মহৎ কাজ। আপনার-আমার দেয়া এক ব্যাগ রক্ত একজন মুমূর্ষু রোগীর নতুন জীবন দান করতে পারে। পাশাপাশি আপনার মহাসংকটময় সময়ে আমাদের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারে এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১১:৪২