বিয়ের আংটি যে অনামিকায় পরায় তাতো আমরা সবাই জানি। শুধু বিয়েই না, প্রেমিক-প্রেমিকা যখন একে অপরকে ভালোবেসে আংটি পরিয়ে দেয়, তখনও সাধারণত অনামিকা আঙ্গুলেই সেটা শোভা পায়। এটা কবে থেকে, কখন শুরু বলা মুশকিল, তবে চীনের উপকথায় এ সম্বন্ধে একটা চমৎকার উপাখ্যান আছে। যাঁরা চীনের মিথলজি মোটামুটি জানেন, তাঁদের বোধহয় জানা আছে কাহিনীটা…তাই আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
বহু, বহুকাল আগে চীনের জুয়ান পু অঞ্চলে এক শাসক ছিলেন, নাম তাঁর দাও জি। নিষ্ঠুরতার জন্যে তিনি ছিলেন অতি বিখ্যাত। রাজ্যের প্রজারা তো বটেই, পশুপাখিও দাও জি কে ভয় পেত। ফুকাংলং নামে প্রকাণ্ড ড্রাগন তাঁর কোষাগারকে পাহারা দিত। দাও জির ছিল চারজন স্ত্রী এবং নয়টি সন্তান। এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট কন্যাটিকে রাজা সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন, নাম তার মিং দি।
মিং দির চরিত্র ছিল তার বাবার ঠিক উলটো। সে ছিল অমায়িক, মিষ্টভাষী এবং পরমাসুন্দরী। এই মেয়েটির জন্যে রাজ্যের সব যুবকরা পাগল ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে মিং দির জন্যে বিয়ের প্রস্তাব আসত। কিন্তু রাজা এ ব্যাপারে খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন, পাত্রটি একেবারে মনের মতো না হলে তিনি কিছুতেই মেয়ের বিয়ে দেবেন না।
জুয়ান পু রাজ্যের পাদদেশে এক ছোট্ট গুহায় থাকত তরুণ জাদুকর নি ঝা। প্রচারবিমুখ এই জাদুকর অতি অল্প বয়সেই তার বামন বাবার কাছ থেকে জাদুবিদ্যায় পারদর্শী হয়েছিল। রাজ্যের বিপদে-আপদে নি ঝার ডাক পড়ত দাও জির দরবারে। কতোবার যে কতো বিপদ আপদ থেকে জুয়ান পু-কে রক্ষা করেছে নি, তার ইয়ত্তা নেই। রাজপ্রাসাদের তাই নি ঝার আনাগোনা মোটামুটি ভালই ছিল। এমনি আনাগোনার মধ্যেই হঠাৎ একদিন তার সাথে দেখা হয়ে গেল রাজকুমারী মিং দির। ব্যস, আর যায় কোথায়! একবার দেখেই বুঝে নিল নি ঝা, এই কন্যাকে ছাড়া তার জীবন চলবে না। যেভাবেই হোক মিং দিকে তার চাই-ই চাই!
দশ সহস্র জাদুবিদ্যায় পারদর্শী নি ঝার মিং দির মন পেতে বেশি সময় লাগল না। নারীর মন বশ করার উপায় তার ভালই জানা ছিল। ধীরে ধীরে এই দুজনের মধ্যে গভীর প্রণয় গড়ে উঠল।
মিং দি ছিল অন্তপুরের বন্দী, তার সাথে দেখা করা খুব সুহজ নয়। তাই অন্য একটা উপায় বের করেছিল নি ঝা। একজোড়া আংটিকে জাদু করে তার একটি দিয়েছিল মিং দি কে, আরেকটি রেখেছিল নিজের কাছে। দুজনেরই হাতের অনামিকায় পরা থাকত সেই আংটি। যে কোন সময় তারা এই আংটির মাধ্যমে একজন আরেকজনের সাথে কথা বলতে পারত। মিং দির তার প্রেমিককে খুব মনে পড়লেই সে আংটির মধ্যে দিয়ে নি ঝা কে ডাকত, নি ঝাও সে ডাকে আংটির মাধ্যমে সাড়া দিত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সে সময় চীনের নীতি ছিল সকল অভিজাত মানুষ মধ্যমা আঙ্গুলে তার পিতার নাম ও নিজের নাম খোদাই করা একটি আংটি পরবে।
তো, মিং দি আর নি ঝার বেশ ভালই যাচ্ছিল। চারদেয়ালের মাঝে বন্দী থেকেও নিয়মিত নি ঝাকে আপন করে পেত মিং দি। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাজা দাও জি তার কন্যার এই অভিসারের কাহিনী জেনে ফেললেন। আর যায় কোথায়! ডাকো বিশ্বাসঘাতক নি ঝাকে!
নি ঝাকে রাজার সামনে হাজির করা হল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে রাজা আদেশ দিলেন, ‘গর্দান নাও এই বিশ্বাসঘাতকের! কোথাকার বামনের সন্তান হয়ে আমার মেয়ের সাথে …এতো সাহস তার হয় কি করে!’
‘থামুন,’ রাজার সামনে দাঁড়িয়ে শান্তকণ্ঠে বলল নি ঝা। তার কথা শুনে যেন আগুন ধরে গেল দাও জির মাথায়। এত্তোবড় সাহস এই ছেলের, তার মুখে মুখে কথা বলে! তিনি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই আবার নি ঝা বলল, ‘আমার গর্দান নেয়া আপনার ও আপনার রাজ্যের জন্যে মঙ্গলজনক হবে না।'
প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ দাও জি তক্ষুণি নিজের তলোয়ারটি দিয়ে নি ঝার মুণ্ডু ঘ্যাচাং করে কেটে ফেললেন। চিৎকার করে বললেন, ‘ভাল মন্দ তোর থেকে শিখতে হবে বামনের সন্তান??’
প্রাণপ্রিয় প্রেমিকের শোকে সেই রাতে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেল রাজকুমারী মিং দি। অজ্ঞান অবস্থাতেই সে একটা স্বপ্ন দেখল। সেখানে নি ঝা তাকে হাসিমুখে বলল, ‘তোমার যখনি আমাকে খুব মনে পড়বে, আংটির দিকে তাকিয়ে একইভাবে আমাকে স্মরণ কোরো। আমি ঠিক আগে মতো তোমার কাছে হাজির হয়ে যাবো।‘
সাথে সাথে জ্ঞান ফিরল মিং দির। সে ঠিক আগের মতো আংটিতে চুমু খেয়ে বলল, ‘প্রিয়তম…’
আর তক্ষুণি প্রকাণ্ড ভূমিকম্পে সারা জুয়ান পু রাজ্য কেঁপে উঠল। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল রাজা দাও জির রাজপ্রাসাদ। সারা রাজ্য অন্ধকারে ঢেকে গেল, প্রকাণ্ড প্রলয়ে সব ঘরবাড়ি, গাছ-পালা ভেঙে ছারখার হল। সারা রাজ্যের সমস্ত মানুষ মারা গেল।
শুধু বেঁচে রইল রাজকন্যা মিং দি। এই সময় সেই ধ্বংস্তূপ থেকে হাসিমুখে ধীরে ধীরে হেঁটে এল নি ঝা। তার হাতে শোভা পাচ্ছে অনেকগুলো ঝলমলে বিরাট আংটি। হতভম্ব মিং দি তাকে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে।
উত্তরে নি ঝা বলল, ‘এই অত্যাচারী রাজার দিন শেষ হয়েছে প্রিয়তমা। আমি তার সম্পূর্ণ রাজ্য শেষ করে দিয়েছি। আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল সে…এর শাস্তি সে সারাজীবন পাবে। এই দ্যাখো, আমার পাঁচ আঙ্গুলে তোমাদের পরিবারের সবাইকে আমি বন্দী করে নিয়েছি। এই বৃদ্ধাঙ্গুলির আংটিতে সারাজীবনের মতো বন্দী রয়েছে তোমার পিতা ও মাতা। তর্জনীর আঙ্গুলে রয়েছে তোমার আট ভাইবোন, আর এই দেখো…অনামিকায় রয়েছ তুমি…সেই যে তোমার সাথে যে আংটি দিয়ে যোগাযোগ করতাম, সেই আংটি…’
মিং দি আরো জানল, ডান হাতের আঙ্গুলগুলোয় রয়েছে সব পুরুষরা অর্থাৎ পিতা, ভাইরা এবং বাম হাতের আঙ্গুলের আংটিতে রয়েছে মাতা, বোনেরা…
নি ঝা এরপর মিং দিকে নিয়ে দূর দেশে চলে গেল। পড়ে রইল জুয়ান পু রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ।
এদিকে দাও জি রাজার বিশ্বস্ত ড্রাগন ফুকাংলংই শুধু সেই প্রলয় থেকে বেঁচে গিয়েছিল। সে পরবর্তীতে সবই দেখেছে। নি ঝাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে সে তার ৮ জন ড্রাগন সঙ্গী নিয়ে নি ঝার পিছু নিল। এরা 'নাইন ড্রাগন' নামে পরিচিত।
আসন্ন বিপদের কথা আগেভাগেই টের পেল নি ঝা। মনে মনে সে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিল। উল্লেখ্য, ততোদিনে তাদের দুটি যময সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়েই সে বেশি বিচলিত হল। অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষে মিং দিকে তার ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুলের আংটিতে আর দুই সন্তানকে দুই হাতের কেনে আঙ্গুলে ভরে রাখল, যাতে ড্রাগন তাদের কোন ক্ষতি করতে না পারে।
দিভু নামক পর্বতমালায় সেই নয় ড্রাগনের সাথে প্রকাণ্ড যুদ্ধে অবতীর্ণ হল নি ঝা। কিন্তু তার সর্বোচ্চ জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করেও সে যুদ্ধে জিততে পারল না নি ঝা। তাই সে নিজেই প্রাণের ভয়ে একটি আংটির মধ্যে লুকিয়ে পড়ল।
ড্রাগনেরা শেষে নি ঝা কে হত্যা করতে না পেরে তার সব সম্পদ লুটপাট করে হাতে তাদের মালিকের কাছে নিয়ে গেল। ফুকাংলংদের মালিক ছিল শেন দ্বীপের রাজা। সেই রাজা নি ঝার ঝলমলে আংটি দশটি দেখে অভিভূত হয়ে পড়লেন, এবং তৎক্ষণাত নিজ আঙুলে সবগুলো পরে ফেলার চেষ্টা করলতে লাগলেন। অবাক করার বিষয় হল সব আঙুলে সব আংটি ঢুকছিল না। রাজা অনেকভাবে মিলিয়ে শেষে আংটিগুলো পরতে পারলেন।
তিনি অবশ্য জানতেন না মিং দির বাবা-মা যে আংটিতে আছে, সে আংটি বৃদ্ধাঙ্গুল ছাড়া অন্য কোথাও ঢুকবেনা। তেমনিভাবে বাকি আঙুলের আংটিগুলো নি ঝার হাতে যেভাবে ছিল, ঠিক সেভাবেই ঢুকল শেন রাজার হাতে।
কিন্তু এরপরই ঘটল বিপত্তি। রাজা প্রার্থনার সময় হাতজোড় করতেই তাঁর অনামিকা আঙুল দুটি মিলে গেল। এমনভাবেই মিলল, আর ছুটল না। রাজ্যের যত কবিরাজ-বদ্যি এল, জাদুকর এল, কেউ আর সেই দুটি আঙুল ছাড়াতে পারল না।
বলা বাহুল্য, তাঁর ডানহাতের অনামিকায় ছিল নি ঝা, এবং বাম হাতের অনামিকায় ছিল মিং দি! সেই যে তারা জোড়া লাগল, আর কখনো ছুটল না। পরে ফুকাংলংদের কাছ থেকে বিস্তারিত কাহিনী শুনে রাজা বুঝতে পারেন সব। অনেক চেষ্টা করেও জীবনে আর আঙুলদুটো আলাদা করতে পারেননি শেন রাজা। ওই অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। মারা যাবার পরও তাঁর আঙুল দুটো আলাদা করা যায়নি!
এই হল আমাদের মিথ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর বাস্তব একটা প্রতিফলন নিচের ছবির মতো হাতে আঙুলগুলো জড়ো করলেই দেখতে পারবেন!
বৃদ্ধাঙুলি হচ্ছে আপনার বাবা-মা, তর্জনী ভাই-বোন, মধ্যমা আপনি নিজে, অনামিকা আপনার স্ত্রী এবং কেনে আঙুল হচ্ছে আপনার সন্তান।
বাবা-মা সারাজীবন আপনার সাথে থাকতে পারবেন না, কোন না কোনদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন। তাই বৃদ্ধাঙ্গুলি দুটি সহজেই আলাদা করা যায়। তর্জনী আপনার ভাই-বোন, তারাও একসময় নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। তাই তর্জনীও আলাদা করা যায়। কনিষ্ঠ আঙুল আপনার সন্তান, সেও কোন না কোন সময় নিজে জীবন নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এভাবে আলাদা করে দেখার পর আঙুলগুলো পূর্বের মতো লাগিয়ে ফেলুন। মধ্যমা আঙুল আপনি নিজে, তাই সেটা ছবির মতো করে গুটিয়ে নিন।
এবার দেখুন তো আপনার স্ত্রীকে, অর্থাৎ অনামিকা আঙুলদুটোকে আলাদা করা যায় কিনা! কি, পারছেন??
ঠিক এভাবেই আপনার প্রিয়জন সারাজীবন আপনার পাশে থাকবে, শত চেষ্টা করেও তাকে ছাড়তে পারবেন না!
এই কারণেই অনামিকায় বিয়ের আংটি পরানো হয় কিনা কে জানে! তবে হ্যাঁ, অনেকে আছেন জোর করে আঙুল দুটো আলাদা করার চেষ্টা করতে থাকেন (যদিও জোর করেও আঙুল দুটো আলাদা করা সম্ভব না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আঙুল কিছুটা হলেও ছবির ব্যতিক্রম না করছেন), বুঝতে হবে তাদের বউয়ের প্রতি ভালবাসায় তাদের ঘাটতি আছে!!
এছাড়া অনামিকা আঙুলের সাথে ‘ভেনা আমোরিস’ শিরার মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের সরাসরি যোগাযোগ আছে, এ কারণেও অনামিকা আঙুলে বিয়ের আংটি পরানো হয়ে থাকতে পারে!
তাই বলা যায়, নি ঝা সাহেবের মিথে বিশ্বাস না করলেও অনামিকায় আংটি পরানোর পেছনে খুব চমৎকার একটা যুক্তি রয়েছে। আশা করি কেউ জোর করে অনামিকাকে আলাদা করার চেষ্টা করে প্রিয়জনের প্রতি ভালবাসার ঘাটতি প্রকাশ করার চেষ্টা করবেন না!
জুড়ে থাকুক অনামিকা দুটি সকলের…সারাজীবন…