রবীন্দ্রনাথের কম লেখাই আছে আমি পড়িনি। তার জীবন নিয়ে আমার অনেক আগ্রহ। যেখানেই কোনো তাঁর সম্বন্ধে কোনো লেখা দেখি, এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলি। এভাবে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে অনেক কিছুই জেনেছি। আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, তাঁর জীবন সম্বন্ধে আমরা সবাই কমবেশি জানলেও তাঁর পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধে খুব বেশি জানিনা। কিন্তু সেখানেও রয়েছে চমৎকার এক ইতিহাস। আমাদের সৌভাগ্য, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রচেষ্টায় ঠাকুর বংশের ইতিহাস মোটামুটি ভালোভাবেই রক্ষিত হয়েছে।কয়েক পর্বে আমি সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করব। আগেই বলে নিই, নির্দিষ্ট কোনো বই থেকে আমি এসব সংগ্রহ করিনি। রবিঠাকুরকে নিয়ে লেখা মৈত্রেয়ী দেবীর বিভিন্ন বই, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সেই সময়','প্রথম আলো' পড়লে গল্পের আমেজেই অনেক কিছু জানতে পারবেন। আমিও সেভাবেই লেখার চেষ্টা করছি। এছাড়া কৃষ্ণ কাপালানীর লেখা 'রবীন্দ্রনাথের বংশ পরিচয়' গ্রন্থটিতে যথাসম্ভব নিখুঁতভাবে এসব কাহিনী লেখা হয়েছে। তবে সমস্যা হল, বইটি একটু পুরনো সাধু ভাষায় লেখা, তাই পড়ার সময় রীতিমতো ধস্তাধস্তি করতে হয়। অতি আগ্রহের বশে আমি পড়ে ফেলেছি।
একটু বেশি আগে থেকেই শুরু করি।
দিল্লীর সিংহাসনে তখন জনদরদী মুঘল শাসক ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ। তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত যশোর-খুলনা-বাগেরহাট জেলার শাসক প্রখ্যাত পীর, সেনাপতি এবং ইসলাম প্রচারক উলুঘ খান জাহান আলী। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ইনিই খুলনা-যশোর শহরের প্রতিষ্ঠাতা, রূপকার এবং বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের নির্মাতা। তাঁর ফৌজের এক ব্রাহ্মণ কর্মচারী, যাঁর ডাকনাম সম্ভবত পিরল্যা, জন্ম হিন্দুদের পবিত্র নবদ্বীপ জেলায়। এই পিরল্যা কট্টর ব্রাহ্মণ হয়েও একদিন মহা অপরাধ করে ফেললেন। খান জাহান আলীর হারেমের এক পরমাসুন্দরী মুসলিম রমণীর প্রেমে পড়লেন। এমনই কঠিন প্রেম, সেই রমণীর জন্যে তিনি জাত-ধর্ম বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। নবদ্বীপের ব্রাহ্মণের জন্যে সেটা ছিল তখন অতি অচিন্তনীয় ব্যাপার। ব্রাহ্মণ, তারওপর নবদ্বীপের, বিবাহ করবে এক 'যবন','ম্লেচ্ছ' কন্যাকে (মুসলমানদের তখন এ গালি দেয়া হতো, যার সোজা অর্থ 'বাস্টার্ড'), এই পাপে সারা পৃথিবীও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে! কিন্তু কে শোনে কার কথা! সুদর্শন, গোঁয়ার, সাহসী সৈনিক পিরল্যা কয়েকশ বছরে ব্রাহ্মণদের মধ্যে সবচেয়ে অকল্পনীয় কাজ করে ফেললেন। ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করে ফেললেন সেই মুসলিম রমণীকে, যাঁর নাম সম্ভবত খিজরী বেগম।
সূফী পীর আলী (সংগৃহীত, তবে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য নয়)
খান জাহান আলী অতিশয় কঠিন শাসক হলেও তাঁর ছিল সুদূরপ্রসারী উদারদৃষ্টি। তিনি এই প্রণয়ে বাধা দিলেন না এবং বিয়ে মেনে নিলেন, যে কারণে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণেরা পিরল্যার বিরুদ্ধে তেমন কিছু করতে পারল না। বিয়ের পর পিরল্যার নাম হল মাহমুদ তাহির, কিন্তু ডাক নাম হয়ে গেল পীর আলী। এই পীর আলীকে খান জাহান আলী সূফীবাদের দীক্ষা দিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেওয়ানী কাজে নিয়োগ করলেন। ক্রমে পীর আলী জনপ্রিয় ও মান্যগণ্য হয়ে উঠলেন, তিনি উদারতার জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন।
চেঙ্গুটিয়া নামক এক হিন্দুপ্রধান গ্রামেও পীর আলীর জমিদারী ছিল। সেখানে তাঁর দেওয়ানী করতেন দুই ভাই, কামদেব ও জয়দেব। এক রমজান মাসে পীর আলী দরবার করছেন, এই সময় কামদেব কোনো এক কাজে দরবারে এসেছেন। লেবুর সুগন্ধের প্রতি পীর আলীর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তিনি সারাদিনই হাতে একটি লেবু রাখতেন ও মাঝে মাঝে গন্ধ শুঁকতেন। কামদেবের সামনেও তা করলেন। দেখে সাথে সাথে জিভ কাটল কামদেব,'উজির সাহেব, আপনার তো রোজা ভঙ্গ হয়ে গেল!' অবাক হলেন পীর আলী। তখন কামদেব বললেন,'আমাদের ধর্ম মতে ঘ্রানং-ই ভোজনং, তাই আপনার রোজা ভঙ্গ হয়ে গেছে,' কিছুটা রঙ্গের সুরেই বলল কামদেব।
এ কথা শুনে বেশ কৌতুক বোধ করলেন পীর আলী। মনে মনে এক ফন্দি আঁটলেন। ঈদের পরে একদিন গ্রামের সকল ব্রাহ্মণকে দাওয়াত করলেন দরবারে। তাদের শায়েস্তা করার জন্যে প্রায় একশত ষাঁড় জবাই করলেন, বিরাট বিরাট ডেকচিতে সেসব রান্না হতে লাগল। সব হিন্দুরা যখন খেতে বসেছে, তখন বিরাট বিরাট সব তীব্র সুঘ্রাণযুক্ত গো-মাংস তাদের কাছে হাজির করা হল। গো-মাংসের গন্ধ নাকে গিয়েছে, নরক তো নিশ্চিত! আর যদি কেউ আহার করে, তবে তো জাত-ধর্ম সব চলে যাবে! হিন্দু দাওয়াতীরা ছুট লাগাল। যে যেভাবে পারল পালিয়ে এল, কেউ অজ্ঞান হয়ে গেল, কেউ নাকে রুমাল দিল। এমনকি কয়েকজন ব্রাহ্মণ এই পাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যাও করে বসল।
কামদেব-জয়দেবও পালাচ্ছিল। পীর আলী তাদের চেপে ধরলেন। 'কী হে', মুচকি হাসলেন উজির,' তোমাদের না ঘ্রাণং ভোজনং? তাহলে তো ইতোমধ্যে জাত চলে গিয়েছে! অন্য ব্রাহ্মণরা তো তোমাদের ঝাঁটাপেটা করবে! আচ্ছা, তাদের নাকেও তো গন্ধ গিয়েছে, তাদের জাত যায়নি?' অট্টহাস্য হাসতে লাগলেন পীর আলী।
কামদেব-জয়দেব কী আর বলবে! তারা ভয়ে কাঁপতে লাগল। পীর আলী বললেন,' এক কাজ কর, আমার পাশে বসে এই অতি উপাদেয় খাদ্য গ্রহণ কর। কেন নিজেকে বঞ্চিত করবে! আমাদের ধর্মে চলে এসো...আমার হারেমের কন্যার সাথে তোমাদের বিবাহ দেব, জায়গীর দেব...'
ধর্মান্তরিত হল কামদেব ও জয়দেব। তাদের নতুন নাম হল কামাল উদ্দিন ও জামাল উদ্দিন।
পরের পর্ব