somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি সপ্তাহ , মৃত্যু ও আমরা

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১।

বেসিনের উপরের তাকে রাখা একটা কফি মগে আমার প্রাত্যহিক দরকারী জিনিসগুলো থাকে। ব্রাশ পেস্ট। গত এক সপ্তাহ ধরে দেখছি ওর গায়ে একটা সবুজ রঙের পোকা উলম্বভাবে ঝুলে আছে। পোকাদের বেলাও সৌন্দর্যবোধ করার ব্যাপার আছে। এই পোকাটার রঙে কচি ঘাসের ঘ্রাণমাখা। দরকারে বেদরকারে আমি যতবার ওখানে যাই ততবারই অক্লান্ত অধ্যবস্যায়ে ওটাকে ঝুলে থাকতে দেখি, একদম অনড়। একবার চোখ মেলে তাকাই তারপরে যে কাজে গিয়েছি সমাধা করে বের হয়ে আসি। ওটাকে নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। থাকুক ঝুলে অনন্তকাল ধরে। কিন্তু সেদিন সাবান বাক্সটা থেকে একটা কালচে মেরুন তেলাপোকা বের হলো আমি সাত তাড়াতাড়ি আঁতকে উঠে স্যান্ডেল পায়ে ওটাকে মারার জন্য ছোটাছুটি শুরু করলাম। বেচারা ভয়ে পালিয়ে যাবার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছিল তবু শেষ রক্ষা হলো না । ঠিকই পাদুকা চেপে ওটাকে মেরে ফেললাম। যদি নিজেকে বর্ণবাদী নাও মনে করি তবুও দেখতে কুৎসিত হওয়া ছাড়া ঐ তেলাপোকার আর কি অপরাধ ছিল? হলুদ টিকটিকিকে তো মারার জন্য উদ্যত হই না। মাছি, মশাও অপকারী তবু অনেকসময় স্রেফ আশপাশ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলেই যথেষ্ট মনে করি। পিঁপড়ার সারিকে খাবারে উঠে না পড়লে মারার চিন্তাও মনে আসে না। এমনকি সম্ভব হলে সরিয়ে মুছে তারপরে সিঙ্কে চুবাই।আসলে লুক্কায়িত অনেক গোপন কলঙ্ক আমাদের অজান্তে আমাদের সহযাত্রী হয়।


২।

ফ্রান্সে মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি ন্যাক্কারজনক দিন পার হলো। ১৩০ জনের মতো নিহত ,আহত ৩৫০ ।বেশী দিন হয়নি। ১৩ নভেম্বরের ঘটনা।তবু যেখানে পত্রিকা গুলোয় আজ দিন পার হলে গতকালকের খবর বাসি হয়ে যায়, সেখানে এতদিন পরেও পাতার পরে পাতা দখল করে রাখছে এ খবর। লেবাননেও এই ঘটনার ঠিক একদিন আগে একটি এরকম হামলা হয়। নিহত ৪০ জন ও আহত ২০০।দুটি ঘটনায় 'কৃতিত্বে'র দাবীদার একই - আই এস। ফ্রান্স অনেক আগে থেকেই মুসলিমদের প্রতি দমনমূলক ব্যবহার করে আসছে। অতএব ওদের প্রতি আক্রমণের কারণ বোঝা যায়। অনেকটা সম্ভবত কর্মের প্রতিফল।অপরদিকে লেবানিজ যে মানুষগুলো মারা গিয়েছে তারা খ্রিষ্টান প্রধান দেশ ফ্রান্সের মত না, অনেকেই মুসলিম। ইউরোপীয় দেশটির মতো ওদের বলার মতো কিছু নেই বলেই কি তারা মানুষ না? কোথাও তো কোন আন্দোলন ওঠে না ওদের জন্য। প্যারিসের ঘটনার প্রায় এক তৃতীয়াংশ নিহত হয়েছে ওদের। আহত সংখ্যাগতভাবে ফ্রান্সের অর্ধেকের উপরে (২০০:৩৫০)। তবু এই হতভাগ্যদের জন্য মিডিয়ায় , নীতিনির্ধারণে , মানুষের মনে এক ষষ্ঠমাংশও জায়গাও হলো না।

৩।

একটা জিনিস একেকজনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একেকরকম। হিটলারের চোখের দেখা একধরণের আর চার্চিলের অন্য।আই এস এর মনস্তাত্বিক দিক থেকে এই হামলাগুলো জায়েজ হবার কারণ কি? আই এস কে আমি একটি সাইকোপ্যাথ ও সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করি। কিন্তু তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যাক ওরা মুসলমানের জন্য ভালো চায়। যদি আমি যদি আই এস- এর নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে থাকতাম কি করতাম যাতে অমুসলিম ইহুদী নাসারাদের সবচেয়ে বিপদ হয়? এটাই স্বাভাবিক , যে তাহলে সম্ভবত আইফেল টাওয়ার , লুভরের মত জায়গায় হামলা চালানোর চিন্তা করতাম। তাতে রক্তপাত আর ভীতি হতো অনেক বেশি, দেশটিতেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তো। কিংবা ধরা যাক , ইসরাইল।কিন্তু আজ পর্যন্ত মুসলমানদের চরম শত্রু দেশটিতে তালেবান, আই এস বা অন্য কেউ কেন হামলা চালতে পারেনি? অস্বাভাবিকভাবে আই এস হামলা চালিয়েছে 'অপেক্ষাকৃত' কম ক্ষতি হয় এমন স্থানে।ফলাফল শেষ বিচারে মুসলিমদের বিপক্ষে গিয়েছে। পশ্চিমা অমুসলিম দেশে জনমত তৈরী হয়েছে মুসলিম দেশগুলোতে আগ্রাসন চালানোর পক্ষে।আবার লেবাননে প্রচুর মুসলিমও মারা গেছে, হোক শিয়া হোক সুন্নী।যারা ইসলামের ভালোই চায় তারা এই কাজ করবে না।তালেবান আমেরিকার সৃষ্টি ছিল। পরে এদের বিরুদ্ধে গিয়েও ওরা ফায়দা লুটেছে আধিপত্যে, তেল আর অস্ত্র ব্যবসায়।আর এখন এতগুলো শক্তিশালী দেশ মিলে আইএসকে দমন করতে পারছে না, ওদের শক্তি অর্থ অস্ত্রের উৎস কি? আবার আই এসের অজুহাত ব্যবহার করে সিরিয়াকে আক্রমণ ও বাশারকে দমন করে হাতের মুঠোয় রাখার চমৎকার সুযোগ তৈরী হয়েছে।এই অবস্থায় আই এস এর প্রতিও সন্দেহ হয় এরাও কি তবে পশ্চিমা কোন গোষ্ঠির পোষা ও মদদপ্রাপ্ত নাকি? দ্বিমুখী দৈত্যের দৌরত্ব যে আজ সবখানে।



৪।

দুইজনের ফাঁসি হলো। সাকা চৌধুরী আর মুজাহিদ পাতা দখল করে রাখলো দিনের পরে দিন। বিচার কাজ হয়ে শাস্তি হয়েছে, অপরাধীর উপযুক্ত দন্ড হয়েছে, ঠিক কথা। ক্রস ফায়ার হয়নি।কিন্তু আওয়ামী লীগের সব কিছুতেই সন্দেহ হয় আজকাল। মনে হয় ফাঁসি দেয়াটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করার সাধু ও শুভ উদ্দেশ্যে না, রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়েছে। নাহলে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে কি একটা দুইটা রাজাকারও নেই? সব দলের বাইরে লোকের মাঝে মিশে আরও তো অনেক রাজাকার আছে। ওদের জন্য তো কোন বিচারের উদ্যোগ চোখে পড়ে না। থাক বাবা ওসব কথা । কোন না কোন ধারা খেয়ে যাই কে জানে? কিন্তু ঘটনা হলো, ফেসবুক বন্ধ। ভাইবার , হোয়াইটসএ্যাপও। আমরা আমজনতা অধীর আগ্রহে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিলাম, ফাঁসি কখন হবে? কারণ ফাঁসি যত আগে হয় ততই আগে হয়ত সব খুলে দেয়া হবে। সাকাচৌ , মুজাহিদ যাই করেছে তা অতীত, ওতে আমাদের কোনই মাথাব্যাথা নেই ।কিন্তু আমরা অস্থির হয়ে দুটি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কামনা করছিলাম। মনে মনে আমরা খুনে একটি জাতি হয়ে উঠেছিলাম। হোক দোষী হোক নির্দোষ তাতে কিছু যায় আসে না, রাস্তা থেকে ধরে কাউকে ঝুলিয়ে দেক, নিজে বেঁচে আছি এটাই যথেষ্ট-রাজনীতির নিয়ে বিচারব্যবস্থা নিয়ে আমরা এখন এমনই নিস্পৃহ। আমরা শুধু ভাবছিলাম নিজের ক্ষুদ্র উপস্থিত স্বার্থ।


৫।

ঐশীর চরম দন্ড হয়েছে। খুব সাততাড়াতাড়ি দন্ড। এই ঐশীকে কে এমন ফ্রাঙ্কেস্টাইন দানব করে জন্ম দিলো?ওর নিহত বাবা মায়ের প্রশ্নবিদ্ধ অর্থ উপার্জন ও সরবরাহ , প্রতিপালন কিছুই রায়ে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের একের পরে এক ঝটপট ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি তো ভুলতে পারি না , তুলনায় হাজার গুণে নিষ্পাপ উজ্জ্বল ছেলে ত্বকীর খুনের আজ পর্যন্ত বিচার শাস্তি হয় নি। সাগর রুনীর হত্যার পিছনের রহস্য আজ পর্যন্ত জানা হলো না, কিনারা তো দূরের কথা। ছোট্ট মেঘের অশ্রুর বারিষ এখনো তো থামলো না।


বেসিনে হাত ধুতে গিয়েছিলাম সকালে। এত দিন ধরে কিভাবে ঝুলে আছে পোকাটা? কিভাবে সম্ভব? একটা আলতো ফুঁ দিলাম। নড়েচড়ে উঠে পালাক। মানুষকে সবাই ভয় পায় , নাহলে এড়িয়ে চলে। তা সে রয়েলবেঙ্গল টাইগার হোক বা ছোট পতঙ্গ। পোকাটা একটুও নড়লো না, উড়লো না। হাত পা গুলো সামান্য কেঁপে উঠলো শুধু মৃদু বাতাসে। মরে গেছে ওটা?! হয়ত সাতদিন আগেই।আর আমি এই পোকাকে দেখেই এতদিন মুগ্ধ হয়ে মনে করেছিলাম এক টুকরা সবুজ অরণ্য সে বয়ে এনেছে এই কংক্রীটের বাক্সে? একটা মমিকে দেখে সুন্দরতার উপমা দেবার মত একটা ঘিনঘিনে বিবমিষা মনে গুলিয়ে উঠলো।

লিখতে লিখতে মনের মধ্যে কুটকুট করছে অপরাধবোধ। পোষ্ট তৈরী করার মুহূর্তে আমি কি একবার দুইবার ভাবিনি -আহা! যদি এখন ফেসবুক খোলা থাকতো- শেয়ার দিতে পারতাম? আমি সেলিব্রেটি নই তবু শেয়ার দিলে আরো কয়েকটা লাইক বেশী পেতে পারতাম? অবশ্যই ভেবেছি। নির্দোষ নির্লোভ আনন্দ পাবার ইচ্ছা মনে কাজ করেছে। আসলে আমি আর সবার মতোই হিপোক্রেট একটা। দ্বিচারিতার হাত থেকে কারোরই রেহাই নেই । এ এমনই এক অজানা পাপ। জানি না, মানুষ মাত্রেই কি বাধ্যতামূলক দুইমুখো হয়ে যাই নাকি দুইমুখো হবার প্রতিভা থাকলেই মানবজন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসতে হয়?
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৩৪
৪৩টি মন্তব্য ৪৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×