বাসে উঠতেই পরিচিত একটা গন্ধ পেলাম।উৎসমুখের কাছে গিয়ে আপনাতেই পৌঁছুলো নজর। অনেক গুলো খালি সিট রেখে এমনকি আমার প্রিয় তৃতীয় ধাপের ডান পাশে জানালা ঘেঁষে সিটটার হাতছানি উপেক্ষা করে সিধে নির্দিষ্ট ঐ আসনের দিকে এগিয়ে গেলাম। এক সৌম্য দিব্যি চেহারার বুড়োর হাতের বেতে আগাগোড়া মোড়ানো ঝুড়িতে বসে তখন মার্জারপ্রবর মৃদুস্বরে তাকে এভাবে বন্দি করে রাখার জন্যে অভিযোগ জানাচ্ছে বুঝিবা।
বিড়ালের প্রতি আমার ভয়াবহ দূর্বলতা বরাবর। ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে একটা ছিল, শহরে চলে আসার মুখে আজন্মের বিচ্ছেদ। মা পুরোদস্তুর নিষেধাজ্ঞা তোলায় - এটা নোংরা করবে , ওটাতে মুখ দেবে, ছোট দু'আঙ্গুলি ফ্লাটবাড়িতে মানুষের জায়গা হয়না তো বিড়াল - এইসব নানাবিধ কারণে প্রিয় সঙ্গীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল।
মনে আছে পরেরবারে গ্রামে ফিরে শুনেছিলাম-টম মারা গেছে। পাক্কা দুইদিন কিছুই মুখে তোলানো যায়নি আমার।আর কি কান্না!। মনে মনে আরেকটা রাখার শখ ও ইচ্ছা - এই নরম জীবন্ত আদুরে খেলনার প্রতি - এখনও এতবছর পরেও আমার এতটুকু কমেনি।
তাই বুড়োর পাশটাতেই গিয়ে বসলাম সোজা। সুন্দর ফুটফুটে দেখতে বিড়াল ছানাটা- অনেকটা আমার পোষা টমের মতো সাদা কালোর মিশেল আছে।প্রিয় কার্টুন টম এন্ড জেরী থেকে তুলেছিলাম ওর নাম। যদিও আমার সে-ই দেশী সাধারন বিড়ালের সাথে এদেশের বনেদী বিড়ালের আর কোন তুলনাই চলবে না- জানি।
ছোট্ট থাবা বাইরে বেরিয়ে ছিল, লোভ সামলাতে না পেরে একটু আদর করে দিলাম। খামচি না আবার দেয়। আমার তো আর পোষা না! আর বিড়ালের খামচি টামচি বড় সাংঘাতিক জিনিস -কে না জানে?
নাহ! বিড়ালটা কোন আক্রমন করলো না। বরঞ্চ আরেকটু বাড়িয়ে ধরলো যেন আমার সুবিধে করে দেবার জন্যেই। ভারি মিশুকে তো এটা!
গ্রান্ড চিল্ড্রেনের জন্যে নিয়ে যাচ্ছেন বুঝি? আমার সাথে মুচকি হেসে বৃদ্ধ যে আমন্ত্রণের স্বাগত জানিয়েছিল ফিরতি হেসে জিজ্ঞাসা করলাম।
মনে হয়েইছিল এছাড়া আর কোন কারণ নেই। এখানের বুড়োবুড়িরা জীবনের শেষ মাথায় এসে সচরাচর বিড়াল না, শক্তপোক্ত সারমেয়ের দিকে ঝোঁকে বেশী। এদের অন্ধের যষ্ঠি- অশক্ত দিনগুলো র জন্যে ওগুলোই বেশী ভরসা। এমনকি অনেক সময় মানুষের চেয়েও বেশী।
নাহ! আমিই পালি এসব। অন্য কারোর জন্যে না। আমি বিড়াল বড়ো ভালোবাসি।
বৃদ্ধের মুখ থেকে হাসিটা তো মোছেই না, বরং আরো উজ্জ্বল হয়ে ফোটে।
এই বয়সে বুঝেছোই তো , চাকরিবাকরি নেই , কাজ টাজ নেই ।
ছেলেপুলে ঘরসংসারেরর ব্যাপারস্যাপারও নেই, একদম ঝাড়া হাত পা , নির্ঝঞ্জাট মানুষ আমি।
সারাদিন এইগুলোকে খাওয়াই দাওয়াই, যত্নআত্তি করি- এরাই আমার বাকি জীবনটা কাটানোর সম্বল। কত রকমের খেলা খেলি , বিড়ালের মত মজার সঙ্গী আর কি আছে?
এই বুড়ো এই কচি বিড়ালছানাদের সাথে উচ্ছ্বসিত শিশুর মতো খেলছেন , ওদের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছেন চিন্তা করে কেমন হাসি পেল। এদেরকে সবচে মানায় আমার মতে অফিসের সুটপরা বড়সাহেবের ওজনদার পদে, কিংবা গম্ভীরমুখে ঠোঁটের ডগায় দশাসই প্রমাণ সাইজ পাইপমুখে ইজিচেয়ারে রাশভারী অবসরযাপনে। নিজের চেনা দাদু শ্রেনীর মানুষের এবয়সের গৎবাঁধা চিন্তার বাইরে আমার মন যেতে চায় না।
তা -তে অবশ্য কি আসে যায়? এই যে আমি অর্থনীতির তরুণ লেকচারার, ক্লাসে কম বয়সের হালকা চপলতা দূর করতে একটা আলগা ''ভাব'' নিয়ে চলি, ক্লাসের ছেলেছোকরাগুলো কি কখনও ভাবতে পারে একটা মার্জার শাবক দেখলে আমার চোখ সদ্য কিশোরীর সমান আগ্রহে চকাচক করে ওঠে!
এদিকে বুড়ো সমানে বক বক করে চলেছেন ..আগের কথার খেই ধরে..বুড়োরা একটু টকেটিভ হয় এটা ত স্বত:সিদ্ধ। বলার লোক অনেক কিন্তু শোনার কেউ নেই -এটাই নিশ্চই পেছনের মনোবিদ্যা।
.....বুঝলে বিড়ালগুলোকে নিয়েই আছি সারাদিন , খাওয়ানো তো অত ঝামেলা নয়, দোকানে সব পাওয়া যায়, একদম ক্লাস ওয়ান রেটেড দেই। চিকিৎসা আছে , টিকা ফিকা আরও কত কি!
তাও বুঝলে, কোনটাই কেন যেন বেশী দিন বাঁচে না। সদাহাস্য মুখে হঠাৎ বে-নোটিশ রাজ্যের বিষন্নতা নামে।
কথায় তালভঙ্গ হয়, আমার হাতেরও। বিড়াল থেকে চোখ সরিয়ে এবার আমি বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকাই। একটু অবাক জিজ্ঞাসু ভাবেই।
জানো আমি এ পর্যন্ত গোটাদশেক বিড়াল পেলেছি, একটা ও বাঁচে নি মাসদুইয়ের বেশী, মানুষেরর তো দেখি দুটো আনলেও ছানাপোনায় কিছু দিনে ঘরদোর ভরে যায়। কত ভালো লাগে দেখতে।আর আমারগুলো..।
কোন অসুখ বিসুখ নাকি?
আরে না ,ওরকম কিছু না।তাহলেও তো বুঝতাম।
কত কষ্ট পেয়েছি যে আমি।ম্যাক্স যখন মারা গেল..। আহা, আমার বড় প্রিয় ছিল , কত খেলতাম ওর সাথে। ভারি দুষ্টু ছিল তো , মাঝে মাঝে বেশ জব্দ করতাম।শোনো কিভাবে-বেড়ালের লেজটা যদি পেছন থেকে টেনে এনে সামনের কোন একটা পায়ের সাথে বেঁধে দাও তাহলে কি মজা হয় জানো ? ওটা হাস্যকরভাবে পঙ্গুর মতো খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাঁটে। কিংবা যদি লেজে করে ওদেরকে তুলে ঝুলিয়ে ধরো.. , হা হা হা কি ফানি ভঙ্গিতে যে ওটা ঘুরতে থাকে !তখন খামচি দিয়ে তোমাকে ধরতে চেষ্টা করবে , হাতপা ছুঁড়বে কিন্তু খামচিটা পড়বে বাতাসের গায়ে- হাসির দমকে বুড়ো কথা আর শেষ করে উঠতে পারে না। এই প্রথম লোকটির হাসিতে আমার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। নিজের কানকেই বিশ্বাস হতে চায় না।
বুঝলে,কিছুক্ষণ পরে পরে কথার শুরুতে বুঝলে'টা ব্যবহার- আমি বুঝলাম , লোকটার মুদ্রাদোষ।
রাস্টি'টা খুব পেন দিত। মহা বজ্জাত। দাঁত খিচিয়ে ফেললো বুড়ো। চোখেমুখে ফুটে উঠেছে ক্রুর একটা ভাব।
অবশ্য ওর জাতেরগুলো একটু হিংস্রই হয় শুনেছি। ওকে শায়েস্তা করতে দিলুম একবার মাইক্রো ওয়েভে ঢুকিয়ে । বেশি না , একমিনিট রেখেছিলাম মাত্র। সমস্যা হলো বের করার পরে কেমন বিকট একটা গন্ধ পেলাম । গড নোজ , কিছু কি পুড়ে গিয়েছিল নাকি ওর ভেতর। জ্যান্ত সিদ্ধ, না না জ্যান্তে পোড়া যাকে বলে , হা হা । ভালো কথা, বজ্জাত বেড়ালের উপযুক্ত শিক্ষা হয় তাহলে। তা শিক্ষা ভালোই হয়েছিল বইকি। ঢোকানোর আগে, কেমন চেঁচামেচি , ফ্যাঁস ফোঁস , বের করে আনতে উল্টা একদম ঠান্ডা মেরে গেল ।সমস্যা হলো ,কথা নেই বার্তা নেই ঠিক সন্ধ্যার দিকে দুম করে মরে গেল ওটা। বুড়োর মুখটায় এখন কোন ভাব ঠাহর হলো না, নির্বিকার ভাবে ''বজ্জাত রাস্টি''র কথা শেষ করলো সে।
বুঝলে,.. বেড়াল আর দুষ্ট শিশু -দুটার মাঝে কোন তফাৎ নেই। দেখ- এদেশে সরকার আইন করেছে বাচ্চা কাচ্চাদের পেটানো যাবে না , তাই তো এদেশের পিচ্চিগুলো বড় বেয়ারা। বেড়ালকেও করলে কতগুলো গাঁয়ের মোষ তাড়ানি দল আছে , চিল্লাফাল্লি করে কিন্তু এতে অত ঝামেলা, নেই। যত যাই বল বিড়াল তো আর গিয়ে আদালতে নালিশ করতে পারে না তাই না। বেশী যন্ত্রণা করলে দাও আমার মতো ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে একচক্কর , দেখবে কেমন উচিত শিক্ষা হয়,.. হাসতে শুরু করে লোকটা যেন বড়দরের কোন রসিকতা করেছে ।
নিরাপদ ছোটখাট শাস্তি হচ্ছে ,দেব এক লাথি কষিয়ে, যতই ভালোবাসি না কেন কোন তেড়িবেড়ী নেই আমার সাথে। জুৎমতো মারতে পারলে ওগুলো কি মজাদার ভাবে বৃত্তাকারে একেবারে পুরো ডিগ্রির ঘরে তিনশোষাটে একপাকচক্কর ঘুরে তবেই নিচে ধুপ করে পড়ে।
শুনতে শুনতে গা শিউরে উঠলো আমার। আশে পাশ তাকিয়ে দেখি বাসে আমার দুজন ছাড়া আর কেউ নেই এমুহুর্তে। কেন যেন আমরা গা ছমছম করতে থাকে।
হ্যামারস্মিথ ষ্টেশন আসতে আর কত দেরী?ঘনঘন ষ্টেশন দেখানো সামনের ইলেকট্রিক বোর্ডটার দিকে তাকাই আমি।
বুঝলে , এইবার এনেছি এটাকে, ..নরওয়েজিয়ান ফরেস্ট ক্যাট , যথেষ্ট শক্তপোক্ত বলে সুনাম আছে, দেখেই আনলাম , অন্যগুলোর মত এর নাকি কই মাছের প্রাণ না। এবার আশা করি আমার বেড়াল ভাগ্যের অমানিশা ঘুচলো।এই বুড়ো বয়সে একা একা আর কত ভালো লাগে, তাও মারা পরলে আবার নতুন করে কেনা বাছাই অনেক ভাগদৌড়ের ব্যাপার।কত আর করা যায়? তোমার চেহারা দেখেই বুঝেছি , এশীয় , তোমাদের মত লতাপাতা জড়ানো মোড়ানো তো আর আমাদের সমাজ না। এই বয়সে দুদিন বাদে বাদে সঙ্গী বদলাতে , মানাতে ও মানিয়ে নিতে যাবার হ্যাপা ...বিরক্তিকর।
লোকটার দিকে আমি তাকাতেই পারছি না। ভদ্রতার কারণেই উঠে অন্যকোথাও যেতেও বাঁধছে।বিকৃত মস্তিষ্কের এই লোকের কাছে থেকে শুধু বেড়াল কুকুর না ,যাবতীয় মনুষ্যসন্তানেরও শত হস্ত দূরে থাকাটাই নিরাপদ ।
যাহ বাব্বা! আমার নামার জায়গা এসে গেছে,তাড়াতাড়ি লাল সংকেত বোতামে চাপ দিলাম। ঘড়ির কাঁটায় বলবে মাত্র আধঘন্টা, কিন্তু মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে এই পাগলা বুড়োর হাতে বন্দি হয়ে আছি।
শেষবারের মতো বিড়ালটার দিকে করুণ চোখে একটু তাকালাম।
মায়া লাগছে , বেচারার জন্যে, কি আর করা!
ঘর ঘর করে দরজা খুলে যাচ্ছে, পা চালিয়ে দ্রুত নেমে পড়লাম আমি ।
রেজওয়ানা আলী তনিমা
০৯ মে,'১৪ ইং।